·সুবর্ণবাঙলা ডিজিটাল ডেস্ক
রাজনীতি নিজের প্রতিপত্তি, যশখ্যাতি, অর্থ-বিত্তশালী হওয়ার মোক্ষম হাতিয়ার হলো কেন? দেশে রাজনীতির যে লড়াই চলছে তা দারিদ্র্যতা ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে কি? এই লড়াইয়ে যারাই জিতুক তাতে দারিদ্র্যতা দুর হবে কি? নাকি দরিদ্র বানানোর লড়াই চলতেই থাকবে? জেন-জেড প্রজন্ম কি কোন নতুন বার্তা নিয়ে আসবে?
প্রকৃতপক্ষে পুঁজির অবাধ বাজার অর্থনীতির নয়াউদারতাবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার কুফলই হলো রাজনৈতিক দলগুলোর লুটেরা, মাফিয়া হিসেবে গড়ে ওঠার কারন। সেই সঙ্গে রাজনীতি একটি কর্পোরেট বিজনেজ ও নেতারা কর্পোরেট কর্মকর্তা আর অফিস হলো একেকটি কর্পোরেট হাউজ। আমরা ‘৭১ দেখা ও আত্মত্যাগ মহিমা ও পাক হায়নাদের শাসন শোষণের পরাকাষ্ঠা থেকে জন্ম নেয়া নতুন দেশের অভূত অভ্যুদয় দেখেছিও প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগী হয়েছি। আমার মনে হয় আমাদের দেশের মানুষকে ইতিহাস ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা করলে ভুল হবে।
আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে ঢাকার রাজপথ যখন উত্তপ্ত, অগ্নিগর্ভ, গগনবিদীর্ন শ্লোগাণে ছাত্র-শ্রমিক- জনতার আন্দোলনের গর্ভাবস্থায় আগুনের লেলিহান শিখায় ঝলসেছিল ঢাকানগরী তার উত্তাপ আমরা গ্রামে থেকে ও অনুভব করেছিলাম। তারপর ‘ ‘৯০ এ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে পুরো ৮০’র দশকে ছাত্র আন্দোলনের একজন সক্রিয় যুদ্ধা ছিলাম। কিন্তু এবার ৫ আগষ্টে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থান একটি অনন্য ও ব্যতিক্রম। মনে হলো যেন মহাবিপদসংকেত দেয়ার আগেই একটি ভয়াবাহ সুনামী ১৬ বছরের সুসজ্জিত তাসের ঘরের মত গড়ে উঠা আওয়ামীলীগের বালুর চড়ের সাজানো সুখের মসনদের নানান নান্দনিক সূখের বালাখানা তছনছ করে দিয়ে গেল আর সারা দেশ ‘৭১ এর পরাজিত অপশক্তির প্রতিহিংসার আগুনে নিক্ষিপ্ত হলো। এই সুনামীয় অভূত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে শুধু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনই হয়নি, সমাজ-সংস্কৃতি ও প্রথাগত চিন্তাও মনোজগতেও একটা যে বড় বদল ঘটে গেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই পরিবর্তিত বাস্তবতা নিজের দেশে তো বটে প্রতিবেশী ভারত-পাকিস্তানের রাজনৈতিক এলিট শ্রেনিদেরকেও সজোরে ধাক্কা দিয়ে নাড়িয়ে দিয়েছে। কারন এবার শুধু শাসকের শিকড়সমেত পতন নয়, একটি নতুন দেশ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যার ফলে ভারতের শাসক দল ও বিরোধী দলনির্বিশেষে সকল দল মতের অনুসারীদের কপালে চিন্তার ভাজ এনে দিয়েছে।
এটা প্রায় নিশ্চিত আগামী দিনে বড় লড়াই বাম ও ডানের মধ্যে হবে না, অথবা শ্রমজীবী-মেহনতি-বঞ্চিত মানুষের সাথে শোষক-পুঁজিবাদীদের ও লড়াই হবে না। যাঁরা বিদ্যমান ইতিহাস-ঐতিহ্যকে প্রকাশ্যে ঘৃণা করে এবং যাঁরা রাষ্ট্রের নতুন বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা করতে চান তাঁদের সাথে হবে চলমান ইতিহাস ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির লড়াই । ইতিহাসের উল্টো পথই বুর্জুয়া রাজনীতির অস্তিত্বকে সঙ্কটে ফেলে দেবে। কারন আওয়ামীলীগের রাজনীতি স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ ইস্যুতেই আটকিয়ে রেখেছে পুরো জাতিকে। রাজনীতি বলতেই স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ।
আমরা গত চার মাসের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে সহজেই বুঝতে পারি যে, দেশ Greedbase corruption থেকে Needbase corruption এর দিকে যাচ্ছে। সীমাহীন বেকারত্ব, কলকারখানা বন্ধ হওয়া, গণহারে চাকুরীচ্যুতি, শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের মধ্যে হতাশা, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, ব্যবসা বাণিজ্যে মন্দাভাব, আইন শৃঙ্খলার ক্রমাগত অবনতি, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্বের দৌরাত্ম, চিকিৎসা-শিক্ষার অবনতির কারনে মানুষ দিশেহারা। তাই সমাজে অসম্ভব অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। মানুষ এখন অন্যায় ও দূর্নীতির দিকে প্রবলভাবে ধাবিত হচ্ছে। অন্যদিকে রাষ্ট্র পরিচালনায় রাষ্ট্রযন্ত্রের ভিতরে ভয়াবাহ রকমের একটি দূর্নীতিগ্রস্থ গোপন ক্ষমতাকাঠামোর চেইন গড়ে উঠেছে যা দীর্ঘ দিন ধরে বহমান, তা নিরসন করতে অন্তর্বর্তী সরকার সম্পূর্ণ ব্যার্থ। যার ফলে প্রশাসনে এত অস্থিরতা।
রাজনীতি চর্চায় ঐতিহ্যবাহী গণনন্দিত নেতাদের প্রতি অন্ধভক্তি যুগের অবসান হচ্ছে। আমরা প্রথাগত চিরন্তন সামাজিক ন্যায়বিচার ও মূল্যবোধ থেকে দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছি। আমরা নতুন এক অজানা ও অনিশ্চিত যুগের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। যাঁরা প্রথাগত চিরন্তন ধারায় রাজনীতি করতেন এই নতুন জগতে তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ দেখা দিয়েছে। আমরা ঢুকে গেছি ‘জেনারেশন জেড’, সংক্ষেপে জেন-জি প্রজন্মের যুগে। জেন-জি প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের বয়স ১২ থেকে ২৭ বছর। এদেরকে মিলিনিয়ালস ও বলা হয়।
তাঁরা অতিমাত্রায় উদারনৈতিক চিন্তাশীল, অতিমাত্রায় উদার, অতিমাত্রায় স্টাইলবদ্ধ দ্বিমাত্রিক চিন্তক, অতিরিক্ত বৈষম্যসচেতন । তাঁরা বিচক্ষণ নয়, কেবল প্রেরণাদায়ী। তাঁরা বইয়ের পোকা নয়, এরা নেট দুনিয়া বা ফেসবুকের ‘বুকওয়ার্ম’। অন্য দিকে বিবেচনা করলে এরা ইন্টারনেটের প্রভাবে বিষাক্ত হয়ে পড়া চূড়ান্ত শ্রমিক-কৃষক মেহনতি মানুষ বিমূখ, চরম ডানপন্থী ধারার পডকাস্টে আসক্ত। তাঁরা কে খাবে, আর কে খাবেনা এটাকেই বৈষম্য বিরোধী ইডিউলোজি মনে করে। তাঁদের আইডল একজন ‘টিভি টকার’ বা ‘ব্লগার’ ‘ইউটিউবার’। তাদের ‘মেন্টর’ তাদেরই সহচর। পৃথিবীর বরণ্য ব্যাক্তি বর্গের অনুসরণের বদলে নিজেরাই নিজেদের দিকনির্দেশক। বলা যায় এক অস্থির অপ্রকৃতস্থ প্রজন্মের যুগসন্ধিক্ষণ সময় পার করছি আমরা।
দেশ গড়ার চেতনা আর প্রতিশোধের চেতনা এক নয়। এখন রাজনীতিতে প্রতিশোধের চেতনারই প্রধান্য। কোনো দেশ বিনির্মানে এ রকম রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অন্তরায়, এভাবে দেশ সঠিক পথে এগোতে পারে না।
‘৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ বিপ্লব না হলেও বিপ্লবের তীব্র আকাঙ্খা ছিল। কিন্ত ৫ আগষ্টের অভূত্থানে কোন বিপ্লবের আকাঙ্খা ছিলনা, তথাপি এটাকে বিপ্লব বলে চালিয়া দুধের সাধ ঘোলে মিটাচ্ছেন অনেকে।
এখন উপযুক্ত সময় প্রত্যেক রাজনৈতিক দলে নতুন গঠনতন্ত্র, নতুন ক্ষমতা কাঠামো, নতুন রাজনৈতিক সুরাহা নিয়ে দলের ভিতরে ব্যপকভাবে আলোচনা করা। তারপর রাষ্ট্র পরিচালনায় নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করা। নিজেদের দলের সংস্কার আগে দরকার। জাতিকে আর ভুল পথে ধাবিত করা যাবে না। একজন শ্রমিক চাকুরি কোটার জন্য রাস্তায় নামেনি। সে নেমেছিল বৈষম্য দূরীকরণের জন্য ও নিজে খেয়ে পুড়ে বাঁচার জন্য। কিন্তু বর্তমান সরকার এর ধারে কাছে ও নেই।
এ পর্যন্ত প্রত্যেক শাসকের আমলেই জণগন চরম নির্যাতন, নিপীড়ন শোষণ ব্যাঞ্চনার শিকার হয়েছে। ‘স্ট্রিট ডগ’ যেখানে খাবার পায় সেখানেই ‘প্রভূভক্ত’ বলয় গড়ে তুলে। দেশে এখন তথাকথিত ‘প্রভূভক্ত’ এক প্রকার প্রাণীর সাইকেল তৈরি হয়েছে। সর্বত্রই এর সক্রিয় উপস্থিতি দেখা যায়। তবে বেশির ভাগ তরুণদের মধ্যে স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, প্রথাবিরোধী রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশ, নতুন কিছু করার চেষ্টা প্রথাগত রাজনৈতিক ধ্যান ধারণার বাইরে একটি জাগরণ ঘটেছে, এটা নিঃসন্দেহেই আশার কথা। সম্প্রতিক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তাঁদের দেয়ালের গ্রাফিতি ও আর্টিস্টিক উপস্থাপনাই বড় প্রমাণ। তাঁদের এই গ্রাফিতি যে কেহকেই উদ্বেলিত করে। যদিও চলমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তাদের কোন বক্তব্য নেই। আমরা মনে করি, দেশ পুনর্গঠনের যেমন দায় আছে শিক্ষানীতির আমুল পরিবর্তনেও তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ দায় রয়েছে। ক্ষমতা পাওয়া বা ধরে রাখাই রাজনীতির মুখ্য হলে সাংঘর্ষিক রাজনীতির অবসান হবে না কখনো। আমরা দেখতে পারছি আওয়ামী স্বৈরশাসনের অবসানের পর থেকে ইতিহাস ঐতিহ্য ধ্বংস বা বিনষ্ট করার একটা প্রবণতা চলছে নানাভাবে নানাবিধ কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে।
৫ আগস্টে হাসিনার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে দৃশ্যত দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সম্প্রসারণবাদী পররাষ্ট্রনীতিরও সমুলে পরাজয় ঘটেছে। এর আগে, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মালদ্বীপেও আমরা তাদের সম্প্রসারণবাদী আধিপত্য বিস্তারকল্পে পররাষ্ট্রনীতির পরাজয় দেখেছি। এই ব্যর্থতা ঢাকতেই সেখানকার শাসক ও রাষ্টীয় মিডিয়ার একাংশ সংখ্যালঘু নির্যাতন ইস্যুতে প্রোপাগান্ডা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে।
আগষ্টের ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থান, তার পেছনে হাসিনার স্বৈরশাসন থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষার আড়ালে ভারতীয় আধিপত্যবাদী শাসকগোষ্টীর প্রভাব-বলয় থেকে বাংলাদেশেকে মুক্ত করে ‘৭১ এ পরাজিত পাক শাসকের করায়ত্তে নিয়ে যাওয়া ছিল একটি বড় রাজনৈতিক অভিসন্ধি। ইন্দনদাতারা ও এখন প্রকাশ্যেই স্বাধীনতা বিরোধী মুখোশ উন্মোচন করে বক্তৃতা বিবৃতি দিচ্ছে। এটা অনস্বীকার্য বিষয় যে, উপমহাদেশের অন্য দুটি দেশ থেকে এ দেশের ইতিহাস অনন্য, কারন এ দেশের জন্ম রক্তের উপর হয়েছে।
আন্দোলনকারি ছাত্ররা এখন একটি সংগঠিত শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চাচ্ছে। তারা রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। যদিও আমরা জানিনা তাদের দলের আদর্শ উদ্দেশ্য ও দর্শন কি!
দেখা যাক, বাজিকর রাজনীতিকদের হাত থেকে রাজনীতির মুক্তি মেলে কি না!
ধন্যবাদ!
(লেখক পরিচিতি: এম এ আউয়াল, ‘৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা)