প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যু রোধ করতে প্রয়োজন সচেতনতা

অন্যান্য জাতীয় স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা

পিআইবি ফিচার


শানু মোস্তাফিজ

দিনাজপুরের বোদা উপজেলার একটি গ্রামের আশা রাণী (২২) নয় মাসের গর্ভবতী। একদিন হঠাৎ তার পেটব্যথা শুরু হয়। আশা ভাবেন, তার প্রসববেদনা উঠেছে। আশা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে না গিয়ে বাড়িতে থাকেন এবং স্থানীয় দাই ডেকে কাক্সিক্ষত সময়ের জন্য অপেক্ষা করেন। কিছুক্ষণ পর যখন প্রচুর পরিমাণ রক্তক্ষরণ শুরু হয়, তখন তিনি কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তার পরিবার ও দাই কেউই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি এবং তাকে হাসপাতালে নেননি। শেষ পর্যন্ত অবস্থা অনেক খারাপ হলে আশাকে স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেওয়া হয়। তখন আশার অবস্থা অনেক খারাপ ছিল এবং সে মারা যায়। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক বলেন, ‘রক্তক্ষরণের সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আশাকে নিয়ে গেলে বাঁচানো সম্ভব হতো। কেননা এ ধরনের সমস্যায় কী করতে হবে, তা চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া রয়েছে। তারা এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারেন।’

চিকিৎসকরা বলছেন, এরকম নানা ধরনের জটিলতায় প্রসবকালীন এবং প্রসব-পরবর্তী অনেক নারী মারা যাচ্ছেন। সাধারণ কিছু বিষয়ে সচেতনতা থাকলে মায়েরা এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেতে পারেন।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এবং সেন্ট্রাল হাসপাতালের বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ফারহানা দেওয়ান বলেন, ‘মূলত দুটি কারণে প্রসবকালীন মায়েরা মারা যান। প্রসবকালীন বা প্রসব-পরবর্তী সময়ে সাধারণত খিঁচুনি এবং রক্তক্ষরণে বেশি মা মারা যান। খিঁচুনি অনেক সময় ডেলিভারির আগে হতে পারে এবং পরেও হতে পারে। এজন্য গর্ভকালীন চেকআপ জরুরি। চেকআপের মাধ্যমে জানা যায় মায়ের এ ধরনের সমস্যা হতে পারে কি না। যদি তা হয়, তাহলে সেভাবে তাকে ওষুধ দেওয়া হয়। কিংবা তাকে কীভাবে চলতে হবে, সে বিষয়ে নিয়মকানুন জানিয়ে দেওয়া হয়। কোনো গর্ভবতী মায়ের খিঁচুনির সম্ভাবনা থাকলে অবশ্যই তার ডেলিভারি হাসপাতালে করাতে হবে। নইলে তার মৃত্যুঝুঁকি রোধ করা অসম্ভব হয়ে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘রক্তক্ষরণ গর্ভকালীন হতে পারে বা প্রসবকালীন বা এর পরও হতে পারে। এজন্য বাড়িতে প্রসবের চেষ্টা না করে হাসপাতালে যেতে হবে। কেননা হাসপাতালে যখন চিকিৎসকরা ডেলিভারি করান তখন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন। আমরা ডেলিভারির আগে একটা ইঞ্জেকশন দিই যাতে রক্তক্ষরণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। কিন্তু বাড়িতে দক্ষ বা অদক্ষ দাই তা জানে না। তবে পরিস্থিতি যাই হোক, মায়ের খিঁচুনি বা রক্তক্ষরণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গেলে বাঁচানো সম্ভব।’

ডা. ফারহানা আরও বলেন, ‘অনেক সময় ভ্রূণ জরায়ুতে না থেকে ডিম্বাশয়ে থাকতে পারে। ডিম্বাশয় তার থাকার জায়গা নয়। তাই সেখানে ভ্রূণ বাড়তে পারে না। এ রকম হলে ডিম্বাশয় ফেটে মায়ের মৃত্যু হতে পারে। অনেক সময় জরায়ুতে কোনো ত্রুটি বা ফাটা থাকতে পারে। আলট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে এগুলো শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। মায়ের ডায়াবেটিস, থায়রয়েড, উ”চরক্তচাপ, এমনকি ইনফেকশনও থাকতে পারে। চেকআপের মাধ্যমে এগুলো জানা সম্ভব এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা ও চিকিৎসা দেওয়া হয়। অনেকে ভাবেন গর্ভবতী মা ভালো আছেন, তাঁর কোনো সমস্যা নেই এসব ভাবনা ঠিক নয়। এতে অনেক অঘটন ঘটতে পারে। এছাড়াও কম বয়সে মা হওয়া, ঠিকভাবে টিকা না নেওয়া, গর্ভকালীন নিয়ম মেনে না চলা প্রভৃতি কারণেও প্রসবকালীন মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, একজন গর্ভবতী মা তার গর্ভকালীন চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে আটটি ‘প্রসবপূর্ব চেকআপ’ করাবেন। সংস্থাটি সম্প্রতি প্রসবপূর্ব চেকআপকে মানবাধিকারের বিষয়ের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করেছে। ‘বাংলাদেশ ম্যাটারনাল মরটালিটি অ্যান্ড হেলথকেয়ার সার্ভে (বিএমএমএস)-২০১৬’ রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ‘বাংলাদেশে শতকরা ৩৭ ভাগ নারী চারবার প্রসবপূর্ব চেকআপ করান।’

ইউনিসেফের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৫ হাজার ২০০ নারীর মৃত্যু হয় গর্ভকালীন, প্রসবকালীন এবং সন্তান জন্মের পর সৃষ্ট জটিলতায়। অধিকাংশ মায়েরই মৃত্যু ঘটে কোনো চিকিৎসক বা দক্ষ ধাত্রী ছাড়া বাড়িতে সন্তান প্রসবের সময়। এছাড়া গর্ভধারণকালে নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী হাসপাতাল, ক্লিনিক ও স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে গিয়ে প্রসবপূর্ব সেবা না নেওয়ার কারণেও অনেক মায়ের মৃত্যু হয়।

ইউনিসেফের কৈশোর ও মাতৃস্বাস্থ্যবিষয়ক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আবু সাদত মো. সায়েম বলেন, ‘হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোয় একজন গর্ভবতী মা বা প্রসবকালীন মায়ের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা থাকা সত্তে¡ও গ্রামা লের অনেক নারী সেখানে যান না বলে মাতৃমৃত্যুর হার কমানো কষ্টসাধ্য হচ্ছে।’
এই অঘটন যাতে না ঘটে, এজন্য সরকার বদ্ধপরিকর। এ কারণে গ্রাম পর্যায়েও রয়েছে নানা পদক্ষেপ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাতৃস্বাস্থ্য কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. আজিজুল আলীম বলেন, মাতৃমৃত্যু এবং নবজাতকের মৃত্যু ও জটিলতা কমাতে প্রতিটি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ‘প্রসবপূর্ব চেকআপ কর্নার’ নামে একটি জায়গা নির্দিষ্ট করা রয়েছে। যেখানে গর্ভবতী মায়েরা সেবা পান। সেখানে চিকিৎসক, প্রশিক্ষত নার্স, মিডওয়াইফ বা স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন। এজন্য মানুষকে সচেতন হতে হবে এবং বাড়িতে ডেলিভারি না করে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে হবে। কেননা সেখানে সব ধরনের ব্যবস্থ্যা রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা কয়েকটি সহযোগী পার্টনারের সঙ্গেও কাজ করছি। তারা আমাদের কর্মীদের এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেন এবং গবেষণার কাজগুলো করেন। যেমন: কোনো মা প্রসবকালীন মারা গেলে কেন তিনি মারা গেলেন, এ বিষয়ে বিস্তারিত জেনে তারা রিপোর্ট তৈরি করেন। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে আমরা নানা পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নিয়ে থাকি। কাজেই সরকার মাতৃমৃত্যুর হার কমানোর জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক এবং বাস্তবসম্মতভাবে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। এছাড়াও সরকার দরিদ্র ও দুস্থ মা যাতে গর্ভকালীন ঠিকভাবে খেতে পারেন বা সেবা নিতে পারেন, এজন্য ৫৬টি জেলায় প্রসবকালীন ভাতা দিচ্ছে।

এসডিজিতেও এ বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাই যেখানে মা ও শিশুর সুরক্ষার জন্য সরকার সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে এবং স্বাস্থ্যসেবা সবার জন্য সহজলভ্য করেছেন সেখানে অবহেলা বা অজ্ঞতা নয়, সচেতনতার মাধ্যমে তা গ্রহণ করতে হবে আমাদের। মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে গর্ভকালীন থেকে শুরু করে শিশু জন্মের কয়েক মাস পর্যন্ত একজন মাকে নিয়ম মেনে চলার পাশাপাশি হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে এমনই বলছেন সংশ্লিষ্টজন। (পিআইবি ফিচার)

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *