মার্কিন ব্যতিক্রমবাদ কেমন হবে ২০২৪ সালে

আন্তর্জাতিক

সুবর্ণবাঙলা অনলাইন ডেস্ক


ছবি সংগৃহীত

নতুন বছর এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মহেন্দ্রক্ষণও চলে আসছে। নতুন বছরে যুক্তরাষ্ট্র ও বহির্বিশ্বের সম্পর্ক কেমন হবে এ বিতর্ক তিনটি স্তরে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমত উদারপন্থী আন্তর্জাতিকবাদীরা যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আধিপত্য বিস্তার করেছে, দ্বিতীয়ত কিছু ছাঁটাইকারী যারা জোট ও প্রতিষ্ঠান থেকে সরে আসতে চায় এবং তৃতীয়ত আমেরিকা ফার্স্টার্স, যারা বিশ্বে আমেরিকার ভূমিকা সম্পর্কে সংকীর্ণ, কখনও কখনও বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব পোষণ করে।

আমেরিকানরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের দেশকে নৈতিকভাবে ব্যতিক্রমী হিসেবে দেখে আসছে। ফরাসি-আমেরিকান বুদ্ধিজীবী স্ট্যানলি হফম্যান বলেছেন, প্রতিটি দেশ নিজেকে অনন্য বলে মনে করে। ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র মনে করে তাদের মূল্যবোধ বিশ্বজনীন। ফ্রান্স অবশ্য ইউরোপে ক্ষমতার চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় তার সর্বজনীন উচ্চাকাঙ্ক্ষা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এই ক্ষমতা শুধু যুক্তরাষ্ট্রেরই ছিল।

বিষয়টা এমন নয় যে আমেরিকানরা নৈতিকভাবে উচ্চতর; বিষয়টা বরং এমন, অনেক আমেরিকান মনে করেন তাদের দেশ বিশ্ব মঙ্গলের জন্য একটি শক্তি। বাস্তববাদীরা দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন এই নৈতিকতা মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিতে ক্ষমতার সুস্পষ্ট বিশ্লেষণে হস্তক্ষেপ করে। তবুও সত্য যে আমেরিকার উদার রাজনৈতিক সংস্কৃতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিদ্যমান উদার আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় একটি বিশাল পার্থক্য তৈরি করেছে। হিটলার বিজয়ী হলে বা স্নায়ুযুদ্ধে স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন বিজয়ী হলে আজকের পৃথিবীটা অন্যরকম দেখাত।

আমেরিকান ব্যতিক্রমবাদের তিনটি প্রধান উৎস রয়েছে। ১৯৪৫ সাল থেকে প্রভাবশালী হল এনলাইটেনমেন্টের উত্তরাধিকার, বিশেষ করে আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতাদের মাধ্যমে প্রদত্ত উদারপন্থী ধারণা। প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি যেমনটি বলেছিলেন, ‘আমাদের পক্ষে জাদু শক্তি হল প্রতিটি ব্যক্তির স্বাধীন হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, প্রতিটি জাতির স্বাধীন হওয়ার আকাঙ্ক্ষা… কারণ আমি মনে করি, আমাদের সিস্টেমটি মানব প্রকৃতির মৌলিক বিষয়গুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, আমি বিশ্বাস করি আমরা শেষ পর্যন্ত সফল হতে যাচ্ছি। আলোকিত উদারতাবাদ শুধু যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সার্বজনীন হওয়ার অধিকার রাখে।

আমেরিকানরা তাদের উদার আদর্শ বাস্তবায়নে সর্বদা দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হয়েছে। দাসপ্রথার কলঙ্ক সংবিধানে লেখা হয়েছিল। ১৯৬৪ সালে কংগ্রেসে নাগরিক অধিকার আইন পাস করার আগে গৃহযুদ্ধের এক শতাব্দীরও বেশি সময় এই প্রথা ছিল। আমেরিকার রাজনীতিতে আজও বর্ণবাদ একটি প্রধান ফ্যাক্টর হিসেবে রয়ে গেছে।

বিদেশি নীতিতে উদার মূল্যবোধকে কীভাবে উন্নীত করতে হয় তা নিয়েও ভিন্নতা রয়েছে আমেরিকানদের মধ্যে। কারো কারো কাছে সার্বজনীনতাবাদী প্রকল্পটি অন্য দেশে আগ্রাসন চালানো ও বন্ধুত্বপূর্ণ শাসন ব্যবস্থা আরোপের একটি অজুহাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেক্সিকো, হাইতি ও ফিলিপাইনের মতো জায়গায় মার্কিন হস্তক্ষেপে বর্ণবাদ নিঃসন্দেহে ভূমিকা পালন করেছে। তবে অন্যদের জন্য উদারতাবাদ ছিল আন্তর্জাতিক আইন ও প্রতিষ্ঠানের একটি ব্যবস্থা তৈরির প্রেরণা যা আন্তর্জাতিক নৈরাজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে দেশীয় স্বাধীনতা রক্ষা করে।

আমেরিকান ব্যতিক্রমবাদের দ্বিতীয় ধাপ দেশটির পিউরিটান ধর্মীয় শিকড় থেকে উদ্ভূত। যারা নতুন দুনিয়ায় ঈশ্বরের উপাসনা করার জন্য ব্রিটেন থেকে পালিয়ে গিয়েছিল এবং নিজেদেরকে মনোনিত বান্দা হিসেবে জাহির করেছিল। তাদের এই পরিকল্পনা আমেরিকাকে মানুষের মধ্যে স্বপ্নের শহর হিসেবে আকৃষ্ট করাতে সফল হয়েছে।

তবে প্রতিষ্ঠাতারা নিজেরাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েছিলেন যে নতুন প্রজাতন্ত্র তার গুণ হারিয়েছে, যেমনটি রোমান প্রজাতন্ত্রে ঘটেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে অ্যালেক্সিস ডি টোকভিল ও চার্লস ডিকেন্সের মতো বৈচিত্র্যময় ইউরোপীয় পর্যটকরা পুণ্য, অগ্রগতি ও পতনসহ আমেরিকান আবেশ লক্ষ্য করেছেন। কিন্তু এই নৈতিক উদ্বেগ বাহ্যিকের চেয়ে অভ্যন্তরীণই ছিল বেশি।

আমেরিকান ব্যতিক্রমবাদের তৃতীয় উৎস অন্যদের মধ্যে অন্তর্নিহিত। আমেরিকার নিছক আকার ও অবস্থান সর্বদা একটি ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা প্রদান করেছে। ইতিমধ্যে উনিশ শতকে ডি টোকভিল আমেরিকার বিশেষ ভৌগলিক পরিস্থিতি উল্লেখ করেছেন। দুটি মহাসাগর দিয়ে সুরক্ষিত ও দুর্বল প্রতিবেশী দিয়ে ঘেরা দেশটি পুরো ঊনবিংশ শতাব্দীতে বৈশ্বিক ক্ষমতার জন্য ইউরোপ-কেন্দ্রিক লড়াই এড়িয়ে পশ্চিমমুখী সম্প্রসারণের ওপর লক্ষ্য স্থির রাখতে সক্ষম হয়েছিল।

কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে আবির্ভূত হয়, তখন দেশটি বৈশ্বিক শক্তির আলোকে নিজেকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে। সর্বোপরি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও যথেষ্ট সুযোগ, সবই ছিল নিজেকে ভাল ও মন্দ উভয়ভাবে নিজেকে গঠন করার। বিশ্বব্যাপী জনসাধারণের পণ্য তৈরিতে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রণোদনা ও ক্ষমতার পাশাপাশি নিজেদের জাতীয় স্বার্থকে বিস্তৃত উপায়ে সংজ্ঞায়িত করার স্বাধীনতাও ছিল আমেরিকার। যার মানে একটি উন্মুক্ত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থা, সমুদ্র পথে নিরাপত্তা, অন্যান্য বিষয়ে স্বাধীনতা ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের বিকাশকে সমর্থন করার সক্ষমতা তার ছিল। ভৌগলিগ আকার আমেরিকান ব্যতিক্রমবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তববাদী ভিত্তি তৈরি করে।

বিচ্ছিন্নতাবাদ ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্যের আমেরিকার জবাব। তুলনামূলকভাবে দুর্বল আমেরিকান প্রজাতন্ত্র তার ছোট প্রতিবেশীর প্রতি সাম্রাজ্যবাদী হতে পারে, তবে তাকে ইউরোপীয় শক্তির বিপরীতে সতর্কতার সঙ্গে বাস্তববাদী নীতি অনুসরণ করতে হয়েছিল। যদিও মনরো মতবাদ পশ্চিম গোলার্ধ ও ইউরোপীয় ভারসাম্যের মধ্যে বিচ্ছেদে জোর দিয়েছিল, তবে এই জাতীয় নীতি শুধু ব্রিটিশ স্বার্থ ও রয়্যাল নেভির সমুদ্রের নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে মিলে যাওয়ার কারণেই বজায় রাখা যেতে পারে।

কিন্তু আমেরিকার ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর বিকল্পও বেড়েছে। ১৯১৭ সালে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় আসে যখন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন ঐতিহ্য ভেঙ্গে ইউরোপে যুদ্ধ করতে ২০ লাখ আমেরিকান পাঠান। যদিও যুদ্ধের শেষে উইলসন যে লিবারেল লীগ অব নেশনস তৈরি করেছিলেন তার সহকর্মী আমেরিকানরা তার প্রত্যাখ্যান করেছিল। তবে এই ধারণা নিয়েই ১৯৪৫ সালের পরে জাতিসংঘ ও উদারনীতির ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল।

এখন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন ও বেশিরভাগ ডেমোক্র্যাট বলছেন, তারা বিদ্যমান শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ও সংরক্ষণ করতে চান, যেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও আমেরিকা ফার্স্টার্স গ্রুপ এটি মনোভাব পরিত্যাগ করতে চান। ইউরোপ, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সংঘাত আগামী বছরের নির্বাচনে যে কোনো পদ্ধতিতেই হোক দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত হবে।

লেখক: জোসেফ এস নাই জুনিয়র, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সাবেক মার্কিন সহকারি প্রতিরক্ষা সচিব। প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে অনূদিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *