আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতাহার : বাস্তবায়নে কতিপয় দিক

জাতীয় রাজনীতি

পিআইবি ফিচার

বোরহান বিশ্বাস

বাংলাদেশের প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ প্রতিটি নির্বাচনি ইশতাহারেই জাতির সামনে আশাজাগানিয়া এবং অনুপ্রেরণামূলক স্লোগান নিয়ে আসে। যে কারণে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে আলাদা একটি আগ্রহ থাকে দলটির নির্বাচনি ইশতাহার নিয়ে। যেমন: ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাদের ইশতাহারের স্লোগান ছিল ‘দিনবদলের সনদ’। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের স্লোগান ছিল ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’। ২০১৮ সালে একাদশ নির্বাচনের স্লোগান ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’। আর এবারের অর্থাৎ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তারা স্লোগান নির্ধারণ করেছিল ‘স্মার্ট বাংলাদেশ: উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’। লক্ষ করলে দেখা যাবে, প্রতিটি স্লোগানই নির্ধারিত হয়েছে জনকল্যাণের জন্য অন্তর্নিহিত কিছু বিষয় থেকে। সেই স্লোগানকে সামনে রেখে তাকে সময়ের ফ্রেমে বেঁধে দেশকে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই যার মূল লক্ষ্য।কৃষক, শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, শ্রমজীবী মানুষসহ সমাজের নিম্ন-আয়ের মানুষের প্রতিনিধিদের মতামত চেয়ে নির্বাচনের প্রায় তিন মাস আগে তৃণমূল আওয়ামী লীগকে চিঠি দেয় দলের নির্বাচনি ইশতাহার প্রণয়ন উপকমিটি। নির্বাচনি ইশতাহারে তাদের প্রত্যাশা কী এবং কোন কোন বিষয় ইশতাহারে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, সেগুলো পাঠাতে বলা হয়। এ কার্যক্রম থেকেই বোঝা যায় যেনতেনভাবে ইশতাহার প্রণয়ন নয়, গণমানুষের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন যাতে ঘটে, সেদিকেই আওয়ামী লীগ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে।

আওয়ামী লীগ এবারের নির্বাচনি ইশতাহারে যে ১১টি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়েছিল, তার প্রথমেই ছিল ‘দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা’।দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জয়ী হলে আওয়ামী লীগ দ্রব্যমূল্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসবে বলে প্রতিশ্রæতি দিয়েছিল। তবে করোনা মহামারির ফল, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমানে ধস, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, আমদানিনির্ভর দ্বিতীয় খাদ্যশস্য গমের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি, নিম্নমুখী রেমিট্যান্স, জাতীয় নির্বাচন নিয়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কাসহ নানাবিধ কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি হয়; যা সাধারণ মানুষের জীবনকে একরকম দুর্বিষহ করে তোলে। নির্বাচনি বৈতরণি পার হয়ে আবারও সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। নবগঠিত
সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের একগুচ্ছ নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টির ওপর তিনি জোর দেন তা হলো মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য। মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রধানমন্ত্রী সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের নির্দেশনা দেন। বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নির্বাচনি যে ইশতাহার দেওয়া হয়েছিল, সে মোতাবেক সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেওয়া হয়। ইশতাহারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত বিষয়গুলো ভিত্তি করে কর্মপরিকল্পনা নেওয়ার পাশাপাশি তা বাস্তবায়ন ও মনিটরিং করার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।

২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় ইশতাহারে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে রূপকল্প-২০২১ ঘোষণা করেছিল আওয়ামী লীগ। তখন রাজনৈতিক বিরোধীদের পাশাপাশি সুশীলসমাজের একটি অংশও এর কঠোর সমালোচনা করেছিল। ডিজিটাল বাংলাদেশকে ‘কাল্পনিক’, ‘অবাস্তব’ এবং ‘উচ্চাভিলাষী’ বলেও মন্তব্য করেছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু সবকিছুর পাশ কাটিয়ে ২০২১ সালের মধ্যেই ডিজিটাল বাংলাদেশকে বাস্তবে রূপ দেয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। সেই বিষয়টিকে সামনে রেখেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যে ইশতাহার ঘোষণা করা হয় তাতে তারুণ্যবান্ধব স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের কথাও জোর দিয়ে বলা হয়। নির্বাচনের দুই বছর আগ থেকে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের বক্তব্যেও স্মার্ট বাংলাদেশের বিষয়টি বারবার উঠে আসে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘২০৪১ সাল নাগাদ আমাদের দেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ।’ যে কারণে ডিজিটাল বাংলাদেশের পর স্মার্ট বাংলাদেশের পরিকল্পনা শতাব্দীর সবচেয়ে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো ইতোমধ্যেই স্মার্ট দেশে রূপান্তরিত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) চেয়ারপারসন সজীব ওয়াজেদ তাঁর এক বক্তব্যে উল্লেখ করেন, ডিজিটাল বাংলাদেশের পর এখন বাংলাদেশকে আরও ‘আপগ্রেডের’ সময় চলে এসেছে।

এতদিন দেশের সব কাজকে ডিজিটালাইজড করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও এবার এর থেকেও বড়ো পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। অর্থাৎ ডিজিটালাইজড এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এবার প্রয়োজন সমন্বিত সেবা ও এর মানোন্নয়ন। আর এ কারণেই এখন আমাদের আইসিটি ক্ষেত্রে দক্ষ অর্থাৎ বিশেষজ্ঞ তৈরি করতে হবে, যারা স্মার্ট বাংলাদেশের হাল ধরবে এবং এগিয়ে নিয়ে যাবে। এবারের নির্বাচনি ইশতাহারে স্মার্ট বাংলাদেশের পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে আওয়ামী লীগ। এরই মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তাদের দলীয় কার্যক্রম থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

মনোনয়নেও সে অবস্থানের প্রতিফলন ঘটেছে। এই দুর্নীতিবাজদেরই একটি অংশ দ্রব্যমূল্যের অস্থিতিশীল অবস্থার জন্য দায়ী বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। আওয়ামী লীগের ইশতাহার প্রণয়ন কমিটির সদস্য সাব্বির আহম্মেদ বলেছেন, ‘ইশতাহারে একেবারে হুট করে বা নতুন করে কিছু আসেনি। এই ইশতাহার তৈরি হয়েছে তিনটি নির্বাচনের ইশতাহারের ধারাবাহিকতায়। ফলে হুট করে নতুনকিছু আনার সুযোগ এখানে নেই এবং খুব একটা পার্থক্য আগেরটার সঙ্গে পাওয়া যাবে না। বরং এটিকে বলা যায় মূলত ধাপে ধাপে বাংলাদেশের অগ্রগতির একটি স্মারক’ (বিবিসি বাংলা)।

তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এখন মনে করে শিল্পোন্নত হওয়ার দিকে যাত্রা শুরুর জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষিত জনবল আর অবকাঠামোর যে প্রয়োজনীয়তা ছিল সেটি অর্জন হয়েছে। সে কারণে কৃষির অগ্রগতি থাকবে, কিন্তু এখন থেকে ক্রমশ হালকা, মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদে ভারী শিল্পের কথা চিন্তা করে নীতিমালা দেওয়া হয়েছে।’

সাব্বির আহম্মেদ বলেন, ‘এখানে কিছু পার্থক্য এসেছে, কারণ আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশের কাজ শুরু করে একটা পর্যায়ে দেশকে নিয়ে এসেছে। অনেক উদ্যোগের ফলে একটি স্মার্ট সমাজের ভিত্তি তৈরি হয়েছে। এ কারণেই এবার স্মার্ট বাংলাদেশের এসেছে’ (বিবিসি বাংলা)।
তবে আওয়ামী লীগের সব অর্জনের সামনে প্রশ্ন দাঁড় করিয়ে দেয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিষয়টি। এবারের রমজানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি প্রতিরোধে
সরকারের নানামুখী ব্যবস্থা নেওয়া ছিল চোখে পড়ার মতো। তারপরও দাম যেন কমছে না। রমজানে যারা কারসাজি করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র‍্যাব) নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

রমজান ও ঈদকে কেন্দ্র করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে প্রয়োজনে পরিবহণ ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়া হবে বলে জানিয়ে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছেন, কোনো ব্যবসায়ী নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করলে ভোক্তারা ৩৩৩ হটলাইনে অভিযোগ জানাতে পারবেন। সর্বশেষ পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সমন্বয়হীনতা নেই উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, আমরা এখন সমন্বিতভাবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, ভোক্তা অধিদপ্তর, ইউএনও, ডিসিÑসবাই মিলে সমন্বয় করব। সিয়াম সাধনার মাসে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস বিভাগের অতিরিক্ত আইজিপি মো. আতিকুল ইসলাম। জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেছেন, সরকার দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি প্রতিরোধে আন্তরিকভাবে কাজ করছে। তিনি বলেন, রমজানের চাহিদা বিবেচনায় ইতোমধ্যে কয়েকটি পণ্যের আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে। তবে ভোক্তা পর্যায়ে এর সুফল পেতে কিছুটা সময় লাগবে।
এদিকে চালের দাম নিয়ে কারসাজি বন্ধে মিলগেট মূল্য চালের বস্তায় লেখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। মিলগেট থেকে যখন চাল সরবরাহ করা হবে, তখন বস্তার গায়ে সরবরাহের তারিখ ও মূল্য লেখা থাকবে। খাদ্য মন্ত্রণালয় চাল ও গমের বাজারদর নির্ধারণ করে দেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশমতে কিছুদিন আগে খাদ্য, কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটি যৌথ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের ক্রমাগত অপতৎপরতা নিয়ে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আমরা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছি। সরকার নিষ্ক্রিয় নয়।

দ্রব্যমূল্য লাগামের মধ্যে রাখতে সরকার সক্রিয়। প্রধানমন্ত্রী সারাক্ষণ দেশের এই সংকট মোকাবিলায় সময় দিচ্ছেন। নির্বাচনি ইশতাহারে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া ‘দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ’ করা সরকারের এখন অন্যতম চ্যালেঞ্জ। দেশের উন্নয়নে সরকারের ধারাবাহিকতা যেমন প্রয়োজন, তেমনই জনমানুষের চাহিদা পূরণও সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। মানুষের প্রথম মৌলিক চাহিদা ‘খাদ্য’। সেদিকে লক্ষ রেখেই আওয়ামী লীগ এবার তাদের নির্বাচনি ইশতাহারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি উল্লেখ করেছে।

স্বপ্নের স্বাধীনতা যেমন বাস্তবে রূপ পেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে, তেমনই পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, পদ্মা সেতু, উড়াল সেতু, সমুদ্রে নিচে টানেল
নির্মাণের মতো স্বপ্নও সত্যি হয়েছে শেখ হাসিনার হাত ধরে। অনেক অসম্ভবকে যিনি সম্ভব করতে পারেন, জনগণের বেঁচে থাকার প্রথম শর্তটিও তিনি নিশ্চয়ই পূরণ করবেনÑএমন প্রত্যাশা আপামর মানুষের। (পিআইবি ফিচার)

(লেখক: সাংবাদিক, দৈনিক জনকণ্ঠ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *