সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবায় প্রান্তজনের আশার আলো হেলথ কার্ড

জাতীয় স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা

ইয়াসমীন রীমা

সম্প্রতি ‘পরিবারকল্যাণ সেবা ও প্রচার সপ্তাহ’ উপলক্ষ্যে আয়োজিত আলোচনাসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় এবার আমরা অন্তত পাঁচভাগ মা ও শিশু মৃত্যুহার কমাতে সক্ষম হয়েছি। ২০৩০ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার ৭০ শতাংশ কমিয়ে আনা এবং শিশুমৃত্যুর হার অর্ধেকে নামিয়ে আনতেও সক্ষম হতে হবে। যদিও দেশে এখন বছরে ৬৫ হাজার শিশু এবং সাড়ে ৪ হাজার মা মাতৃত্বকালীন মারা যান।’

পাবলিক হেলথ স্পেশালিস্ট এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) প্রোগ্রামের ডা. শবনম মোস্তারী বলেন, ‘উন্নত স্বাস্থ্যসেবা প্রদান এবং মা ও শিশুমৃত্যু রোধে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উদ্যোগে এবং এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই)-এর সহযোগিতায় স্মার্ট প্রেগনেন্সি মনিটরিং সিস্টেমটি চালু করা হয়েছে। সিস্টেমটি সন্তানসম্ভবা মা ও নবজাতকদের নিরাপত্তা ও সুস্থতার জন্য ধারাবাহিকভাবে গর্ভাবস্থা পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি গর্ভকালীন অবস্থার বিভিন্ন তথ্য সংরক্ষণ গর্ভকালীন প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান এবং জরুরি প্রয়োজনে স্বাস্থ্যকর্মীর কাছ থেকে সেবা গ্রহণ করতে পারবে।’

২০১৬ সালের ২৪ মার্চ টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী উপজেলায় পাইলট প্রকল্প কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে মধুপুর ও ঘাটাইল উপজেলায় কার্যক্রম সম্প্রসারণ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে টাঙ্গাইল জেলাসহ বরিশাল, বরগুনা, মানিকগঞ্জ, ল²ীপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম জেলা ও ঢাকা জাতীয় আর্থপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) হাসপাতালে দুই সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম শুরুর মাধ্যমে দেশব্যাপী সম্প্রসারণের প্রয়াস চলছে। বিনামূল্যে চিকিৎসাসংক্রান্ত বিষয়ে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক ডা. মো. এনামুল হক বলেন, ‘সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্বাস্থ্য তথ্য আদান-প্রদান এবং বাংলাদেশের নাগরিকদের স্বাস্থ্য তথ্য সংরক্ষণের একক প্ল্যাটফরম প্রস্তুত করার লক্ষ্য নিয়ে ‘শেয়ারড হেলথ রেকর্ড’ বাস্তবায়ন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) বিভাগের উদ্যোগে শুরু হয়েছে এই উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা।

স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা আরও সহজতর করতে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় এই হেলথ কার্ডধারী পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে (দুস্থ পরিবার) বসবাসকারী নাগরিক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ১১০টি রোগের চিকিৎসা নিতে পারবেন বিনামূল্যে। বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের নিজস্ব ‘হেলথ আইডি’ নম্বর থাকবে। সুনির্দিষ্টভাবে রোগ নির্ণয় করা, চিকিৎসাসেবার গুণগত মান বৃদ্ধি, নাগরিকের অর্থ ও সময় সাশ্রয়, চিকিৎসাব্যবস্থা আরও সুশৃঙ্খল, সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখবে হেলথ কার্ড। বোগীদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব স্বাস্থ্যসেবার তথ্য সংরক্ষিত থাকবে এই ডিজিটাল ডেটাবেজ। পূর্বের চিকিৎসা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাগজ হারানোর ভয় থাকবে না। অনলাইনেই থাকবে সব তথ্য। শুধু হেলথ কার্ডের বদৌলতেই রোগী পেয়ে যাবেন প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা। অনলাইনে ঘরে বসেই রোগী হাসপাতালে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে পারবেন। সমগ্র সম্ভাব্য প্রক্রিয়ায় রোগীর তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। সরকারি হাসপাতালই নয়, হেলথ কার্ডের আওতায় আসবে বেসরকারি হাসপাতালগুলোও। তবে অবশ্যই বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালটির স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন থাকতে হবে। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের পরিচালক (গবেষণা) ড. সৈয়দা নওশীন বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি স্বল্প আয়তনের জনবহুল দেশ। পরিবেশদূষণ, বাঙালির ভোজনপ্রিয়তা, সুস্বাস্থ্য ও পুষ্টি সম্পর্কে উদাসীনতা প্রভৃতি কারণে আমাদের দেশের মানুষ বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। মানুষের আয় বৃদ্ধির সঙ্গে বেড়েছে চিকিৎসাব্যয়। প্রতিটি পরিবারের আয়ের একটি বড়ো অংশ চিকিৎসা খাতে ব্যয় হচ্ছে। যে কারণে পরিবারের কোনো সদস্য অসুস্থ হলে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারে নেমে আসে অসহনীয় বিপর্যয়। দুস্থ পরিবার যাতে বিনামূল্যে চিকিৎসা পেতে পারে, সেজন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে চিকিৎসা নিতে রোগীর মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় হয় ৬৮.০৫ শতাংশ। প্রতিবছর আনুমানিক ১৬.০৪ শতাংশ পরিবার প্রয়োজন থাকা সত্তে¡ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বিরত থাকে এবং চিকিৎসা গ্রহণকারী ২৪.০৬ শতাংশ (পরিবারের মোট আয়ের ১০ শতাংশ ভিত্তিতে) পরিবার বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্যব্যয়ের সম্মুখীন হয়।’

২০৩২ সালের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ চালু করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট। দেশের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে যে কোনো ধরনের আর্থিক পরিস্থিতিই হোক, যখন এবং যেখানে প্রয়োজন প্রত্যেক নাগরিকের উন্নতমানের স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ সিস্টেম। ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) পরিচালক অধ্যাপক শাহাদাত হোসেন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচির উদ্দেশ্যে ব্যবস্থাপনা, কার্যক্রম, সেবা গ্রহণের সুযোগ এবং মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ প্রক্রিয়া বিষয়ে জানান, ‘হাসপাতালে আন্তঃবিভাগীয় সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে দরিদ্র জনসাধারণের জন্য বিদ্যমান আর্থিক প্রতিবন্ধতা দূর করা এই কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য। জেলা হাসপাতাল স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়ন কমিটি এবং উপজেলা হাসপাতাল স্বাস্থ্যরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়ন মাসিক সভার অগ্রগতি পর্যলোচনা করাসহ মাঠ পর্যায়ে প্রশিক্ষিত কর্মীরা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারের তালিকা প্রস্তুত করার জন্য মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করবেন। যেখানে প্রতিটি ইউনিয়নের জন্য ১০ জনের একটি জরিপ দল গঠন করা, নয়টি ওয়ার্ডের জন্য নয়জন এবং তাদের সহযোগী সুপারভাইজার একজনসহ ১০ জন সদস্য নির্বাচন করা হবে। এসব কর্মী প্রতিটি দরিদ্র পরিবারকে স্কোর প্রদান করবে। একটি পরিবার শূন্য থেকে সর্বোচ্চ ৫০ পর্যন্ত স্কোর পেতে পারেন। তবে কুড়ি বা তার নিচে স্কোরপ্রাপ্ত পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে (বিপিএল) বসবাসকারী পরিবার হিসাবে গণ্য হবেন। এই স্কোরের নাগরিকরাই বিনামূল্যে চিকিৎসা সুবিধা পাবেন।

বাংলাদেশ রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে দেশের সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধায় স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠা করা। সুস্থ মানুষ উন্নয়নের সহায়ক। স্বাস্থ্যসেবা হলো গুণগত সেবা। কোভিড-১৯ অতিমারি-পরবর্তী টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) বাস্তবায়ন নীতিমালার মধ্যে রয়েছে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও দারিদ্র্য বিমোচন। দেশের সর্বস্তরের মানুষ গুণগত রোগ প্রতিরোধ, রোগ নিরাময় পুনর্বাসন ও প্রশমণমূলক সেবা পাবেন, যাতে বড়ো ধরনের অগ্রগতি হবে জনগণের জীবনযাত্রায়। (পিআইবি ফিচার)

লেখক: সাংবাদিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *