সৌমিত্র দেব
রহিমুদ্দিন রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় রিকশা চালান। থাকেন ডুমনি গ্রামে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। এর চেয়ে বেশি পড়ার সংগতি ছিল না তার। সংসারে অভাব ছিল। দারিদ্র্য ছিল। কিন্তু রহিমুদ্দিনের মেয়ে রোজিনা ইসলাম এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ে। ভালো ছাত্রী। তাকে পড়াতে এখন আর অসুবিধা হচ্ছে না রহিমুদ্দিনের। প্রতিদিন মহাজনের টাকা জমা দেওয়ার পরও তাঁর হতে থাকে পাঁচশ টাকার মতো আয়। মাসে প্রায় ১৫ হাজার টাকা। স্ত্রী কুলসুম বিবি আগে মানুষের বাসায় কাজ করতেন। এখন উত্তরখানে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। ওই টাকা সংসারেই খরচ করেন কুলসুম বিবি।
একটাই মেয়ে রোজিনা। ছেলেসন্তান নেই বলে এতটুকু দুঃখ নেই রহিমুদ্দিনের। মেয়েটা পড়াশোনায় যেমন ভালো, তেমনই কাজের। ঘরে বসেই জামাকাপড় সেলাই করে ভালো আয় করছে। একটি বুটিক হাউজ গড়ার স্বপ্ন দেখছে সে। বলেছে, বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাকে এ ব্যাবসা করতে হবে না। সরকার নাকি নারী উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছে। সেই টাকাতেই ব্যাবসা শুরু করবে সে।
ঘরে আছেন রহিমুদ্দিনের মা। তিনিও সরকার থেকে বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন। রহিমুদ্দিনের সংসারে এখন আর অভাব নেই। ঈদের সময় তারা সপরিবারে বেড়াতে যায়। রহিমুদ্দিনের মতো গরিবরা এখন মধ্যবিত্তের পর্যায়ে উঠে এসেছেন।
বাংলাদেশে অর্থনীতির আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দারিদ্র্যের হারও কমে আসছে, এটি আশার কথা। কিš‘ হতাশার বিষয় হলো, দারিদ্র্য কমার ক্ষেত্রে শহর ও গ্রামা লের মধ্যে বেশ ফারাক রয়ে গেছে। গ্রামা লে যে হারে দারিদ্র্য কমছে, সেই হারে শহরে কমছে না। অন্যদিকে সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিতে শহরা ল উপেক্ষিত থাকছে। শহরে বসবাসকারী দরিদ্রদের মাত্র ১৭.৮৪ শতাংশ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সরকারি সহায়তা পেয়ে থাকে; যেখানে গ্রামা লে ৩৫.৭৭ শতাংশ দরিদ্র মানুষ এই সুবিধা ভোগ করে। তবে সকারের ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বরাদ্দ ৭৪ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৫ শতাংশ।
গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের বরাদ্দ যেমন বেশি, তেমনই বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোও অনেক সক্রিয়। সে তুলনায় শহরা লে তাদের কার্যক্রম সীমিত। এ বিষয়ে নজর দেওয়া প্রয়োজন।
বিশ্বব্যাংক স্বীকার করেছে, ২০১০ সালের পর থেকে বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচনে বেশ সফলতা দেখিয়েছে। ২০১০ সালে যেখানে দরিদ্রের হার ৩০ শতাংশের ওপর ছিল, সেখানে তা ২১ শতাংশে নামিয়ে আনা প্রশংসা পাওয়ার দাবি রাখে। শহর, গ্রাম এবং অ লভেদে দারিদ্র্য বিমোচনে কিছুটা বৈষম্য রয়ে গেছে। এটিকে অতিক্রম করা জরুরি।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০-১৬ সময়ে দারিদ্র্য বিমোচনের ৯০ শতাংশই হয়েছে গ্রামে। গ্রামা লে দারিদ্র্য কমুক, সেটা আমরাও চাই। কিš‘ শহরা লে দারিদ্র্য পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলে কিংবা অতিদরিদ্রের সংখ্যা বাড়তে থাকলে সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি কোনো সুফল দেবে না। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশে শহরের জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। বর্তমানে গ্রামা লে ৬৫ শতাংশ এবং শহরে ৩৫ শতাংশ মানুষ বাস করে। অদূর ভবিষ্যতে শহর ও গ্রামের জনসংখ্যার ফারাক আরও কমে যাবে।
শহরে দারিদ্র্য কমাতে হলে অবিলম্বে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী যেমন বাড়াতে হবে, তেমনই বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। তাদেরও সেকেলে চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। গত ছয় বছরের ব্যবধানে এ হার কমেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস।
প্রকল্প পরিচালক জানান, ২০১৬ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২২ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৫ শতাংশে। ফলে ২০১৬ সালের তুলনায় ২০২২ সালে জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র্যের হার কমেছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রকল্প পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, ২০২২ সালে উচ্চ দারিদ্র্যরেখা ব্যবহার করে পল্লি এলাকায় এ হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ এবং শহরা লে ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১৬ সালে পল্লি এলাকায় এ হার ছিল ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ এবং শহরা লে ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ। প্রকল্প পরিচালক আরও জানান, ২০২২ সালে অতিদারিদ্র্য হার জাতীয় পর্যায়ে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, যা পল্লি এলাকায় ৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং শহরা লে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। যেখানে ২০১৬ সালে এ হার ছিল জাতীয় পর্যায়ে ১২ দশমিক ৯, পল্লি এলাকায় ১৪ দশমিক ৯ এবং শহরা লে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের ‘দারিদ্র্য বিমোচন’ বিষয়ে বর্তমান সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দারিদ্র্য বিমোচনের এ ধারা অব্যাহত থাকলে আশা করা যায় শিগগিরই দেশ দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে। দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হিসাবে বিশ্বদরবারে মাথ উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।