যেভাবে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস হল

জাতীয়

যেভাবে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস হল

শাওন মাহমুদ

পৃথিবীর সবচেয়ে তীব্র এবং অকৃত্রিম ভালোবাসার বিষয় হচ্ছে মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা। বাঙালি জাতি মাতৃ ভাষা ও মাতৃ ভূমির জন্য সেই ভালোবাসার প্রমাণ দিয়েছে নিজেদের জান উৎসর্গ করে। পৃথিবীর অনেক জাতির চেয়ে তাই আমরা গর্বিত জাতি। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের আত্মত্যাগ, অবিশ্বাস্য সাহস ও বীরত্বের সেই গৌরব গাঁথা একদিনের ঘটনা নয়। এর পিছনে রয়েছে জাতিকে শোষণ নিপিড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে এক জাতি হিসেবে গড়েতোলার ইতিহাস।যার জন্য প্রয়োজন পড়ে একজন বিচক্ষণ মেন্টর বা নেতার।বাঙালি জাতি সৌভাগ্যবান এই জণ্যে যে, সহস্র বৎসরের ইতিহাসে তেমনই একজন

শ্রেষ্ঠ বাঙালির জন্ম হয়েছিলো আমাদের এই ভূমিতে। যার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বৃটিশদের প্রায় দুইশত বছরের শোষনের নাগপাশ ছিঁড়তে এ অঞ্চলের াসংখ্য মানুষের জবিন বিসর্জন দিতে হয়েছে।অসংখ্য মানুষ জেল খেটেছে, দ্বীপান্তর হয়েছে। ১৯৪০ সালে ‘লাহোর প্রস্তাব’-এ ঠিক করা হয়েছিল ভারতবর্ষের যে অঞ্চল সমূহে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ সেরকম দুটি অঞ্চল নিয়ে পৃথক দুটি দেশ হবে এবং বাকি অঞ্চল নিয়ে আরেকটি দেশ হবে।১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দুটি অঞ্চল নিয়ে  দুটি রাষ্ট্র নাহয়ে পাকিস্তান নাম নিয়ে একটা দেশ এবং বাকি অঞ্চল নিয়ে ১৫ আগস্ট ভারত নামে আরেকটি দেশ গঠিত হল।

সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমানদের দুই অংশের দুরত্ব প্রায় দুহাজার কিলোমিটার! দুই অংশের মানুষের চেহারা,সংস্কৃতি ,ভাষা, ঐতিহ্য কোনো কিছুরই শিল ছিলনা।অথচ শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মের মিলের ভিত্তিতে পূর্ব ও পশ্চিম পকিস্তান নাম নিয়ে গঠিত হয়েছিলো পাকিস্তান।পূর্বের জনসংখ্যা ছিলো্ চার কোটি এবং পশ্চিমের ২কোটি।অথচ, চাকরিবাকরিতে পশ্চিমের নিয়োগ থাকতো পূর্বের দ্বিগুণেরও বেশি প্রায় ৮০ শতাংশ। বাজেটের ৭৫ ভাগ ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানে, পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় হতো মাত্র ২৫শতাংশ।অথচ, রাজস্ব আয়ের ৬২ ভাগ আসতো পূর্ব পাকিস্তান হতে।সবচেয়ে ভয়ংকর ছিলো সেনাবাহিনীর সংখ্যা।পূর্বাংশের তুলনায় পশ্চিমের সৈন্য সংখ্যা ছিলো ২৫গুণ!

১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্ম এবং ১৯৪৮ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে ঘোষণা করেন উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।এই ঘোষণার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিবাদ করা হয়।১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি সারা দেশের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।গুলিতে প্রাণ দিলেন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার এবং আরো অনেকে।তারপরও আন্দোলন থেমে থাকেনি।। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালে বাঙলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়্।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই সেনাবাহিনী দেশ নিয়ে নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র শুরু করে। দেশের বাজেটের ৬০ ভাগ ব্যয় করা হতো

সেনাবাহিনীর পক্ষে।তাই তারা নিজেদের স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে কষমতা বেসামরিক নেতৃত্বের হাতে ছেড়ে দিতে রাজি ছিলো না। ১৯৫৮ সালে  পাকিস্তানের সেনা প্রধান আ্য়ূব খান পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করে এগারো বছর কষমতায় ছিলেন। একদিকে দেশে সামরিক শাসন।অপর দিকে বাঙালির বঞ্চনা। বাঙালির সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামীলগের তেজস্বী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্বপাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্বশাসন দাবি করে ১৯৬৬ সালে ৬দফা ঘোষণা করলেন।এই দাবি করার  সাথে সাথেই আওয়ামীলীগের ছোট বড় সব নেতাকে গ্রেপ্তার করে ছেলে পুরা হচ্ছিল।বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে দেশদ্রোহিতার একটি মামলার প্রধান আসামি করা হয়ে ছিলো।জেল জুলুম অত্যাচারকে উপেক্ষা করে মানুষ আন্দোলনকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে তোলো ১৯৬৯ সালে প্রাণ দিয়েছিলো কিশোর আসাদ। তারিখটি ছিলো ১৯৬৯ এর ২৫ মার্চ।দুবছর পর ঠিক এই দিনেই দেশের মাটিতে ঘটেছিল পৃথিবীর জঘণ্যতম গণহত্যা।

১৯৭০ সালের ৭ ড়িসেম্বর অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের অবিশ্বাস্য ফলাফলে সামরিক বাহিনীর জেনারেলদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।পাকিস্তানের ৩১৩টি আসনের মাঝে পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগ ১৬৭টি, পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর দল পিপলস পার্টি ৮৮টি এবং অন্যান্য সব দল মিলে পেয়েছিলো ৫৮টি।পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০টি পেয়ে ছিল আওয়ামী লীগ।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জেনারেলদের সঙ্গে আয়ূব খানের একসময়ের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ষড়যন্ত্র শুরু করে।ভেতরে ভেতরে ষড়যন্ত্র চালাতে থাকলেও ১৩ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করল ৩ মার্চ  জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হবে।

১৯৭১ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে বাঙালিদের উদ্দিপনা দেখে ১মার্চ জেনারেল ইয়াহিযা জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। এই ঘোষনার সাথে সাথে মানুষ তীব্র কেষাভে রাস্তায় নেমে আসেন।ঐ দিন ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের সাথে কমনওয়েলথ একাদশের খেলা চলছিলো।মুহূর্তে ঢাকা স্টেডিয়াম হয়ে ওঠে যুদ্ধক্ষেত্র। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, দোকান-পাট সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়।পুরো ঢাকা শহর পরিনত হয় মিছিলের নগরীতে। মানুষের মুখে উচ্চারিত হতে থাকে স্বাধীনতার স্লোগান: ‘জয়বাংলা’ ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’

বঙগবন্ধু ঢাকা সহ সারাদেশে মিলিয়ে ৫ দিনের জন্য হরতাল ও অনির্দিষ্টকালের জন্যে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন।বঙ্গবন্ধুর মুখের একটি কথায় সারা পূর্বপাকিস্তান অচল হয়ে পড়ে।অবস্থা নিয়ন্ত্রনে আনতে সরকার কারফিউ জারী করে। ছাত্র জনতা সেই কারফিউ ভেঙ্গে চার দিকে মিছিল স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে।

২ মার্চ ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলা হলো। ৩রা মার্চ পলাটন ময়দানে ছাত্রলীগের জনসভায় জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গাওয়া হয়।

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণ দিতে এলেন। ততদিনে পুরো পূর্ব পাকিস্তান চলছে বঙ্গবন্ধুর কথায়। পাকিস্তানি মিলিটারির চলাচলে বাধা দিতে  ছাত্র-শ্রমিক-জনতা পথে পথে ব্যারিকেড গড়ে তুলে।৯মার্চ পল্টন ময়দানের জনসভায় মাওলানা ভাসানী বলে দিলেন, পশ্চিমপাকিস্তানিরা যেনো আলাদা করে তাদের শাসনতন্ত্র তৈরি করে।কারণ পূর্ব পাকিস্তানের জনগন একটি স্বাধীন দেশের জন্মদিয়ে নিজেদের শাসনতন্ত্র নিজেরাই তৈরি করে নেবে।

ঠিক এই সময় গণহত্যার নীলনকশা বাস্তবায়ন করতে জেনারেল ইয়াহিয়া বেলুচিস্তানের কসাই খ্যাত জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর করে পাঠাল।পূর্বপাকিস্তানের কোনো বিচার পতি তাকে শপথ পড়াতে রাজি হলেন না।১৫মার্চ ইয়াহিয়া খান নিজে ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার নামে সময় ক্ষেপন করতে থাকে এবং যুদ্ধ জাহাজে করে অস্ত্র ও সৈন্য আনতে থাকে।২১ মার্চ ভুট্টোও এই ষড়যন্ত্রে যোগ দিতে ঢাকায় সদলবলে এসে আলোচনার ভান করতে থাকে।

১৯ মার্চ জয়দেবপুরে(গাজীপুরে)বাঙালি সেনারা বিদ্রোহ করে।তাদের থামাতে ঢাকা থেকে সেনাবাহিনী পাঠানো হয়। তাদের সাথে সাধারণ জনগনের ব্যাপক সংঘর্ষ হয় এবং অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারায়।২৩মার্চ পাকিস্তান দিবসে ক্যান্টনমেন্ট আর গভর্নর হাউজ ছাড়া  সারা বাংলাদেশে কোথাও পাকিস্তানের পতাকা খুঁজে পাওয়া যায়নি।এ দিন বঙ্গবন্ধুর বাসাতেও ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের সাথে সাথে স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলা হলো। ২৪ মার্চ ছিলো থমথমে।২৫শে মার্চ ছিলো এক বিভিষিকাময় দিন।সেদিন তারা ঢাকা শহরকে পরিনত করে ছিলো নরকে।চার দিকে আগুন, গুলি আর নির্বিচারে মানুষ হত্যার মচ্ছব।

এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু ইপিয়ারের ওয়ারলেসেরে মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দেন।

অপারেশন সার্চলাইটের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি কমাণ্ডোদল এসে তাঁকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু আগেই খবর পেয়ে তার দলের নেতাদের সকলকে সরে যেতে  নির্দেশ দিয়ে নিজে বসে রইলেন নিশ্চিত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে।

(তথ্য সূত্র : মুহাম্মদ জাফর ইকবাল সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধের ইুতহাস’)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *