সুবর্ণবাঙলা ডেস্ক
সন্ত্রাসের অন্ধকার জগৎ ছেড়ে শান্তির পথে পা রাখতে যাচ্ছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান সংঘাত নিরসনে বান্দরবানে গঠিত শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সঙ্গে শিগগির কুকি-চিন নেতাদের মধ্যে ভিডিও কনফারেন্সে আলোচনার কথা রয়েছে। পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রথম পর্যায়ের কথাবার্তা সফল হলে পরে দু’পক্ষের নেতারা সশরীরে আলোচনায় বসবেন। পার্বত্যাঞ্চলের নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আর সংঘাত নয়, আলোচনার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার ক্ষেত্রে বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লার নেতৃত্বে গঠিত শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন কেএনএফ প্রেসিডেন্ট নাথান বম। এ নিয়ে কিছুদিন ধরে উভয়পক্ষের মধ্যে চিঠি চালাচালি হয়। তাতে আলোচনার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি ‘মঞ্চ’ তৈরি হয়েছে। ভিডিও কনফারেন্সের সময়সূচি শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির তরফ থেকে শিগগির কেএনএফ প্রধানকে জানানো হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র সংঘাত অবসানে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি হয়েছিল। এরপর ২০০৮ সালে পাহাড়ে নাথান বমের নেতৃত্বে নতুন সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের আবির্ভাব ঘটে। আবারও শুরু হয় দাঙ্গা-সংঘাত। ২০০৮ সালের কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনকে (কেএনডিও) ২০১৯ সালে পুনর্গঠন করে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) করা হয়। রাঙামাটি ও বান্দরবানের ৯ উপজেলা নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা দিয়েছিল সশস্ত্র এ সংগঠনটি।
পার্বত্য শান্তিচুক্তির পরও অভ্যন্তরীণ কোন্দল, বিশেষ বাহিনী ও স্থানীয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সশস্ত্র সংঘাতে পাহাড়ে সাত শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। শান্তিচুক্তির পথ ধরেই এবার কুকি-চিন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার এ উদ্যোগ নিয়েছে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি।
পার্বত্যাঞ্চলের সূত্র জানায়, নাথান বমের নেতৃত্বে কেএনএফের নেতারা বর্তমানে ভারতের মিজোরামের আইজলে অবস্থান করছে। সেখান থেকেই তারা বান্দরবানের শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির ভিডিও কনফারেন্সের আলোচনায় অংশ নেবেন। কুকি-চিন কী চায়, তাদের দাবি কী কী– আলোচনায় এসব বিষয় উঠে আসবে। আলোচনার মাধ্যমেই ওই সশস্ত্র সংগঠনের অন্তত ২৫০ সদস্যকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার পথ খোঁজা হবে।
এ ব্যাপারে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা সমকালকে বলেন, কুকি-চিন কী চায়– সেসব বিষয়ে আলোচনা করেই তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। উভয়পক্ষের বৈঠক কখন হবে, কোথায় হবে– সেটা নিয়ে আলোচনা চলছে। উভয়পক্ষের মধ্যে বিশ্বাস স্থাপন এখন বড় বিষয়। এটি হলে সংকট সমাধানের পথ অনেকটাই এগিয়ে যাবে। পাহাড়ে হঠাৎ করেই অশান্তি নেমে এসেছে। অথচ কুকি-চিন সদস্যরা আমাদেরই ভাই। আলোচনার মাধ্যমে আগের সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
শান্তি প্রতিষ্ঠায় লিয়াজোঁ কমিটির আহ্বায়ক লালজারলম বম সমকালকে বলেন, আমরা কুকি-চিনের প্রেসিডেন্ট নাথাম বমকে চিঠি দিয়ে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছি। তাতে তারা প্রথমে ভিডিও কনফারেন্সে আলোচনা করার সম্মতি দিয়েছে। আলোচনার তারিখ ও সময় এখনও ঠিক হয়নি। তবে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে আলোচনা হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির মুখপাত্র কাঞ্চন জয় তঞ্চঙ্গ্যা সমকালকে বলেন, আমরা সফল হবো– এই আশা নিয়ে কাজটা শুরু করেছি। তারাও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চায়। এটা করা গেলে কুকি-চিন নিয়ে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে সেটা দূর হবে। এ ব্যাপারে আমি আশাবাদী। কুচি-চিনের সদস্যরা এখন শান্তিতে নেই। তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। এ কারণে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চায়। এখন তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারলেই পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসবে। শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটিও সফল হবে।
অনেক চেষ্টা করে কেএনএফ প্রেসিডেন্ট নাথান বমের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির চিঠির জবাবে নাথান বম লিখিতভাবে কমিটির প্রস্তাবকে সাধুবাদ জানান। সবশেষে তিনিই ভিডিও কনফারেন্সের প্রস্তাব দেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নাথান বমকে প্রথমে সংলাপের প্রস্তাব দেয় লিয়াজোঁ কমিটি। তারা প্রস্তাবে রাজি হয়ে দেশের বাইরে মিজোরামে বৈঠকের কথা জানিয়েছিল। লিয়াজোঁ কমিটি দেশের ভূখণ্ডের বাইরে বৈঠক না করে ভেতরে তাদের সুবিধাজনক যে কোনো জায়গায় বৈঠক করার আহ্বান জানায়। এও বলা হয়, দেশের ভেতরে বৈঠকে বসলে তাদের সব ধরনের নিরাপত্তা দেওয়া হবে। এ প্রস্তাবে রাজি না হয়ে গত শনিবার তারা ভিডিও কনফারেন্সে আলোচনার প্রস্তাব দেয়। শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি তাদের প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, পাহাড়ের সব সম্প্রদায়ের মানুষ কুকি-চিন ও নিরাপত্তা বাহিনীর বিদ্যমান সশস্ত্র সংঘাত থেকে মুক্তি চায়। তারা তাদের আবাসস্থলে ফিরে এসে আগের মতো বাস করুক, এটাই কাম্য। পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বিশেষ বাহিনী কুকি-চিনের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার বিষয়ে অবগত আছে। উভয় পক্ষের আলোচনার প্রতি তাদেরও সম্মতি রয়েছে। শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আলোচনা শুরু হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বিশেষ বাহিনীর সদস্যরা প্রয়োজনে সহায়তা করবে। কুকি-চিন নেতারা দেশের ভেতরে বৈঠক করতে এলে প্রয়োজনে ওই বাহিনী তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে।
পার্বত্য অঞ্চলের এক বিশিষ্ট ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করে জানান, বিভিন্ন সময়ে যে দাঙ্গা, সংঘর্ষ হচ্ছে তাতে আশপাশের মানুষ আতঙ্কে থাকে। অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে গেছে। যারা এই সংকটের শিকার, তাদের খুঁজে বের করে খাদ্যসহ সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম-বিষয়ক মন্ত্রণালয় জেলা পরিষদের মাধ্যমে এই সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তাদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আরও কী কী করা যায়– এ নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে।
জানা গেছে, জুনে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির তরফ থেকে নাথান বমকে প্রথম চিঠি দেওয়া হয়। জুলাইয়ে কেএনএফের পক্ষ থেকে নাথান বমের স্বাক্ষরিত চিঠি শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লার কাছে পাঠানো হয়। এরপর কেএনএফ ভিডিও কনফারেন্সে আলোচনার প্রস্তাব দেয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ২২ জুন বান্দরবানে ১৮ সদস্যের শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিতে পার্বত্য অঞ্চলের সব জাতি-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা রয়েছেন। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি অগাধ বিশ্বাস, আনুগত্য বজায় রেখে কুকি-চিন সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে ওই কমিটি গঠন করা হয়।
কেএনএফের সঙ্গে যত সংঘাত
গত ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যটন স্পট বগালেক পাড়া থেকে ব্যবসায়ীর গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। স্থানীয়দের ধারণা, কেএনএফ সশস্ত্র সদস্যরা তাকে অপহরণের পর গুলি চালিয়ে হত্যা করে। গত ১১ মার্চ কেএনএফ সদস্যরা গুলি চালিয়ে এক ট্রাকচালক ও তার সহকারীকে আহত করে। গত ১৩ মার্চ কেএনএফের হামলায় এক সেনাসদস্য নিহত ও দু’জন আহত হন। গত ১৪ মার্চ কেএনএফ সদস্যরা রুমা অঞ্চলের একটি সেতু বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালায়। গত ১৭ মার্চ সাবেক এক সেনাসদস্যসহ তিনজনকে অপহরণ করে সংগঠনটি। গত ২২ মার্চ রোয়াংছড়িতে বম পাড়াপ্রধানের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গত ৭ এপ্রিল রোয়াংছড়ি রুমা সড়কের খামতাং পাড়ায় দুটি সশস্ত্র সংগঠনের (কেএনএফ ও ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক) মধ্যে গোলাগুলি ঘটনায় আটজন নিহত হয়। সে সময় পুলিশের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, নিহত ওই আটজনই বম সম্প্রদায়ের। স্থানীয়রা জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে কেএনএফ সদস্য একজন, অন্য আটজন সাধারণ নাগরিক।
গত ২৪ এপ্রিল রুমার মুয়ালপি পাড়া এলাকা থেকে একজনের গলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ বলেছে, লাশ উদ্ধারের দু’দিন আগে কেএনএফ ও ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। গত ৮ মে রোয়াংছড়ি থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে পাইক্ষ্যংপাড়া এলাকা থেকে তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহতদের একজন সদর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। অন্য দু’জন সাধারণ নাগরিক। এ ছাড়া আরও বহু সংঘাত ও হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছে কেএনএফ।