ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ: অর্থনীতিতেও রাখছে অবদান

জাতীয় বিদ্যুত ও জ্বালানি

শাওন মাহমুদ

আশরাফ আলী মোল্লা মাত্র তিন মাসের ছুটিতে এসেছেন সাত বছর পর। সঙ্গে এসেছে তার ছোটো ভাইও। যাকে আশরাফ আলী মোল্লাই ভিসার ব্যবস্থা করে তিন বছর আগে সৌদি আরবে তার কোম্পানিতেই নিয়েছিলেন। পিতামাতার পীড়াপীড়িতেই দুই ভাই একসঙ্গে এসেছেন ছুটিতে। মা-বাবার দাবি এবার আশরাফ আলীকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হবে।

মানিকগঞ্জের প্রত্যন্ত অ ল মগরা গ্রামের আশরাফ আলী যখন সাত বছর আগে সৌদি আরবে যান, তখন তার ভাবনায় ছিল না তাদের এলাকায় কখনো বিদ্যুৎ আসতে পারে। কিন্তু দেশে এসে বাজারে ‘স মিল, লেদ মেশিনসহ ছোটো-বড়ো কারখানা দেখে তার কাছে দিবাস্বপ্নের মতো মনে হয়। ঘোষণা দিলেন তিনি আর বিদেশে যাবেন না। হ্যালোবাইক বা অটো রিকশা প্রস্তুত ও মেরামত কারখানা দেবেন নিজ বাড়ির আঙিনায়। যেই ভাবনা, সেই কাজই করেন।

আশরাফ আলীর অতীতের অনেক কথা মনে পড়ে। বিশেষ করে একটি ঘটনার কথা আশরাফ আলী মনে করে আজও কষ্ট পান। ঘটনাটি তিনি বিদেশ যাওয়ার বেশ আগের। তার বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছে। দিন-তারিখ সব ঠিকঠাক। তাঁর বাবা চিন্তা করলেন বাড়িতে নতুন জামাই আসবে। তাই চিন্তা করলেন বাড়ির মেহগনির গাছটি কেটে একটা ঘর ও কিছু প্রয়োজনীয় আসবাব বানাবেন।

গাছ কেটে গোরুর গাড়ি দিয়ে মানিকগঞ্জ সদরে ‘স মিলে পাঠালেন। কিন্তু প্রায় এক মাসের মধ্যেও সেই গাছ আর চেরাই করতে পারেন না। যখনই খোঁজ নিতে যান, শুনেন বিদ্যুৎ আসেনি। দিনে এক-আধ ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ এলেও তাদের নিজেদের কাঠই চেরাই করা হয় না। অবশেষে সেই মেহগনি গাছের গুঁড়ি অর্ধেক দামে মিল মালিকের কাছে বিক্রি করে আসতে হয়। আশরাফ আলীদের দুই ভাইয়ের নতুন ঘরে তো থাকা হয়ইনি, উপরন্তু বোনের বিয়েতে শুধু থাকার ঘরের অভাবে অনেক আত্মীয়স্বজনও বিয়েতে আসেননি।

বর্তমানের অবস্থায় তাঁর মনে হচ্ছে তিনি যেন স্বপ্নরাজ্যে এসেছেন। বিদেশে থাকতেই এই আমূল পরিবর্তনের কথা শুনলেও তাঁর দেখে যাওয়ার দৃশ্য কখনোই পুরোপুরি দূর করতে পারেননি। যা দেশে এসে সে দেখছেন, এ অবস্থা ভাবনায় আনা তো বহুদূর!

শুধু আশরাফ আলীই নন, বিদ্যুৎ ব্যবস্থার এই আমূল পরিবর্তন হয়েছে সারা দেশেই। সমগ্র দেশ ও দেশের মানুষের এই পরিবর্তন এমনি এমনি হয়নি। হয়েছে একজন মানুষের অগ্রাধিকার পরিকল্পনা ও স্বপ্নের বাস্তবায়নের ফলে। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ বেশকিছু ক্ষেত্রে অভ‚তপূর্ব সাফল্য লাভ করেছে। টেকসই উন্নয়ন অর্জনেও বর্তমান সরকার নিরলসভাবে কাজ করছে। এমডিজি অত্যন্ত সফলভাবে অর্জনের পর এসডিজি অর্জনে ২০২১ সালের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ গড়ে তোলা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্যই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১০টি বিশেষ উদ্যোগ ব্র্যান্ডিং কার্যক্রম পরিচালিত। এ ১০টি বিশেষ উদ্যোগ একটি বাড়ি একটি খামার ও পল্লী স য় ব্যাংক, আশ্রয়ণ প্রকল্প, ডিজিটাল বাংলাদেশ, শিক্ষা সহায়তা কর্মসূচি, নারীর ক্ষমতায়ন, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, কমিউনিটি ক্লিনিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, বিনিয়োগ বিকাশ এবং পরিবেশ সুরক্ষা।

‘ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার। প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন কর্মসূচির তালিকায় এটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ক্ষেত্র। এ ক্ষেত্রটি আরও অনেক প্রকল্পের চালিকাশক্তি। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ, কর্মময় জীবন ও জীবিকার অবারিত পথ উন্মোচনে বিদ্যুতের বিরাট ভ‚মিকা। ঘরে ঘরে বিদ্যুতের ফলে গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা। কৃষিতেও এর ভ‚মিকা বিরাট। চাষবাসের বিভিন্ন যন্ত্র বা পানির সেচ ব্যবস্থাতেই এর ব্যবহার সীমাবদ্ধ নয়। খামারিরা তাঁদের গবাদি পশুর ঘাস/খাবার প্রসেসিং করছেন বিদ্যুৎচলিত যন্ত্রের মাধ্যমে। এতে সময় ও টাকা উভয়ই সাশ্রয় হচ্ছে। পোলট্রি খামারিরা খাবারের কাঁচামাল কিনে ছোটো ছোটো মেশিনে তা মোল্ডিং করে নির্ভেজাল পোলট্রি খাদ্য নিজেরাই তৈরি করছেন। এতে তাদের লাভের নিশ্চয়তা অনেক বেড়েছে। সারা দেশে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ যেন সারা দেশেটাকেই উৎপাদনের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে।

‘ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’, এটি একসময় ছিল উচ্চাভিলাষী স্বপ্ন, যা বাস্তবে রূপ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার ইচ্ছা ও নিরন্তর প্রচেষ্টায়। একসময় দেশের ৩০ শতাংশেরও কম মানুষ যখন বিদ্যুৎ ব্যবহার করত, তখনো নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ হতো না। বিদ্যুৎ সরবরাহ বা গ্রাহক বাড়াতে হলে নিশ্চয়ই এর উৎপাদনও বাড়াতে হবে। আমরা একসময় দেখেছি উৎপাদন না করে সরবরাহ করতে গিয়ে খাম্বা ও এর লাইন টানার কেলেঙ্কারি। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী যখন শতভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘোষণা দেন, তখন এবং এর আগে-পরের বিদ্যুৎ উৎপাদন অবস্থা দেখলে ধারণা স্পষ্ট হবে।
২০০৬ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ৩,৬০০ মেগাওয়াট। বর্তমানে যা বেড়ে উৎপাদনক্ষমতা হয়েছে ২৯,১৫২ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৫,৬৪৮ মেগাওয়াট (১৯ এপ্রিল ২০২৩)। গ্রাহক সংখ্যা ৪ কোটি ৬১ লাখ। মোট স ালন লাইন (সা.কি.মি.) ১৪,৯৪৮। বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী ১০০ শতাংশ।

‘ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ শুধু স্লোগান নয়, গণমানুষের দাবি। এ দাবিকে সামনে রেখেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিজ্ঞা ও তার বাস্তবায়ন। ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় আসার পর তাঁর সরকার এ লক্ষ্য নির্ধারণ করে। ২০২১ সালের মধ্যে সবার ঘরে আলো পৌঁছানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ভিশন ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার, ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য সরকার স্বল্প-মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ উৎপাদন, স ালন ও বিতরণ বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এক্ষেত্রটিতে সরকার দেশি-বিদেশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতায় যৌথ উদ্যোগে ব্যাপক প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছে। লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তে উল্লেখ করার মতো প্রকল্পগুলোর মধ্যে আছে বাগেরহাটের রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা বন্দর বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রভৃতি।

বিদ্যুৎপ্রাপ্তির সুফল :

জিডিপিতে ৭ শতাংশের যে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে, এতে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বিদ্যুতের অবদান ৫ শতাংশ।
কর্মঘণ্টাও বেড়ে গেছে।
গ্রামীণ, প্রত্যন্ত অঞ্চল, পাহাড়ি অঞ্চলে নিরাপত্তা বৃদ্ধি পেয়েছে।
শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণে সুবিধা হয়েছে।
প্রযুক্তি ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রযুক্তিলব্ধ আধুনিক জ্ঞান শতাধিক কাজে ব্যবহার করতে পারছে।
সেচ সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে।
কলকারখানায় কাজের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে।
ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ এখন আর স্লোগানে সীমাবদ্ধ নেই। প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক চেষ্টায় আজ তা একটি সফল কর্মসূচি। বিদ্যুৎ আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখে চলেছে। পিআইবি ফিচার

লেখক: সাংবাদিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *