বাংলা সাহিত্যের অনন্য শিল্পী প্রেমেন্দ্র মিত্র

শিল্প ও সাহিত্য
সুবর্বাঙলা ডেস্ক
প্রেমেন্দ্র মিত্রের একটি বিরল ছবি
ঢাকায় মেডিক্যাল কলেজে চেয়েছিলেন ডাক্তারি পড়তে । কিন্তু সেখানে প্রথম তালিকায় নাম উঠল না । ভর্তি হলেন ঢাকারই জগন্নাথ কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে । মাঝে মাঝে ছুটি পেলেই ফিরে আসতেন কলকাতায় । উঠতেন পুরোনো মেসে । সেইরকমই একবার মেসে এসে উঠলেন । পুরোনো জিনিসপত্র ঘাঁটতে গিয়ে পেলেন এক পোস্টকার্ড । সেটি তিনি পড়লেন । চিঠিতে এক গ্রাম্য বধূ আঁকাবাঁকা হাতের লেখায় শহরে কাজ করতে আসা তার স্বামীকে পরিবারের অভাব অভিযোগের কথা বলেছেন আর বলেছেন স্বামীকে রোজ দেখতে না পাওয়ার আক্ষেপের কথা । চিঠিটি পড়ে তিনি একটু থমকালেন । কাগজ কলম নিয়ে তখনই বসে পড়লেন । লিখে ফেললেন দুটি গল্প, ‘শুধু কেরাণী’ আর ‘গোপনচারিণী’৷ পরদিন সকালে ভবানীপুর পোস্ট অফিসে গেলেন আর সেই দুটি গল্প পাঠিয়ে দিলেন প্রবাসী পত্রিকার ঠিকানায় । তারপর ঢাকায় ফিরে গেলেন । প্রায় কয়েকমাস ধরে প্রবাসী পত্রিকা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন । না তার গল্প প্রকাশিত হয়নি । একদিন তিনি ডাইনিং হলে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন । এক বন্ধু তাঁকে জানাল এইবারের প্রবাসী পত্রিকায় একটা গল্প প্রকাশিত হয়েছে, লেখকের নাম আর তোমার নাম একই । তিনি যা বোঝার বুঝে ফেলেছেন । সাথে সাথে জোগাড় করলেন এইবারের প্রবাসী পত্রিকা । দেখলেন তাঁর গল্প প্রকাশিত হয়েছে ।
জন্ম হুগলির কোন্নগরে । উচ্চবিত্ত পরিবার । ঠাকুরদা শ্রীনাথ মিত্রর বন্ধু ছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী । বাবা জ্ঞানেন্দ্রনাথ মিত্র ব্রিটিশ রেলকোম্পানির অ্যাকাউন্ট্যান্ট । মা সুহাসিনী উত্তর প্রদেশের মির্জাপুরে রেলেরই ডাক্তার রাধারমণ ঘোষের একমাত্র মেয়ে । কিন্তু জ্ঞানেন্দ্রনাথ মিত্র জড়িয়ে পড়লেন অন্য সম্পর্কে । বিয়েও করলেন আবার । সুহাসিনী দেবী তার ছেলেকে নিয়ে চলে গেলেন উত্তরপ্রদেশ । আশ্রয় নিলেন বাবার কাছে । ঠিকানা হল মির্জাপুরের রেল হাসপাতালের কোয়ার্টার৷ সেখানেই বড় হতে লাগলেন তিনি। বন্ধু ছিলেন লজ্জু আর মুরাদ । একবার তিনজনে খেলতে গেলেন । খেলতে গিয়ে তাঁর জামা ছিঁড়ে যায় । মা জানলে বকবে । কি বলবে মা কে ? লজ্জু বলে দিল উপায় – এক দুর্ধর্ষ ডাকাত তাদের ধরেছিল, তাতেই নাকি এই দশা । লজ্জুই প্রথমবার তাঁকে শিখিয়েছিল গল্প বানিয়ে বলতে । পরে আত্মজীবনীতে মেনেও নিয়েছিলেন সেই কথা ।
তিনি থাকতেন ২৮ নম্বর গোবিন্দ ঘোষাল লেনের মেসবাড়িতে । এই মেসই পরে হয়ে উঠেছিল ঘনাদার মেজকর্তার ভূতের গল্পের ঠেক । মেসের পরিচালক ছিলেন বিমলচন্দ্র বাবু । তাঁর আদলেই তিনি তৈরী করেছিলেন গল্পের আর এক চরিত্র নীপুদা-কে । এর পাশাপাশি পরাশর বর্মা এবং মামাবাবু তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি । তাঁর জনপ্রিয়তম চরিত্র ঘনাদা, গল্পবাগীশ সর্বজ্ঞানী মেসবাড়ির ঘনশ্যাম দাস আজও সব বয়েসের পাঠকদের কাছে প্রিয়। তিনি প্রথম বাঙালি সাহিত্যিক যিনি নিয়মিত কল্পবিজ্ঞান বা বিজ্ঞান-ভিত্তিক গল্প-উপন্যাস রচনায় মনোনিবেশ করেন। রামধনু পত্রিকায় ক্ষিতীন্দ্রনারায়ন ভট্টাচার্য তাকে ছোটদের জন্যে লিখতে অনুরোধ করলে তিনি ‘পিঁপড়ে পুরান’ কাহিনীটি লেখেন। এটিই তার প্রথম কল্পবিজ্ঞান রচনা । ‘কুহকের দেশে’ গল্পে তার কল্পবিজ্ঞান ও এডভেঞ্চার কাহিনীর নায়ক মামাবাবুর আত্মপ্রকাশ। ১৯৪৮ সালে ‘ড্র্যাগনের নিঃশ্বাস’ বের হলে মামাবাবু পাঠক মহলে জনপ্রিয় হন।
সাহিত্যতেই তিনি থেমে থাকেননি । চলচ্চিত্র পরিচালনার জন্যে তৈরী করেছিলেন নিজের কোম্পানি ‘মিত্রাণী’ । পরিচালনা করেছিলেন ১৪ টি ছবি । লিখেছেন বহু ছবির গল্প, চিত্রনাট্য, গান । কালো ছায়া ছবিতে ধীরাজ ভট্টাচার্যকে ডাবল রোলে অভিনয় করিয়েছিলেন । তখন প্রযুক্তি এত উন্নত ছিল না । ক্যামেরার লেন্স অর্ধেকটা ঢেকে শুট করলেন প্রথম চরিত্রের ধীরাজ ভট্টাচার্যের, বাকিটা করেছিলেন ক্যামেরার অন্য অংশ দিয়ে ।‘পথ বেঁধে দিল’ তার পরিচালিত আরেকটা উল্লেখযোগ্য সিনেমা ।
১৯৮৮ সাল । শরীরে দানা বেঁধেছিল কর্কট রোগ । খুব অসুস্থ অবস্থায় লিখেছিলেন ‘ঘনার বচন’ । কিন্তু আর বেশীদিন লেখালিখি করতে পারলেন না । গোটা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছিল ক্যানসার । ৩ রা মে পাড়ি দিলেন অনন্তলোকে ।
প্রেমেন্দ্র মিত্র বাংলার সর্বকালের অন্যতম সেরা সাহিত্যিক । প্রয়াণদিবসে জানাই শ্রদ্ধা ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *