কবিকে সবাই ছেড়েগেছে শুধু কবিতা ছাড়া

শিল্প ও সাহিত্য

শুভ জন্মদিন কবি মহাদেব সাহা!

ছবি: কবি মহাদেব সাহা

বাকি সবাই অবলীলায় ছেড়ে গেছেন তাঁকে। কেউ পাশে নেই। শুধু আছে কবিতা। কবিতাই এখন মহাদেব সাহার একমাত্র স্বজন। এই স্বজনকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে আছেন তিনি। আজ ৫ আগস্ট কবির বেঁচে থাকার ৭৯ বছর পূর্ণ হবে। ৮০ তে পা দেবেন কবি। ১৯৪৪ সালের এই দিনে সিরাজগঞ্জের ধানগড়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই সখ্য হয়েছিল কবিতার সঙ্গে। তার পর থেকে কবিতার সঙ্গে নীবিড়ভাবে আছেন। সাংবাদিকতাসহ একাধিক পেশায় যুক্ত হয়েছেন বটে। চূড়ান্ত গন্তব্য ছিল কবিতা। অসংখ্য কবিতার জনক তিনি।

মহাদেব সাহার কবিতা মানবিক অনুভূতি, সূক্ষ্ম আবেগ, ভালোবাসার বোধকে তীব্র করে। জাগিয়ে দিয়ে যায়। হৃদয়ের সৌন্দর্যকে তিনি উপযুক্ত শব্দে শুদ্ধ উপমায় প্রতিষ্ঠা করেন। তার মতে, ‘বাংলাদেশের কবিতার মূল ধারা গণআন্দোলন, প্রতিবাদ ও মিছিলের উষ্ণ সাহচর্যে বেড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের কবিতা তাই শিল্পে, প্রতিবাদে, মানবিকবোধে দীপ্র।’ মহাদেব সাহার নিজের রচনায়ও এসব বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল হয়ে ধরা দেয়। সংঘাত, হানাহানি, কোন্দল নয়, ভালোবাসা দিয়ে সারাতে চান পৃথিবীর অসুখ।

ভালোবাসার পায়ের কাছে এমনভাবে মাথা নত করেন যে, তাকে কখনো কখনো মনে হয় চির অভুক্ত ভিখিরী। তার ভালোবাসাকে এভাবে তিনি সার্থক করেছেন। একই সঙ্গে অমরত্ব দিয়েছেন কবিতাকে। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত সে কবিতার কথা উল্লেখ না করলেই নয়, যেখানে কবি লিখছেন, ‘করুণা করে হলেও চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও/আঙুলের মিহিন সেলাই/ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও/একটু সামান্য দাবি চিঠি দিও…।’ অন্যত্র তার বলাটি এ রকম : ‘একবার ভালোবেসে দেখো, একবার কাছে ডেকে দেখো/আবার আগের মতো কীভাবে ফুটাই এক লাখ একটি গোলাপ…।’

একইভাবে মহাদেব সাহার কবিতায় ফুটে ওঠে দেশবোধ। এই দেশ, দেশের মাটি, জল, হাওয়া, সাগর, নদী, প্রাণ, প্রকৃতিকে তিনি ভীষণ ভালোবাসেন। সামান্য বিচ্যুত হলে কবি ক্ষমা চান। অনুতপ্ত কবি লেখেন, ‘প্রিয় নদী, প্রিয় ধানক্ষেত/ক্ষমা করো লাউপাতা, ভোরের শিশির/আমার মায়ের হাতে চাল-ধোয়া জলের সুগন্ধ/আমি তোমাদের কথা রাখতে পারিনি, আমি কথা/রাখতে পারিনি…।’

তার কবিতায় ঘুরেফিরেই আসে বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম। সংগ্রামের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি কবিতায় আগলে রাখেন। মহাদেব সাহা বঙ্গবন্ধুর ওপর একশ’র মতো কবিতা লিখেছেন। অবিসংবাদিত নেতাকে হারানোর শোক, ফিরে পাওয়ার আকুতি, হত্যার প্রতিবাদÑ সবই তিনি করেছেন কবিতার আশ্রয়ে। তেমনই এক কবিতায় কবি লিখেছিলেন, ‘প্রিয় শেখ মুজিব/তোমার রক্ত নিয়েও বাংলায় চালের দাম কমেনি/তোমার বুকে গুলি চালিয়েও কাপড় সস্তা হয়নি এখানে,/দুধের শিশু এখনো না খেয়ে মরছে কেউ থামাতে পারি না/বলতে পারিনি তাহলে রাসেলের মাথার খুলি মেশিনগানের/গুলিতে উড়ে গেল কেন…।’ আর্দ্র কণ্ঠে এমন তীব্র প্রতিবাদ গড়ে তোলার আর্ট মহাদেব সাহাই জানেন ভালো।

তার কাব্যপ্রয়াস যেমন বিদগ্ধজনের প্রশংসা কুড়িয়েছে, তেমনি ছুঁয়ে গেছে একেবারে সাধারণ পাঠকের হৃদয়। প্রেমানুভূতি, প্রতিবাদ, দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধ বা মুজিবÑ কী নেই তার কবিতায়! আবৃত্তির মঞ্চেও বিপুল জনপ্রিয় তিনি। বাচিক শিল্পীরা প্রতিনিয়ত তার কবিতা পড়ছেন। কবিতার আড্ডায় এই ক’দিন আগেও মধ্যমণি হয়ে ছিলেন মহাদেব সাহা। সাহিত্যের সভায় সভাপতিত্ব করতে হতো তাকে। কবিতা উৎসব উদ্বোধন করতে হতো। বন্ধু কবি, সাহিত্য সম্পাদকরা যখন তখন চলে আসতেন বাসায়। প্রকাশকরা আসতেন বই চাইতে। এভাবেই চলে যাচ্ছিল। কিন্তু এখন তিনি বয়সের ভারে ন্যুজ। বার্ধক্য কবি জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ স্বাচ্ছন্দ্য নিষ্ঠুরভাবে কেড়ে নিয়েছে। নানা রোগ বাসা বেঁধেছে শরীরে। খাবারের চেয়ে ওষুধ বেশি খেতে হয়। অথচ উপার্জন নেই। এসব কারণে একটু একটু করে নিজেকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছিলেন।

২০১৬ সালে আসে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা। ওই বছরের আগস্টে দেশ ছেড়ে কানাডায় পাড়ি জমান তিনি। উন্নত চিকিৎসা এবং কানাডা প্রবাসী ছেলের খরচ কমাতেই সস্ত্রীক তার কাছে চলে যেতে হয়েছিল। একজন কবির দেশ ছেড়ে যাওয়াকে নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন তিনি। তার বলাটি ছিল এরকম : ‘আমি মাঠে নেই। মাঠ ছেড়ে দিয়েছি। রেসে নেই। প্রতিযোগিতায় নেই। ভাগ্য মেনে নিয়েছি আমি।’ কিন্তু সেই ভাগ্য তাকে নিয়ে আরও খেলবে, হয়তো তখন বুঝতে পারেননি। বিদেশে যাওয়ার পর দেশের টান আরও প্রকট হয় কবির। দমবন্ধ লাগে। এ অবস্থায় ২০০১৮ সালের ২ অক্টোবর দেশে ফেরেন তিনি। এবার কবি আরও রিক্ত নিঃস্ব একাকী। প্রবাস জীবনের ইতি। ঢাকায় যে বাসাটি ছিল, নেই আর। শরীরের পুরনো অসুখগুলো আছে। নতুনও জুটেছে কিছু। সব মিলিয়ে তছনছ হয়ে যাওয়া জীবন।

এ জীবন নিয়ে তখন থেকে এখন পর্যন্ত, মানে, প্রায় পাঁচ বছর আড়ালে আছেন কবি। বাইরে বের হন না। কবিতার আড্ডায় সভা সেমিনারে পাওয়া যায় না তাকে। বাসার ঠিকানা অজানা। অথচ এই রাজধানী শহরেই কবি আছেন! তার ব্যাখ্যা : ‘দেখা দেব, সে অবস্থায় আমি নেই।’ অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, কবিকে কবিতার অঙ্গনে ফেরানোর কোনো উদ্যোগও কেউ গ্রহণ করেননি। তার বাসার ঠিকানা জানতে চান না কেউ। ফোন করে খোঁজ নিতেও আলস্য।গত ফেব্রুয়ারির একটা উদাহরণ টানা যেতে পারে। বইমেলায় দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল এক প্রকাশকের সঙ্গে। নাম করা প্রকাশক। তার প্রতিষ্ঠান থেকে দেশের জনপ্রিয় লেখক কবিদের বই নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। একই বিবেচনায় কবি মহাদেব সাহার কবিতা সমগ্র প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কয়েক খন্ড ইতোমধ্যে পাঠকের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। তবে এ পর্যায়ে এসে মনে হলো উৎসাহ ধরে রাখতে পারছেন না প্রকাশক। বেশ সামর্থ্যবান প্রকাশক বললেন, কাগজের যা দাম বেড়েছে, আমি এবার দাদাকে ‘না’ বলে দিয়েছি। বইমেলায় নতুন আরেক খন্ড আনতে পারব না।

এক সাহিত্য সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েও একই রকম অভিজ্ঞতা হলো। তিনি নিশ্চিত করেই বললেন, মহাদেব সাহার জন্মদিন উপলক্ষে কোনো লেখা তার বিভাগ থেকে প্রকাশিত হচ্ছে না। অন্য লেখার চাপ। তাই পরবর্তী সংখ্যায় এ বিষয়ে লেখা ছাপার পরিকল্পনা তার রয়েছে। হ্যাঁ, এভাবেই একলাটি হয়ে গেছেন মহাদেব সাহা। শুধু কবিতা বাঁচিয়ে রেখেছে তাকে। কবির ভাষায় বললে আরও গভীরভাবে বিষয়টা উপলব্ধি করা যাবে, যেখানে তিনি বলছেন, ‘আমি সারা জীবন কবিগিরি করেছি। কবিত্ব নয় শুধু। সার্বক্ষণিক কবি হওয়ার জন্য জীবনকে তছনছ করে দিয়েছি।’

ব্যক্তি জীবন তুচ্ছ করে, তছনছ করে দিয়ে কবিতায় বিলীন হয়ে যাওয়া, সে তো যে সে কথা নয়। কেন? কী আছে কবিতায়? উত্তরে কবি বলছেন, রবীন্দ্রনাথের গানের মতো কবিতাকে আমি মনে করি পৃথিবীর মাতৃভাষা। মানব সভ্যতার বিকাশে ও বিনির্মাণে কবিতার অবদান অসামান্য।’

বলার অপেক্ষা রাখে না, কবিতার আগে কবিকে অসামান্য হয়ে উঠতে হয়। এবং বহুকাল আগে মহাদেব সাহা নিজেকে অসামান্য প্রমাণ করেছেন। যাপিত জীবনের নির্যাস তার কবিতা। আবার কবিতাই তার জীবন। বাংলার পলিমাটির মতো নরম মন। কোমল স্বভাব। মহৎ আবেগ। পবিত্র বেদনা। সবই যেন কবিতার প্রয়োজনে লালন করে চলেছেন তিনি। কবিতার সঙ্গে সখ্য। কবিতার সঙ্গে ভাব ভালোবাসা।

মান অভিমানও এই এক কবিতার সঙ্গে। হয়ত তাই অবলীলায় তিনি বলতে পারেন, ‘কবিতা এক প্রতারক শিল্প। নিজেকে ক্ষয় করে করে কবিতা লিখতে হয়। কবিতা যেমন অপার সুখ তেমনি অপার দুঃখ। কবিতা হচ্ছে আজীবন দুঃখের তপস্যা।’ আজ জন্মদিনে মহাদেব সাহার তপস্যার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলি, শুভ জন্মদিন কবি। আজকের দিনটি অন্তত আনন্দে কাটুক আপনার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *