নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ‘আদিবাসী শিক্ষার্থীদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা ও সংক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশি হামলার বিরুদ্ধে’ সমাবেশে বক্তব্য দেন।
গণ–অভ্যুত্থানের সময় দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতিতে যে আকাঙ্ক্ষা ও চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন তরুণেরা, এর সঙ্গে অন্তর্র্বতী সরকারের চিন্তার মিল দেখা যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেছেন, এই সরকার ও সরকার–ঘনিষ্ঠদের মধ্যে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে অস্বীকার করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি জনগণের যা যা প্রয়োজন, তা অস্বীকারের লক্ষণও দৃশ্যমান। এই সরকার যে বিগত সরকার থেকে আলাদা, সেটা কাজের মধ্য দিয়েই তাদের প্রমাণ করতে হবে।
শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি। ‘আদিবাসী শিক্ষার্থীদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা ও সংক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশি হামলার বিরুদ্ধে’ এ সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে আনু মুহাম্মদ অভিযোগ করেন, বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অন্তর্র্বতী সরকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হাঁটছে না। বন্ধ কারখানার বেকার শ্রমিকদের নিয়ে কোনো মাথাব্যথা না থাকা, বিভিন্ন জাতি ও ভাষার মানুষের ওপর অত্যাচার এবং ‘আদিবাসী’ শব্দ থাকায় পাঠ্যবই থেকে গ্রাফিতি বাদ দেওয়ায় সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন তিনি।
আদিবাসী শব্দটি নিয়ে বিভ্রান্তি আছে উল্লেখ করে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘আদিবাসী মানে আদি বাসিন্দা নয়। তার আলাদা একটা সংস্কৃতি, ইতিহাস, আইনকাঠামো ও জাতিগত বৈশিষ্ট্য আছে। …আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে ছিল, তখন তারা আদিবাসী শব্দটা বলত, কিন্তু ২০০৯ সালে সরকারে যাওয়ার পর হঠাৎ তারা বলল, আদিবাসী শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। তার মানে, এখানে রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে আদিবাসী ধারণাকে অস্বীকার করার একটা রাজনৈতিক সম্পর্ক আছে। সেই কারণে যারা ক্ষমতায় যায়, তারা এটাকে অস্বীকার করতে চায়। …আদিবাসী শব্দ নিয়ে অন্তর্র্বতী সরকারের কারও আপত্তি থাকলে আলোচনা করা যেতে পারে। আদিবাসী শব্দ থাকায় পাঠ্যবই থেকে গ্রাফিতি হঠাৎ বাদ দেওয়া এবং এর প্রতিবাদ করতে গেলে একটা গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী আক্রমণ…। সরকারকে তাদের ব্যাপারে খুবই নমনীয় দেখা যাচ্ছে। সেই হামলার প্রতিবাদ করতে গেলে পুলিশ আবার আগের মতো করে আক্রমণ করল। এর পুরো দায়দায়িত্ব সরকারের ওপর পড়ে।
রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে ‘আদিবাসী’ ধারণাকে অস্বীকার করার একটা রাজনৈতিক সম্পর্ক আছে। সে কারণে যারা ক্ষমতায় যায়, তারা এটাকে অস্বীকার করতে চায়।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, সদস্য, গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি
গত বুধবার ঢাকার মতিঝিলে ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতার’ ওপর ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টির’ হামলা এবং এর প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে গত বৃহস্পতিবার ‘সংক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার’ ওপর পুলিশি আক্রমণেরও প্রতিবাদ জানান আনু মুহাম্মদ। পুলিশি আক্রমণের বিষয়ে তিনি বলেন, এর জন্য সরকারকে সরাসরি ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। সরকার এ আক্রমণ করেছে। পুলিশি আক্রমণ, সন্ত্রাসী আক্রমণ ও ভ্যাটের (মূল্য সংযোজন কর) আক্রমণ—এই তিন ধরনের আক্রমণ থেকে সরকারকে অবশ্যই পিছিয়ে আসতে হবে।
সমালোচনা করলে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’
প্রাণ খুলে সরকারের সমালোচনা করার আহ্বানের বিষয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘প্রাণ খুলে সমালোচনার কথা বলা হবে, সমালোচনা করলে বলা হচ্ছে যে সমালোচনা মানে ফ্যাসিবাদের দোসর…। এ ধরনের কথাবার্তা আমরা আওয়ামী লীগের সময়ও শুনতাম যে এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার, তার বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না। এটাই হচ্ছে অগণতান্ত্রিক, স্বৈরতন্ত্রী ফ্যাসিবাদের আবহ।’
যমুনার সামনের সড়কে মানুষের চলাচল সীমিত করার সমালোচনা করে আনু মুহাম্মদ বলেন, ভিআইপি সংস্কৃতি বন্ধ না করে এই সরকার প্রমাণ করছে যে তারা কোনো ধরনের পরিবর্তন করতে চায় না। আমলাদের পদোন্নতি দিয়ে ব্যয় বাড়ানো, টাকা নেই বলে জনগণের ঘাড়ে ভ্যাটের বোঝা চাপানো, খেলাপি ঋণ আদায়ের চেষ্টা না করা এবং লুটেরাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত না করারও সমালোচনা করেন তিনি।
কারও সঙ্গে আলোচনা না করে ‘ভ্যাট’ (মূল্য সংযোজন কর) নামক একটা ভয়ংকর জিনিস জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করে আনু মুহাম্মদ বলেন, এই সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত পাঁচ মাসে জিনিসপত্রের দাম কমেনি, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে, ডলার ও টাকার বিনিময় হারের কারণে অনেক রকম অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি কমানোর কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
‘আদিবাসী শিক্ষার্থীদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা ও সংক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশি হামলার বিরুদ্ধে’ সমাবেশের আয়োজন করে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি। শাহবাগ, ঢাকা, ১৭ জানুয়ারি
করের বোঝা চাপাচ্ছে
খেলাপি ঋণ ও পাচার করা টাকা উদ্ধার না করে সরকার জনগণের ওপর একের পর এক করের বোঝা চাপাচ্ছে বলে সমাবেশে অভিযোগ করেন লেখক ও গবেষক মাহা মির্জা। তিনি বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য নিয়ে মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। সেই সময়ে কোনো বাছবিচার না করে ভ্যাট চাপানো হচ্ছে। একই সময়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবার মহার্ঘ্য ভাতা দেওয়া হচ্ছে। রাজস্ব ঘাটতি থেকে থাকলে কেন মহার্ঘ্য ভাতা ঘোষণা করা হচ্ছে?
মাহা মির্জা বলেন, খেলাপি ঋণ উদ্ধারের ব্যাপারে ছয় মাসেও সরকারের কোনো দিকনির্দেশনা নেই, কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর হাজার হাজার কর্মকর্তাকে ঢালাওভাবে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে।
হাসিনার নিপীড়ন এই সরকারের আমলে ফিরে আসার বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না বলে উল্লেখ করেন মাহা মির্জা।
সরকারে সমালোচনা করে সিপিবির নেতা আবদুল্লাহ কাফী সমাবেশে বলেন, ‘জনগণের আকাঙ্ক্ষার ধারেকাছেও আপনারা নেই।’
এ সমাবেশ সঞ্চালনা করেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (ইউপিডিএফ) সভাপতি অঙ্কন চাকমা। আরও বক্তব্য দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাসউদ ইমরান এবং পুলিশের আক্রমণে আহত শিক্ষার্থী তৈয়ব ইসলাম। সমাবেশের শেষ দিকে গান শোনান শিল্পী মুসা কলিম, গানের দল সহজিয়ার ভোকালিস্ট রাজীব আহমেদ এবং সমগীতের বীথি ঘোষ ও রেবেকা নীলা।
তিন দফা দাবি
সন্ধ্যায় সমাবেশ শেষ হওয়ার পর তিন দফা দাবিতে শাহবাগ থেকে মশালমিছিল বের করেন বামপন্থী বিভিন্ন ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা–কর্মীরা। তাঁদের প্রায় সবাই গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সমাবেশে অংশ নেন।
‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত গ্রাফিতির ছবি পাঠ্যপুস্তকে পুনঃস্থাপন এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার দাবিতে মশালমিছিল বের করা হয়। শাহবাগ, ঢাকা, ১৭ জানুয়ারি
মিছিলটি শাহবাগ থেকে কাঁটাবন হয়ে নীলক্ষেত দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে। পরে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যে গিয়ে মিছিল শেষ হয়।
মশালমিছিল থেকে যে তিন দফা দাবি তোলা হয় তার প্রথমটি হলো অভ্যুত্থানে আঁকা গ্রাফিতির ছবি পাঠ্যপুস্তকে পুনঃস্থাপন ও সব জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দাবি হলো সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ ও সংক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশি হামলার বিচার এবং ব্যর্থতার দায় নিয়ে অবিলম্বে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ।