যানজটের উৎস ও প্রতিকার: প্রেক্ষিত সাভার

খোলা কলাম পরিবহণ-পর্যটন ও যোগাযোগ

ম ই খান সাজু

সাভারের গেন্ডা, পাকিজা এবং রেডিও কলোনি এলাকায় প্রায়শই দেখা যায় যানবাহনের জটলা। যার কারণে বাড়তি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে উক্ত এলাকায় বসবাসরত সাধারণ মানুষকে। এই জটলার উৎস কি? এবং কেন এই বাড়তি ভোগান্তি?
বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম কিছুদিন ধরে। এই পয়েন্টগুলোতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিংবা বিভিন্ন যানবাহনে যাতায়াতের সময় পর্যবেক্ষণ করে যা বুঝলাম – তা আপনাদের সাথে শেয়ার করছি।
* যানজটের উৎস হচ্ছে –
১. যানবাহনের চালকগণ রাস্তায় চলাচলের নীতিমালা মেনে না চলা।
২. অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে যাওয়া অটোরিক্সার হাইওয়েতে অপরিকল্পিত চলাচল এবং একই পথে বেপরোয়া ভাবে উর্ধ্বমুখী এবং নিম্নমুখী চলাচল।
৩. লোকাল বাস সমূহ সার্ভিস লাইনে চলাচল না করে এক্সপ্রেস রুট দিয়ে চলাচল করা।
প্রথম দুটি কারণে যে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে তা আপনারা সহজেই বুঝতে পারছেন এবং ভুক্তভুগী হয়ে যন্ত্রণাও সহ্য করতেছেন বটে। তৃতীয় কারণটি কতো মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে – তা নিয়েই আজকের আলোচনা।
এটি প্রতীয়মান যে আমাদের মহাসড়কটি দুইটি ভাগে বিভক্ত। এক্সপ্রেস লাইন ও সার্ভিস লাইন। এক্সপ্রেস লাইন তৈরি করা হয়েছে দুরপাল্লার তথা সরাসরি যাতায়াতের যানবাহন চলাচলের জন্য। আর সার্ভিস লাইন দিয়ে চলবে লোকাল গাড়িগুলো। কিন্তু বাস্তবতায় আমরা দেখতে পাচ্ছি – লোকাল গাড়ি ও দূরপাল্লার গাড়ি সবসময় এক্সপ্রেস লাইন দিয়ে চলাচল করছে। শুধু তা-ই নয়, লোকাল গাড়ি ও দূরপাল্লার গাড়ি এক্সপ্রেস লাইন দিয়ে এসে ইউলুপের (ইউ টার্ন) মাথায় দেদারসে যাত্রী ওঠানামা করাচ্ছে। আর এই সকল যাত্রীকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার জন্য রিক্সা, অটোরিক্সা গুলোও ইউলুপ এলাকায় এসেই ভীড় জমায় বলেই যানজট ও দুর্ভোগের উৎপত্তি হয়। লোকাল বাসগুলো তাদের জন্য নির্ধারিত সার্ভিস লাইন দিয়ে চলাচল করলে এবং ফুটওভার ব্রিজের গোড়ায় গোড়ায় যাত্রী উঠা-নামা করালে উল্লেখিত ইউলুপ বা ইউটার্ন এলাকার যানজট কমে যেতো এবং দুর্ভোগ ও হয়রানির হাত থেকে রক্ষা পেতো লোকাল যাত্রীরাও।
* লোকাল বাসের যাত্রী কারা?
আমরা জানি যে মধ্যবিত্ত ও নিন্ম আয়ের লোকজনই হচ্ছে লোকাল বাসের যাত্রী। এই সকল যাত্রীরা বাস ভাড়া দেয়ার পর আরো বাড়তি টাকা গুণতে হয় রিক্সা বা অটো রিক্সা ভাড়া করে নিজ নিজ গন্তব্যে যাওয়ার জন্য। দুইটা উদাহরণের মাধ্যমে বাড়তি খরচ ও দুর্ভোগের বিষয়টিকে আরেকটু পরিষ্কার করার চেষ্টা করছি –
ক) আমার বাসা সাভার থানা রোডে। আমি একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। নবীনগর বা ঢাকা যেতে হলে আমাকে লোকাল বাস ব্যবহার করতে হয়। বাসার সামনে থেকে দশ টাকা অটো বা রিক্সা ভাড়া দিয়ে থানা রোডের মাথা থেকে আমি সহজে গাড়িতে উঠতে পারতাম। ফুটওভার ব্রিজের এ’পাশ থেকে নবীনগর, চন্দ্রা কিংবা মানিকগঞ্জ; আর ওপার থেকে ঢাকা শহর। কিন্তু, লোকাল বাস সার্ভিস লাইন দিয়ে না চলার কারণে ২০/৩০ টাকা অটো বা রিক্সা ভাড়া দিয়ে আমাকে পাকিজার মোড়ে যেতে হয়। থানা রোড থেকে রিক্সা মেইন রাস্তা দিয়ে, যে’রাস্তায় অটোরিক্সা চলার কথা নয়, পাকিজার মোড়ে যায়। আবার পাকিজা থেকে থানা রোডে ফিরিতে ঐ পথটুকু উলটা আসতে হয়। প্রয়োজনের তাগিদে রিক্সাচালকের এই ভুল কাজটিকে আমরা সমর্থন করি। আমার মত যারা এই ভোগান্তি পোহান – তারাই একটু ভাবুন- এভাবেই চলতে থাকলে ভবিষ্যৎটা কত ভয়ানক হতে পারে?
খ) এক অসহায় দরিদ্র পিতা-মাতা তাদের বিকলাঙ্গ সন্তানের চিকিৎসার জন্য ঢাকা থেকে সাভারস্থ সিআরপি যাচ্ছিলেন। গাড়ি সার্ভিস লাইন দিয়ে না চলার কারণে তাদেরকে রেডিও কলোনির ইউলুপের মুখে নামতে হয়। এর আগের স্টপেজ হচ্ছে পাকিজার মোড়। মাঝখানে আর কোন অপশন না থাকায় এই অসুস্থ ছেলেটিকে নিয়ে তারা অটোরিকশা করে রেডিও কলোনি থেকে আরেকটু এগিয়ে ইউলুপ ঘুরে সিআরপি যেতে ভোগান্তির সাথে ৪০/৫০ টাকা গাড়ি ভাড়া যোগ করতে হয়েছে। অথচ গাড়িটি সার্ভিস লাইন দিয়ে গেলে এই দরিদ্র পিতা-মাতা তার সন্তানকে নিয়ে সিআরপির সম্মুখস্থ সিস্টেম করা ফুট ওভার ব্রিজ দিয়ে অল্প খরচে সহজ ও নিরাপদে সিআরপি হাসপাতাল পৌঁছাতে পারতো।
একটু চোখ বুলালেই এরকম হাজারো উদাহরণ আপনারা পাবেন। শুধুমাত্র সভারবাসিই নয়, আমার বিশ্বাস- বাংলাদেশের আরও বিভিন্ন অঞ্চল, যেখানে যেখানে হাইওয়েগুলো এক্সপ্রেস লাইন আর সার্ভিস লাইনে ভাগ করা হয়েছে, সেখানকার লোকজনকেও এরকম ভোগান্তিসহ বাড়তি টাকা গুণতে হচ্ছে দিনের পর দিন।

এই অবস্থার নিরসন করতে হলে সর্বশ্রেণীর জনগণের সচেতন হয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতার মাধ্যমে লোকাল বাস গুলোকে সার্ভিস লাইন দিয়ে চলাচলে বাধ্য করতে হবে। এইখানে একটি প্রশ্ন সবার মনে জেগে উঠতে পারে। সাধারণ জনগণ লোকাল বাস ও দূরপাল্লার গাড়ির পার্থক্য বুঝবেন কেমন করে? এই ক্ষেত্রে, প্রশাসনিক সহায়তায়, যে’সব গাড়িকে লোকাল পরিবহন হিসেবে রোড পারমিট দেয়া হয়েছে, সে’সব গাড়ির সম্মুখভাগ বিআরটিআই কর্তৃক অনুমোদিত একটি বিশেষ রং দিয়ে চিহ্নিত করতে হবে। এই চিহ্ন দূর থেকে দেখেই সাধারণ যাত্রীগন খুব সহজেই লোকাল গাঢ়ি ও দূর পাণ্ণার গাড়ির পার্থক্য বুঝতে পারবে। রাতের বেলার জন্য একটি নির্ধারিত রঙিন বাতি ব্যবহার করা যেতে পারে।লোকাল গাড়ি এক্সপ্রেস লাইনে ঢুবলে তাকে জরিমানার আওতায় আনার কাযর্কর আইন থাকতে হবে।যদি কোনো লোকাল গাড়িকে ইউটার্ণ/ ইউলুপের আশপাশে যাত্রী উঠানামা করতে দেখা যায় তার বিরুদ্ধেও জরিমানা আইন কাযর্কর রাখতে হবে।শুধুমাত্র দূর পাল্লার গাড়ি ইউলুপ এলাকায় যাত্রী নামাতে পারবে। মোটকথা,এ ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগ যথার্থ হলে, সম্ভব হলেই ইউলোপ/ ইউটার্ন এলাকা যানজটের কবল থেকে মুক্তি পাবে এবং জনসাধারণের ভোগান্তির মাত্রা অনেকাংশে কমে যাবে।

পাশাপাশি রিক্সা, অটোরিক্সা চালকদের বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পরিবহন ও ট্রাফিপক আইন কানুন এবং নিয়ম শৃঙ্খলা সম্পর্কে  প্রশিক্ষিত চালকে পরিণত করতে হবে।প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের নিবন্ধন করে লাইসেন্স প্রদান করতে হবে। এবং ক্রমাগত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। বেপরোয়াভাবে অটো চালানো এবং আইন অমান্যকারী ড্রাইভারদের জন্য থাকতে হবে শাস্তির ব্যবস্থা।

আমরা যদি ৫ফুট উচ্চতায় এক ফটক তৈরি করি, তবে ৭ফুট উচ্চতার লোককেও মাথা নিচু করে ৫ফুট ফটক দিয়ে ঢুকতে হবে। এমনই হতে হবে আইনের প্রয়োগ। এখানে ফটকহলো আইন- যা, খুব সহজেই পরিবর্তন করা যাবে না।

 

(লেখক পরিচিতি: ম ই খান সাজু , একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা; কবি ও প্রাবন্ধিক)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *