রাজন ভট্টাচার্য
দেশে গত বছর দানাদার খাদ্য উৎপাদনে রেকর্ড হয়েছে। ধান, গম, ভুট্টা মিলিয়ে মোট উৎপাদন হয়েছে ৬ লাখ ৪৩ হাজার টন। গত এপ্রিল থেকে চলতি জুন পর্যন্ত প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগ সত্তে¡ও এ বছর খাদ্য উৎপাদন আরও বাড়তে পারে।
বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন বিষয়ে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্কার (এফএও) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ৫ জুন সংস্থাটির প্রধান কার্যালয় ইতালির রোম থেকে ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে দেশের খাদ্য নিয়ে একটি সংকটের দিকও তুলে ধরা হয়েছে। দুই বছরে দেশে প্রয়োজনীয় খাদ্যের আমদানি কমেছে। সামগ্রিকভাবে দেশে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ৯ লাখ।
এফএও-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে যে ৬ কোটি ৪৩ লাখ টন দানাদার খাদ্য উৎপাদিত হয়েছে, এর মধ্যে শুধু ধান ৫ কোটি ৮৬ লাখ টন। ভুট্টা ৪৭ লাখ টন। আর গম উৎপাদিত হয়েছে ১১ লাখ টন, যা দেশে মোট দানাদার খাদ্য উৎপাদনে রেকর্ড।
সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ৬ কোটি ৯ লাখ ২১ হাজার টন দানাদার খাদ্য উৎপাদিত হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে ৬ কোটি ৩১ লাখ ৩০ হাজার টন হয়েছে।
দেশে দ্রুত জনসংখ্যা বাড়ছে। বসতি স্থাপন, উন্নয়ন-সহ নানা কারণে কমছে কৃষিজমি। এর মধ্যেই দ্রুত উৎপাদন বেড়েছে। এর বড়ো কারণ হলো, টেকসই কৃষি উন্নয়ন। মানুষ বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। মানুষ যত বাড়বে, তত খাদ্যচাহিদা দেখা দেবে। এজন্য এক জায়গায় তো হাত গুটিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছাড়া পৃথিবীর কোনো দেশই এ ধরনেই বাস্তবতা মোকাবিলা করতে পারে না। আয়তনের দিক থেকে ছোট্ট হওয়ায় বাংলাদেশের জন্য খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি আরও চ্যালেঞ্জ। তাই টেকসই কৃষি উৎপাদনশীলতার সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হলেই খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।
সরকারের পক্ষ থেকে খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি অনেক গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়; এর বড়ো প্রমাণ হলো এখন কৃষি নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে। শুধু শস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে তা নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও এগিয়ে।যেমন: মাছ, সবজি, ফল-সহ সব ধরনের কৃষিপণ্য। সবচেয়ে বড়ো বিষয় হলো, উৎপাদন বাড়তে নিয়মিত গবেষণাও হচ্ছে। প্রতিবছর ভরতুকি ও বাজেট বাড়ছে।
সম্প্রতি বিশিষ্ট জিন বিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী একটি নতুন জাতের ধানগাছ উদ্ভাবন করেছেন, যা একবার রোপণে বিভিন্ন মৌসুমে পাঁচবার ধান দেবে। বাংলাদেশের জন্য এটা অনেক বড়ো খবর। এরকম গবেষণা চললে বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে খুব বেশি সময় লাগবে না।
১৯৭২ সালে দেশের খাদ্য উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন। তখন মানুষ ছিল সাড়ে ৭ কোটি। দেশের এখন মানুষ ১৭ কোটির বেশি। এর মধ্যে আবাদি জমি কমেছে ৩০ শতাংশের বেশি। এর মধ্যেও ১২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে রয়েছে। সব মিলিয়ে খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়ানোর গতিতে বিশে^র মধ্যে শীর্ষস্থানীয় তালিকায় এখন বাংলাদেশের অবস্থান। বর্তমানে দেশে খাদ্য ঘাটতির হার নেমে এসেছে ১৫ শতাংশেরও নিচে। খাদ্য উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৬০ লাখ টনের ওপরে। গত ৫২ বছরে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে প্রতিবছর গড়ে তিন থেকে পাঁচগুণ।
কৃষি খাত বলতে শস্য, মৎস্য, বন ও পশুপাখি উপখাতগুলোকে সমন্বিতভাবে বোঝায়। বর্তমানে দেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১২ শতাংশ। মোট রপ্তানিতে কৃষিজাত পণ্যের শরিকানা প্রায় ৩ শতাংশ। এর সঙ্গে হিমায়িত মৎস্য ও পাটজাত দ্রব্য যোগ করা হলে মোট রপ্তানিতে কৃষির হিস্যা প্রায় ৭ শতাংশে বৃদ্ধি পায়। দেশের শতকরা ৪০ ভাগ শ্রমিক কৃষি খাতে নিয়োজিত। শিল্প ও সেবা খাতের অগ্রগতিও বহুলাংশে নির্ভরশীল কৃষি খাতের অগ্রগতির ওপর। ফলে দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কৃষি খাতের উন্নয়ন একান্তভাবে প্রয়োজন।
বর্তমানে চাল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থানন তৃতীয়। বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নে বাংলাদেশের স্থান হলো সবার ওপরে। তাছাড়া পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়। চাষকৃত মৎস্য উৎপাদনে দ্বিতীয়, গম উৎপাদনে সপ্তম এবং আলু উৎপাদনে অষ্টম বলে বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়।
স্বাধীনতার পর থেকে এ নাগাদ চালের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চারগুণ, গম দ্বিগুণ, ভুট্টা ১০ গুণ এবং সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচগুণ। আলু, মৎস্য, মাংস ও ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশ উদ্বৃত্ত। চিরকালের দুর্ভিক্ষ, মঙ্গা আর ক্ষুধার দেশে এখন ঈর্ষণীয় উন্নতি হয়েছে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে। প্রতিবছর এ দেশে মানুষ বাড়ছে ২০ লাখ। কৃষিজমি কমছে ৮ লাখ হেক্টর। তারপরও জনপ্রতি সরবরাহ কমছে না কৃষিপণ্যের। বরং তা বাড়ছে নিরন্তর। এ সফলতা অব্যাহত রাখতে হবে।
এর কারণ দ্রæত অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি। স¤প্রতি নতুন প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে কৃষি খাতে। এখন পুরো কৃষিব্যবস্থা পরিণত হয়েছে বাণিজ্যিক কৃষিতে। এক নীরব বিপ্লব সূচিত হয়েছে কৃষির সব স্তরে।
সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে সর্বো”চ অগ্রাধিকার খাত হিসাবে চিহ্নিত করেছে কৃষি খাতকে। ২০০৮-০৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে শুধু সারেই ভরতুকি দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ১৯ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা। পানি সেচের জন্য ব্যবহৃত বিদ্যুতের ওপর চালু করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভরতুকি। ৫০ শতাংশ (ক্ষেত্রবিশেষে ৭০ শতাংশ) ভরতুকি মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়েছে কৃষি যন্ত্রপাতি। মোট বাজেটের প্রায় ২ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে কৃষি ভরতুকি খাতে। দ্রুত হ্রাস করা হয়েছে কৃষিঋণের সুদের হার। এখন কৃষিঋণের সর্বো”চ সুদের হার ৯ শতাংশ। মসলাজাতীয় ফসলের জন্য তা ৪ শতাংশ। দুগ্ধ খামার করার জন্য ৫ শতাংশ। পানি সেচের আওতা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে মোট আবাদি জমির ৭৪ শতাংশে। উ”চফলনশীল জাতের আওতায় এসেছে ৮৫ শতাংশ ধানি জমি। ফলে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে খাদ্যশস্যের উৎপাদন। ত্বরান্বিত হয়েছে খাদ্যনিরাপত্তা।
খাদ্যশস্যের আরেকটি বড়ো সাফল্য অর্জিত হয়েছে সবজি উৎপাদনে। ২০০৮-০৯ থেকে ২০২০-২১ সাল পর্যন্ত সবজি উৎপাদন প্রতিবছর গড়ে ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১০ সালে পাটের জিনরহস্য উন্মোচনের ফলে এর উৎপাদন বৃদ্ধির পথ আরও সুগম হয়েছে। বিশ্ববাজারে এখন পাটের চাহিদা বাড়ছে। বৃদ্ধি পা”েছ পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে আহরিত বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ। এখন দেশে কৃষকের খামার প্রান্তে কাঁচা পাটের মূল্য ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা প্রতি মন। বর্তমানে দেশে পাটের উৎপাদন ৭৫ থেকে ৮৫ লাখ বেল।
কেবল শস্য খাতই নয়, স¤প্রতি বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভর বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ২০০৭-০৮ সালে এ দেশে মাছের মোট উৎপাদন ছিল ২৫ লাখ টন। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৭ লাখ টনে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আহরিত মাছের পরিমাণ প্রায় ৮৫ শতাংশ এবং সামুদ্রিক জলসম্পদ থেকে প্রাপ্ত মাছের হিস্যা মাত্র ১৫ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়ের মৎস্য উৎপাদনে দ্রæত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছে উন্নত পদ্ধতিতে মাছ চাষের জন্য।
পুষ্টির অন্যান্য উপাদান ডিম, দুধ ও মাংস উৎপাদনেও গতি বেড়েছে। দুগ্ধ উৎপাদনে এখনো ঘাটতি আছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। কৃষির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপখাত বন। সাত শতাংশ থেকে বনভ‚মি বেড়েছে ১৭.৪৫ শতাংশে।
কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহার এখন অনেক এগিয়েছে। এখন ৯৫ শতাংশই আবাদ হ”েছ যন্ত্রপাতির মাধ্যমে। কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহার দ্রæত স¤প্রসারিত করতে স¤প্রতি ৩ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে গ্রহণ করা হয়েছে ‘সমন্বিত ব্যব¯’াপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প’।
সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে স্থায়িত্বশীল বা টেকসই কৃষি উন্নয়নের ওপর। কারণ, কৃষি উৎপাদনের প্রধান তিনটি উপকরণ মাটি, পানি ও বায়ু। ভবিষ্যতে দ্রুত বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার জন্য অনেক পরিমাণে খাদ্য উৎপাদন করতে হবে। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজনীয় জমি ও পানির অভাব দারুণভাবে মোকাবিলা করতে হবে। জলবায়ুর উষ্ণায়ন এই চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। কৃষির উৎপাদনে তা এক মারাত্মক প্রতিবন্ধক হিসাবে কাজ করবে।
এ কারণে ভবিষ্যতের জন্য টেকসই উৎপাদনব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা ভাবা হচ্ছে। মোট কথা, টেকসই কৃষিব্যবস্থা বলতে এমন পরিবেশবান্ধব কৃষি কার্যক্রমকে বোঝায়, যা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রাকৃতিক সম্পদ অক্ষুণ্ণ রেখে মানুষের উৎপাদন চাহিদা মিটিয়ে যেতে সক্ষম হবে। তাতে পরিবেশ অক্ষুণ্ণ থাকার পাশাপাশি মানুষ ও প্রাণিসম্পদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
টেকসই কৃষি উন্নয়নের একটি প্রধান লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধা নির্মূল এবং সবার জন্য খাদ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা। বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের জন্য খাদ্য ও পুষ্টির সরবরাহ নিশ্চিত করা টেকসই কৃষি উন্নয়নের আরেকটি প্রধান লক্ষ্য। তাছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে খাদ্যের উৎপাদন দ্বিগুণ করা এবং বৈরী আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মতো কৃষি উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে দায়িত্বশীল কৃষিব্যবস্থার প্রবর্তন করা এর অপর একটি লক্ষ্য। অন্যান্য লক্ষ্যের মধ্যে আছে কৃষিজমিতে সবার অভিগম্যতা ও এর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা, শস্য ও প্রাণিসম্পদের জীববৈচিত্র্য অক্ষুণ্ণ রাখা, বাণিজ্যের প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করা এবং কৃষি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো প্রভৃতি।
বাস্তবতা হলো, খাদ্যনিরাপত্তা অর্জন ও সবার জন্য খাদ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হলে এবং তা টেকসই করতে এ প্রবৃদ্ধির হার আরও গতিশীল করতে হবে। এ কারণে কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার। জাতীয় বাজেটে কৃষি খাতের হিস্যা বাড়াতে হবে। তাছাড়া কৃষি পণ্যের প্রক্রিয়াজাত শিল্পস্থাপনে এবং এর বিপণনে বিশেষ সহায়তা জরুরি। কৃষি উন্নয়ন কার্যক্রমকে চিহ্নিত করতে হবে সর্বো”চ অগ্রাধিকারের খাত হিসাবে। এর মধ্য দিয়েই টেকসই কৃষি উৎপাদনশীলতা ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে এটা হবে টেকসই কৃষি উন্নয়নের সবচেয়ে বড়ো মাইলফলক।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট