সুবর্ণবাঙলা অনলাইন ডেস্ক
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) নিয়মিত যাতায়াত ছিল ধর্ষণের ঘটনায় মূল পরিকল্পনাকারী মামুনুর রশীদ মামুনের। বহিরাগত হলেও মাঝেমধ্যেই থাকত বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলে। কক্সবাজার থেকে ইয়াবা এনে বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় বিক্রি করত। মীর মশাররফ হোসেন হল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ও পার্শ্ববর্তী বটতলা বাজার ছিল মামুনের ইয়াবা বিক্রির হটজোন।
বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এ তথ্য জানান। রাজধানীর কাওরান বাজারে সংস্থাটির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
ধর্ষণের ঘটনায় হওয়া মামলায় গত বুধবার মামুনকে রাজধানীর ফার্মগেট থেকে এবং মো. মুরাদ নামে আরেক আসামিকে নওগাঁ থেকে গ্রেফতার করে র্যাব।
জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাতে কমান্ডার মঈন বলেন, ‘মামুন প্রায় ২০ বছর আগে জুরাইন এলাকায় গার্মেন্ট কর্মী হিসাবে চাকরি শুরু করে। পরবর্তীতে সে আশুলিয়া এলাকায় এসে গার্মেন্টে চাকরির পাশাপাশি মাদক ব্যবসায় জড়িত হয়। মাদককে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু মাদকসেবী শিক্ষার্থীর সঙ্গে তার সখ্য তৈরি হয়। এরপর ২০১৭ সাল থেকে সে পুরোপুরি মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় মাদক সংক্রান্ত আটটি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় একাধিকবার কারাভোগও করেছে সে।’
র্যাব জানায়, মামুন ২০১৭ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালী শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকায় মাদক কারবার করে আসছে। এছাড়া ক্যাম্পাসে আগেও সে নারী নিপীড়ন, ধর্ষণসহ শ্লীলতাহানির ঘটনায় জড়িয়েছে। তার ভাষ্য অনুযায়ী, ধর্ষণের মতো ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে হরহামেশাই ঘটে। মামুন নিজেও আগে কয়েকবার সিনিয়র শিক্ষার্থীদের আবদারের প্রেক্ষিতে অন্য মেয়েদের ডেকে এনে ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়মিত নারী সরবরাহ করতো মামুন।
কমান্ডার মঈন বলেন, ‘বেশি দিন এক স্থানে থাকত না সে। মাদক বিক্রির সুবাদেই ধর্ষণ মামলার এক নম্বর আসামি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে তার সখ্য তৈরি হয়। আর একই এলাকায় বসবাসের সুবাদে পরিচয় হয় ভুক্তভোগী নারীর স্বামীর সঙ্গে। তবে মাদক কারবারের কারণে কিছুদিন পূর্বে গ্রেফতার মামুনের থাকার জায়গার সমস্যা সৃষ্টি হয়। তখন সে ওই দম্পতির সঙ্গে একটি বাসায় সাবলেট থাকে।’
তিনি বলেন, ‘ধর্ষণের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বিভিন্ন সময় মাদক ও ধর্ষণসহ নানা অপরাধের ঘটনা ঘটে। মামুনের মতো লোকজন শিক্ষার্থীদের নষ্ট করছে। তার মতো লোকেরাই নিজেদের স্বার্থে, নিজেরাই অপকর্ম করার জন্য শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছে। এসব ঘটনায় বহিরাগতদের প্রবেশের দায় কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে।’
এছাড়াও এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার যুগান্তরের অনুসন্ধানে উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ভুক্তভোগী ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা দরে প্রতি পিস ইয়াবা আনত মামুন। এ ছাড়াও চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ থেকে প্রতি পিস ইয়াবা আনত ৮০ থেকে ৮৫ টাকা দরে। এসব ইয়াবা সে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে কয়েকটি হটস্পটের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে প্রতি পিস ৩শ’ টাকা দরে বিক্রি করত। এসব হটস্পট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে ইয়াবা সরবরাহের দায়িত্বে থাকত ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলে মামুনের সরবরাহকারী হিসাবে দায়িত্ব পালন করত ধর্ষণের ঘটনায় অপর অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর রহমান। নয়ারহাটের দায়িত্বে টিটু, বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী বটতলা বাজারে নুরু, কলমাতে মামুনের ভাগ্নে আতিক, বিশমাইলে হাসান। এসব ব্যক্তি এসব হটস্পটের সরবরাহকারী হিসাবে দায়িত্ব পালন করত। এছাড়াও জনি নামে অপর এক ব্যক্তিও মামুনের মাদক সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, মামুনের চট্টগ্রামের সরবরাহকারী ছিল আরিফ নামে এক ব্যক্তি এবং কক্সবাজারের সরবরাহকারী ছিল সাইফুল ইসলাম বাপ্পী নামে অপর এক ব্যক্তি। মাদক (ইয়াবা) কারবারের সঙ্গে জড়িত মামুনকে বেশ কয়েকবার যেতে হয়েছে কারাগারে। কারাগার থেকে বেরিয়ে সে পুনরায় মাদক (ইয়াবা) ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ত। মামুনের বিরুদ্ধে মিরপুর মডেল থানা, বগুড়া সদর থানা, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানা এবং কক্সবাজারের টেকনাফ থানায় পৃথক চারটি মাদক মামলা রয়েছে।
এদিকে স্বামীকে মীর মশাররফ হোসেন হলের কক্ষে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনার বিচার দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার সকালে শহিদ মিনারের সামনের সড়কে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, ঢাকা জেলা মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে।
সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা এলাকায় পূর্বঘোষিত চার দফা দাবিতে নিপীড়নবিরোধী জনসংযোগ করে ‘নিপীড়নবিরোধী মঞ্চ’। এছাড়া ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিতের দাবিতে মশাল মিছিল করেছে অন্য একদল শিক্ষার্থী।
অপরদিকে ধর্ষণের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গৃহীত পদক্ষেপ ও সার্বিক বিষয়ে পর্যালোচনা করতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) গঠিত তিন সদস্যের একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে।