সাময়িক সনদ নিয়ে স্থায়ী বন্দোবস্ত!

জাতীয় শিক্ষা-গবেষণা ও ক্যাম্পাস

সাব্বির নেওয়াজ

সাত বছরের ‘সাময়িক সনদ’ নিয়ে বছরের পর বছর পার করে দেওয়া অর্ধশতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অবশেষে কঠোর হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। খুব দ্রুত এসব বিশ্ববিদ্যালয়কে চূড়ান্ত সতর্ক করে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগামী সপ্তাহেই সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইউজিসির চিঠি পেতে পারে।

সাময়িক অনুমতি নিয়ে যাত্রা শুরু করা বহু বিশ্ববিদ্যালয় কয়েক দফায় সরকার থেকে আরও পাঁচ বছর সময় বাড়িয়ে নেয়। ১২ বছরেও স্থায়ী সনদ না পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আর ছাড় দেবে না ইউজিসি।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এর ১২(১) ধারা অনুসারে, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কেই স্থায়ী সনদ নিতে হবে। প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের দেওয়া সাময়িক অনুমতির মেয়াদ সাত বছর। এর পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবেদন করলে সরকার তিন দফায় সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে দিতে পারে। এ সময়ের মধ্যে আইনে নির্ধারিত পরিমাণ জমিতে নিজস্ব স্থায়ী ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা করে সেখানে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে হবে। তবে এরই মধ্যে ১২ বছরের বেশি সময় পার হওয়ায় এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আইন অনুসারে আর সময় বাড়ানোর সুযোগ নেই।

ইউজিসির তথ্য বলছে, এ মুহূর্তে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১৩টি। এগুলোর মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে ১০৩টিতে। অন্যগুলো নতুন।

১১৩ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্থায়ী সনদ নিয়েছে মাত্র ১২টি। শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ৯১টির স্থায়ী সনদ নেই। তবে ১২ বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেছে এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬০টির কাছাকাছি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে স্থায়ী সনদ অর্জন করতে না পারা এসব বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসির চোখে ‘আইন ভঙ্গকারী’।

যে ১২ বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী সনদ পেয়েছে সেগুলো হলো– ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চিটাগং (ইউএসটিসি), আহ্ছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক, চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সিটি ইউনিভার্সিটি, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি এবং নাটোরের বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি।

জানা গেছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুযায়ী, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী সনদ নেওয়া বাধ্যতামূলক। এর জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে উচ্চশিক্ষার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউজিসির কাছে আবেদন করতে হয়। দেখা গেছে, আইন অনুযায়ী নির্ধারিত পরিমাণ (ঢাকা মহানগরে নিষ্কণ্টক, অখণ্ড এক একর, ঢাকার বাইরে তিন একর) জমিতে নিজস্ব স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম চালালেও বহু বিশ্ববিদ্যালয় এখনও স্থায়ী সনদের জন্য আবেদনই করেনি। এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় খ্যাতনামা নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিও রয়েছে। স্থায়ী সনদ ছাড়া শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা আইনসম্মত নয় এবং অবৈধ। মূলত এ কারণে যারা এখনও স্থায়ী সনদের জন্য আবেদন করেনি, তাদের সতর্ক করে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

জানতে চাইলে ইউজিসির পরিচালক (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) মো. ওমর ফারুখ সমকালকে বলেন, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব ক্যাম্পাসে তাদের পাঠদান শুরু করলেও স্থায়ী সনদের জন্য এখনও আবেদনই করেনি। তিনি জানান, যারা সনদের জন্য আবেদন এবং শর্ত পূরণ করে স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ করেনি, তাদের চিঠি দিয়ে চূড়ান্তভাবে সতর্ক করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে যারা আবেদন করেছে কিন্তু সনদ পায়নি, তারা এর আওতায় পড়বে না। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী সনদ পাওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৫ সালের ৬ নভেম্বর প্রতিষ্ঠা পাওয়া আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি রাজধানীর খিলক্ষেতের কুড়াতলী সড়কের ৪০৮-১ নম্বর প্লটে স্থায়ী ক্যাম্পাস গড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থায়ী সনদ পেতে আবেদনও করেছে, ইউজিসি তাদের পরিদর্শন প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। ১৯৯৩ সালের ৩০ অক্টোবর প্রতিষ্ঠা পাওয়া উত্তরার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজিও এ সনদ পেতে আবেদন করেছে। তাদের আবেদন ইউজিসিতে প্রক্রিয়াধীন।

চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদনের কার্যক্রমও চলমান। ইউজিসিতে আবেদন প্রক্রিয়ারত বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আরও রয়েছে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, বগুড়ার পুণ্ড্র ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি। চট্টগ্রামের ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির আবেদন প্রক্রিয়া শেষে প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

জানা গেছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর আসাদগেটের দ্য পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ১৯৯৬ সালের ১৬ মে। বহু আগেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাময়িক সনদের মেয়াদ শেষ হয়েছে। তাদের শিক্ষা কার্যক্রম এখনও স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তরিত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে এর ব্যাখ্যা চেয়েছিল ইউজিসি। তবে তাদের ব্যাখ্যা ইউজিসির কাছে সন্তোষজনক মনে হয়নি। পরবর্তী সিদ্ধান্তের জন্য তাদের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজধানীর গুলশানের মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিও সাময়িক সনদের মেয়াদ ফুরিয়েছে। তাদের স্থায়ী ক্যাম্পাসবিষয়ক মামলা আদালতে বিচারাধীন। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়েরও সাময়িক সনদের মেয়াদ পার হয়ে গেছে। স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে ইউজিসি। জবাবও পাওয়া গেছে। তবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি ইউজিসি।

ধানমন্ডি সাতমসজিদ রোডের ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভেরও (ইউডা) সাময়িক সনদের মেয়াদ শেষ। ১২ বছরের জায়গায় ২৩ বছর পার করা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে।

২০০২ সালে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সিদ্ধেশ্বরীর স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশেরও সাময়িক অনুমতির মেয়াদ হারিয়েছে। তাদের স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য আগামী ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে। একই বছরে প্রতিষ্ঠিত ধানমন্ডির স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশেরও আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা মোমেনবাগের দি মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটিরও মেয়াদ ফুরিয়েছে। এ ছাড়া ফাউন্ডেশনের জমি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে এখনও লিখে দেননি ট্রাস্টিরা। এ কাজটি প্রক্রিয়াধীন বলে ইউজিসিকে জানিয়েছে তারা।

পান্থপথের ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশেরও সাময়িক অনুমতির মেয়াদ শেষ। স্থায়ী ক্যাম্পাসে যায়নি। ব্যাখ্যা চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা সন্তোষজনক মনে করেনি ইউজিসি। পরবর্তী সিদ্ধান্তের জন্য বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। গুলশানের প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটিও সাময়িক অনুমতির মেয়াদ শেষ করেছে বহু আগেই। স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে তাদের আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। একই সময় পেয়েছে সাময়িক সনদের মেয়াদ হারানো বনানীর প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি ও শ্যামলীর আশা ইউনিভার্সিটি।

স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করলেও এখন পর্যন্ত স্থায়ী সনদ পেতে আবেদনই করেনি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আছে– নর্থ সাউথ, ইনডিপেনডেন্ট, সেন্ট্রাল উইমেন্স, গণ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রামের বিজিসি ট্রাস্ট, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি, প্রাইম ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রামের সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি, নারায়ণগঞ্জের গ্রিন ইউনিভার্সিটি, সিলেটের মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া, ভাটারার ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস, রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস, বাংলাদেশ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, মুন্সীগঞ্জের হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়, চুয়াডাঙ্গার ফার্স্ট ক্যাপিটাল, শরীয়তপুরের জেডএইচ সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিরাজগঞ্জের খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস, নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ এবং কুমিল্লার বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্সেস অ্যান্ড টেকনোলজি।

স্থায়ী সনদের বিষয়ে ইউজিসির সদস্য (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ সমকালকে বলেন, আইনের বাইরে গিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার কোনো সুযোগ নেই। যারা অনিয়মের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় চালাচ্ছেন, তাদের আমরা চূড়ান্ত সতর্ক করছি। এর পরও না শুনলে সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবো।

(সৌজন্য: সমকাল)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *