৩৫টি মামলা কাঁধে, বন দখলে মনিরের রাজত্ব!

অন্যান্য আইন আদালত

নিজস্ব প্রতিবেদক

গাছ চুরি ও জমি দখল নিয়ে বন বিভাগের অন্তত ৩৫টি মামলা মো. মনিরুজ্জামানের কাঁধে। তবুও দমে যাননি তিনি। নিজস্ব বাহিনী গড়ে সীমানাপ্রাচীর দিয়ে বনের বহু জমি কবজায় নিয়েছেন। বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাছে তা বিক্রিও করেছেন। তাঁর কারণে বনের ভেতরে ভূমিহীন হিসেবে জমি বন্দোবস্ত পাওয়া ব্যক্তিও সরতে বাধ্য হন। কেউ সরতে না চাইলে বাড়ির চারদিকে প্রাচীর দেন ও বিদ্যুৎ-পানির সংযোগ বিচ্ছিন্নের মাধ্যমে অবরুদ্ধ করে রাখেন। এভাবেই যুবলীগের সাবেক নেতা মনিরুজ্জামান বনের জমি দখল করে ময়মনসিংহের ভালুকা বনাঞ্চলে ‘রাজত্ব’ গড়েছেন। তিনি ভালুকার হবিরবাড়ি বারশ্রী গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে।
স্থানীয়রা জানান, হবিরবাড়ি ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন মনির। পাশাপাশি মাটির ব্যবসা করতেন। ২০০০ সালের পর থেকে বনে তাঁর আধিপত্য শুরু হয়। তবে গত এক দশকে এলাকায় ত্রাস হয়ে উঠেছেন। কয়েকশ একর বনের জমি দখল করেছেন। যদিও ঠিক কী পরিমাণ জমি মনির দখল করেছেন, দুই সপ্তাহ সময় নিয়েও তা জানাতে পারেননি বন বিভাগের কাদিগর বিট কর্মকর্তা ফিরোজ আল আমিন। তবে ভালুকা রেঞ্জের কর্মকর্তা হারুন-উর রশিদ খান বলেন, ‘জমি দখলের অভিযোগে মামলার সময়ই পরিমাণ উল্লেখ করা হয়। মনিরের বিরুদ্ধে অনেক মামলা আছে। ইতোমধ্যে কিছু নিষ্পত্তি হয়েছে, কিছু মামলায় তিনি জামিনে আছেন।’

মনিরের কাছে জমি বিক্রি না করায় ভালুকার পাড়াগাঁও গ্রামের ব্যবসায়ী সফিকুল ইসলাম গত ৭ মে ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ‘আশির দশকে ২ একরের মতো জমি জেলা প্রশাসন থেকে ভূমিহীন হিসেবে বন্দোবস্ত পান আমার বাবা। সেই জমিতেই পরিবারের লোকজন বসবাস করে আসছেন। গত ৪ মে সকালে সশস্ত্র কয়েকশ লোক নিয়ে মনির আমাদের বাড়ি থেকে বের হওয়ার রাস্তায় দেয়াল তুলে দেন। বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় পানির অভাবে পড়েছি। বাড়িতে অন্য কাউকে আসতেও দিচ্ছে না। থানায় অভিযোগ দিলেও এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবস্থা হয়নি।’

ভুক্তভোগীর লিখিত অভিযোগ পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। ভালুকা থানার ওসি কামাল হোসেন বলেন, ‘অভিযোগের তদন্ত চলছে। মনিরের বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলা নেই।’ তবে মনিরের বিষয়ে একটি পুলিশ রেকর্ড সমকালের হাতে এসেছে। তাতে ২০০৮ সাল ও ২০১০ সালে পৃথক দুটি মামলার এজাহারভুক্ত আসামি হলেন মনির। মারধর, ডাকাতি, চুরির ধারা যুক্ত করে মামলাগুলো করা হয়।

শুধু ব্যবসায়ী সফিকুল ইসলাম নন, মনিরের অত্যাচারে অনেকেই নিজের জমি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। এমনই এক ভুক্তভোগী নূর মোহম্মদ সিদ্দিকী জানান, বাড়িঘর ভেঙে তাঁর অন্তত ২ একর জমি দখল করে নিয়েছেন মনির। এ নিয়ে আদালতে মামলা করলে তা তুলে নিতে মনির ও তার লোকজন হুমকি দিচ্ছেন। তিনি অভিযোগ করেন, ‘বন বিভাগের লোকজনের সহায়তায় বন ও আশপাশের মানুষের জমি দখল করেন মনির।’ আরেক ভুক্তভোগী নাঈম সরকার বলেন, ‘আমার বাবার অন্তত ১ একর জমি দখলে নিয়েছেন মনির। কিন্তু ভয়ে কিছুই করতে পারিনি।’

ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের গণিত বিভাগের অধ্যাপক আমীর হোসেন বলেন, ‘আমার ৬৭ শতক জমি দখলে নিয়েছেন মনির। স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে পুলিশের দ্বারস্থ হয়েও লাভ হয়নি। পরে নিরুপায় হয়ে মনিরের কাছেই বিক্রি করে এসেছি। জমির আমমোক্তার কাগজ হলেও দলিল করে নেননি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার বোনদের বাড়িও বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে জমির দখল নিয়েছেন মনির। তিনি মূলত বনের জমি দখল করেন, সেখানে ব্যক্তি মালিকানার জমি থাকলে, তা জোর করে নামমাত্র মূল্যে কিনে নেন।’

অভিযোগের বিষয়ে মনিরুজ্জামান বলেন, ‘ব্যবসায়ী সফিকুলের ওখানে আমার জমি ছিল, সেটি এনডি কোম্পানির কাছে বিক্রি করে আগেই চলে এসেছি। সীমানাপ্রাচীর অনেক পুরোনো এবং কোম্পানি এখন সেখানে ফটক দিয়েছে। পরিবারের সবাই জমি বিক্রি করে দিলেও সফিক তাঁর ৩১ শতক ধরে রেখেছেন। এর জন্য ২২ লাখ টাকা বায়না দিয়েছিলাম আমি। কিন্তু এখন আর তিনি জমি দেবেন না। কোম্পানির জমির মধ্যে তাঁর জায়গা। কোম্পানিও এখন তাঁর জমি নেবে না। এ নিয়ে তিনি হিংসা করেন আমাকে।’ নূর মোহম্মদ সিদ্দিকী, নাঈম সরকারসহ অন্যদের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তাঁরাই জমি বিক্রি করেছেন।’

বন বিভাগের মামলার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মনির বলেন, এগুলো অহেতুক প্রশ্ন। বন বিভাগ কী কখনও আপনাদের কাছে অভিযোগ করেছে? অবশ্য বন বিভাগের দু’জন রেঞ্জ কর্মকর্তাকে মারধরের মামলা দেওয়া হয়েছিল বলে স্বীকার করেন তিনি।

ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আ ন ম আবদুল ওয়াদুদ বলেন, ‘বনের কাঠ চুরি ও জমি দখলের অভিযোগে মনিরের বিরুদ্ধে ৩০-৩৫টি মামলা আছে। তবে কী পরিমাণ জমি দখল করেছেন, গাছ কাটা ও জমি দখলের মামলা কতটি, তা নির্ণয় করা ছাড়া বলা সম্ভব নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আইন অনুযায়ী মামলা করা ছাড়া আমাদের গ্রেপ্তার করার সুযোগ নেই। উচ্ছেদ কিংবা স্থাপনা ভাঙতে হলেও আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়। মামলাগুলো বিচারাধীন। নতুনভাবে কিছু করতে গেলে আবারও মামলা দেওয়া হবে।’ মনিরের সঙ্গে বন বিভাগের লোকজনের জোগসাজশের অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান এ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *