অনলাইন ডেস্ক
হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হয়েছেন ইরানের কট্টরপন্থি প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরিচিত ইব্রাহিম রাইসি। রোববার ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় এক পার্বত্য অঞ্চলে প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আব্দুল্লাহিয়ানসহ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে বহনকারী হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়। রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের ঘটনা ব্যাপক জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত এ দুর্ঘটনা ঘিরে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।
দুর্ঘটনায় দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ঘনিষ্ঠ এই নেতা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আব্দুল্লাহিয়ানসহ কয়েকজনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছে ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম।
প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসি ও তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমির আবদুল্লাহিয়ানসহ সঙ্গীরা হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার সঙ্গে ইসরাইল জড়িত নয়। দেশটির কর্মকর্তারা মিডিয়াকে এ কথা বলেছেন। যদিও দেশটির সরকারি ব্যাখ্যায় এখন পর্যন্ত বৈরী আবহাওয়া পরিস্থিতির কারণে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানানো হচ্ছে। ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম বলছে, ভারি বৃষ্টিপাত আর ঘন কুয়াশার কারণে ফ্লাইটের দৃষ্টিসীমায় ব্যাঘাত ঘটেছে।
এ দুর্ঘটনায় শত্রুপক্ষের জড়িত থাকার সম্ভাবনা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রেসিডেন্ট রাইসির মেয়াদ ও ইরানের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক চ্যালেঞ্জের পরিপ্রেক্ষিতে দেশীয় শত্রু, এমনকি ইসরাইলের মতো বহিরাগত ক্রীড়নকদের সম্ভাব্য জড়িত থাকার বিষয়েও আলাপ চলছে।
১৯৮৮ সালে ইরানে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর ও পরবর্তীতে দেশটির পারমাণবিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন ইব্রাহিম রাইসি। তার নেতৃত্বেই ইরানের সামরিক বাহিনী কিছুদিন আগে আঞ্চলিক চিরবৈরী ইসরায়েলের ভূখণ্ডে শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়।
ব্রিটিশ প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরান এবং ইসরাইলের ঐতিহাসিক বৈরী সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে এই হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার পেছনে ইসরাইল জড়িত থাকতে পারে বলে কিছু ইরানি সন্দেহ করছেন। দামেস্কে ইসরাইলের একজন ইরানি জেনারেলকে হত্যা ও পরবর্তীতে ইসরাইলে ইরানের শত শত ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের ঘটনায় সৃষ্ট সাম্প্রতিক উত্তেজনা বিবেচনায় এ তত্ত্বটি অনেকের মনোযোগ কেড়েছে।
ইরানের স্বার্থের বিরুদ্ধে চোরাগোপ্তা এবং নিখুঁত অভিযান চালানোর জন্য ইসরাইলের দুর্র্ধষ গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ব্যাপক পরিচিতি আছে। যদিও ইসরাইলি এই গোয়েন্দা সংস্থা কখনই কোনো রাষ্ট্রের প্রধানকে লক্ষ্যবস্তু বানায়নি। তবে বিশেষজ্ঞরা রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের ঘটনায় সন্দেহবাদীদের ইসরাইলি সংশ্লিষ্টতার তত্ত্ব নাকচ করে দিয়েছেন।
তারা বলেছেন, ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টকে হত্যার ঘটনা সরাসরি যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটাবে। এমনকি ইরানের পক্ষ থেকে নজিরবিহীন প্রতিক্রিয়া আসবে। যদিও ঐতিহ্য বিবেচনায় ইসরাইলের কৌশলগত অবস্থান উচ্চ-পর্যায়ের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের পরিবর্তে সামরিক এবং পারমাণবিক লক্ষ্যবস্তুতেই রয়েছে। ইকোনমিস্ট বলছে, রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইসরেইলের জড়িত থাকার বিষয়ে সন্দেহ করার জোরালো কারণ রয়েছে। ইসরাইল কখনো কোনো রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করার মতো এতদূর অগ্রসর হয়নি। এর অর্থ হবে দ্ব্যর্থহীন যুদ্ধ; যা ইরানের তীব্র প্রতিক্রিয়া উসকে দেবে।
ইরানে হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের এ ঘটনা এমন এক সময় ঘটেছে যখন আঞ্চলিক উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তোলার মতো অনেক বিষয় রয়েছে। লেবানন, সিরিয়া, ইরাক এবং ইয়েমেনজুড়ে ইরানের প্রক্সি নেটওয়ার্ক ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে। বিশেষ করে ইসরাইল এবং হামাসের চলমান যুদ্ধের মাঝে আঞ্চলিক এ পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ এক প্রান্তে পৌঁছেছে। ইরানের নেতৃত্ব নিয়ে যেকোনো ধরনের অস্থিতিশীলতা তৈরি হলে তা এসব গোষ্ঠীকে সম্ভাব্য বিস্তৃত সংঘাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
ঘটনার পর ইরানের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে ইসরাইল। বিশ্বনেতারা তাদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে প্রতিক্রিয়া দিলেও এমন অবস্থান নিয়েছে অল্প দুই-চারটি দেশ। ইসরাইল দেখছে, এ ঘটনায় ইসরাইলকে জড়িয়ে কোনো বক্তব্য বা ইঙ্গিত দেওয়া হয় কিনা। অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যুর জন্য ইসরাইলকে দায়ী করা হয় কিনা। যদি এমন অভিযোগ তোলা হয়, তবে তা সন্দেহজনক বা সত্য, যা-ই হোক না কেন তাতে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে সংকট ঘনীভূত হতে পারে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ইরানের পক্ষ থেকে এমন কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি। এমনকি সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এমন ঘটনার নেপথ্যের কারণও জানায়নি।
ইসরাইল কর্মকর্তারা স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোকে বলেছেন, ইরানি প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে তাদের কোনো হাত নেই। মাত্র এক মাস আগে দুই দেশের মধ্যকার দীর্ঘদিনের ছায়াযুদ্ধ প্রকাশ্যে আসে। পাল্টাপাল্টি হামলা হয়। তারপর দৃশ্যত পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। তখন থেকে অস্বস্তিকর অবস্থার ইতি ঘটেছে বলেই মনে হয়; কিন্তু গাজা যুদ্ধে হামাস ও হিজবুল্লাহকে ইরান সমর্থন দিচ্ছে ইসরাইলের এই পুরোনো অভিযোগ সামনে চলে এসেছে। ফলে উপরে উপরে পরিস্থিতি শান্ত মনে হলেও ভিতরে ভিতরে দুইপক্ষের মধ্যেই চাপ বিরাজ করছে।
সূত্র: বিবিসি নিউজ।