উড়িষ্যার ট্রেন দুর্ঘটনা: ‘নিহতদের বেশিরভাগ‌ই নিম্ন আয়ের শ্রমিক’

আন্তর্জাতিক ঘটণা- দুর্ঘটনা পরিবহণ-পর্যটন ও যোগাযোগ

সুবর্ণবাঙলা ওয়েবডেস্ক

শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার পর পশ্চিমবঙ্গের উত্তর থেকে দক্ষিণ জেলার বাতাসে ভেসে আসছে কান্নার শব্দ, দেখা মিলছে আর্তনাদের করুণ দৃশ্যের। নিখোঁজ স্বজনের সন্ধানে পাগলপ্রায় অনেকেই। উড়িষ্যায় ট্রেন দুর্ঘটনার দুই দিন পরের চিত্র এটি।

এ বিষয়ে দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানায়, ট্রেনের দুর্ঘটনার নিহতদের বেশিরভাগ ছিলেন নিম্ম আয়ের শ্রমিক। কারণ যে দুটো বগি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা ছিল নন এসি বগি এবং তাতে বেশিরভাগই ছিলেন রাজমিস্ত্রি, পরিযায়ী শ্রমিক, টাইলস মিস্ত্রি।

দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনের যাত্রীদের গল্প নিচে তুলে ধরা হলো:

জেসিবি চালক শ্রীদাম বিশ্বাস

পরিবারে নিত্যদিনের সঙ্গী আর্থিক সংকট। তাই পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে নিজের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে তামিলনাড়ুতে জেসিবি চালকের কাজ করেন গাইঘাটা যুবক শ্রীদাম বিশ্বাস। পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতেই ট্রেনে করে ফিরেছিলেন বাড়িতে। শ্রীদাম বলেন, ট্রেন যাত্রা শুরুর তিন ঘণ্টার মধ্যেই বিকট আওয়াজ করে গড়াতে শুরু করলো ট্রেনের কামড়া, এরপর চারিদিকে অন্ধকার, মানুষের আর্তনাদ। যেটুকু আলো চোখে পড়ছে তাতে জীবন্ত অবস্থায় নরক দর্শন করেছি। দেখতে পেলাম সহযাত্রীদের রক্তাক্ত চেহারা, কাটা হাত, পা, মুণ্ডহীন কাটা দেহ। জীবীত ফিরে এবারের অভিজ্ঞতা তাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না।

উত্তর চব্বিশ পরগনার পরিতোষ সরদার

ব্যাঙ্গালোরে সেন্টারিংয়ের কাজ করতেন উত্তর চব্বিশ পরগনার পরিতোষ সরদার। যশবন্তপুর এক্সপ্রেসে বাড়ি ফেরার পথে দুর্ঘটনার শিকার হন। সারা দেহে আঘাতের চিহ্ন আর মাথায় সেলাই নিয়ে বাড়ি ফিরেন তিনি।

পরিতোষ বাবু জানান, ব্যাঙ্গালোর থেকে যশবন্তপুর এক্সপ্রেসের ১ তারিখে সকাল সাড়ে ৭টায় রওনা দেন তিনি। পরের দিন সন্ধ্যেবেলা দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তার ট্রেন। তিনি বলেন, দুর্ঘটনার সময় বিকট আওয়াজ শুনতে পান তিনি। সেসময় রেল লাইনে থাকা পাথর ছিটকে আসতে থাকে কামরার ভেতর।

তিনি বলেন, ওই কামরার সহযাত্রীদের বেশিরভাগই এই ঘটনায় মারা গিয়েছেন। দুর্ঘটনার পরে প্রাথমিকভাবে যে তিনজনকে জীবিত ওই কামরা থেকে বার করা হয় তার মধ্যে তিনি ছিলেন।

ট্রেনে উঠে ব্যাগ ঠিকমতো না রাখতেই দুর্ঘটনায় মৃত্যু

তবে শ্রীদামের, পরিতোষ বাবুর মতো সবার ভাগ্য ভালো নয়। পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুকের আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া আজিমউদ্দিন শেখ কেরালায় টাইলস মিস্ত্রির হিসাবে কাজ করে পরিবারে এনেছিলেন আর্থিক স্বচ্ছলতা। শুক্রবার ট্রেন দুর্ঘটনার ঠিক আগেই বালেশ্বর স্টেশন থেকে ট্রেন ধরেছিলেন আজিমউদ্দিন। ট্রেনে উঠে ব্যাগ ঠিকমতো গুছিয়ে রাখতে পারেননি তার মধ্যেই ঘটে যায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার। রাতে এগারোটার দিকে অন্যান্য সহযাত্রীরা পরিবারকে ফোন করে তার মৃত্যুর খবর জানায়। এমন ঘটনায় হতভম্ব গোটা পরিবার। দুই শিশুসন্তান নিয়ে কথা বলার মত পরিস্থিতিতে নেই আজিমুদ্দিনের স্ত্রী। বাড়ির পাশেই গোরস্থানে করা হচ্ছে কবর। প্রতিবেশীরা আনতে গিয়েছে আজিমুদ্দিনের মৃতদেহ।

তার বোন রোজিনা খাতুন বলেন, দুর্ঘটনার খবর পর পর থেকেই আমরা দাদাকে ফোন করতে শুরু করি, কিন্তু দাদা ফোন ধরছিলেন না। পরে পরিচিতরা রাতেই দাদার মৃত্যুর খবর জানান।

একই গ্রামের ১৫ জন দুর্ঘটনার শিকার

পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার কাকদ্বীপ মহকুমার মধুসূদনপুর গ্রাম। এই গ্রামের একসঙ্গে ১৫ জন এই রেল দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩ জনের মরদেহ শনাক্ত করা গেলেও ৯ জনের কোন খোঁজ মেলেনি। গ্রামের আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে স্বজনদের কান্নায়। গ্রামে দুর্ঘটনার শিকার আবদুল মাজেদের ভাই আব্দুল মান্নান শেখ জানান বাড়ি করতে গিয়ে দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন ভাই আব্দুল মাজেদ। বেশি টাকা উপার্জন এর আশায় ছেলেকে নিয়েই গ্রামের ১৩ জনের সঙ্গে পাড়ি দিয়েছিলেন কেরালায়। দুর্ঘটনায় আব্দুল মাজেদের ছেলে নিহত হয়েছেন, এখনও আব্দুল মাজেদের কোন খোঁজ মেলেনি।

মরদেহের পাশে ব্যাগ, ভেতরে খাবার

আসিফ গাজী বলেন, শুক্রবার রাতে দুর্ঘটনার পর শনিবার সকালে ভোরের আলো ফুটলে দেখা যায় দুর্ঘটনাস্থল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আহত-নিহত যাত্রীদের হাজার হাজার ব্যাগ, খাবারসহ নানান প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। কোন ব্যাগের ভেতর থেকে উঁকি মারছিল রাজমিস্ত্রিদের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আবার কোনটায় আবার টিফিন বাক্স ভরা খাবার। আর চারদিকে অসংখ্য ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন মরদেহ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *