শিকারনিষিদ্ধ মাছ প্রকাশ্যে বিক্রি

জাতীয় মফস্বল

মনিরুল হায়দার ইকবাল

সুন্দরবনের বিপন্ন প্রজাতির শিকার নিষিদ্ধ শাপলাপাতা মাছ প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে

মোংলা বাজারে অবাধে ঢুকছে শিকার নিষিদ্ধ বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ। প্রকাশ্যে এসব মাছ বিক্রি হলেও সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয় না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মৎস্য ও বন কর্মকর্তাদের উদাসীনতা এবং নজরদারির অভাবে সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগর থেকে বিপন্ন প্রজাতির এসব মাছ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে মোংলা মাছ বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সুন্দরবনের বিপন্ন প্রজাতির শিকার নিষিদ্ধ শাপলাপাতা মাছ ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

মোখলেছুর রহমান নামে এক ক্রেতা বলেন, কোন মাছ নিষিদ্ধ সেটা তাঁরা জানেন না, বিক্রেতারা বিক্রি করছেন তাই তিনি কিনছেন। তিনি দেড় কেজি শাপলাপাতা মাছ ৯০০ টাকায় কিনেছেন বলে জানান।

শাপলাপাতা মাছ বিক্রেতা রমজান আলীর ভাষ্য– বাজারের আড়তদারদের কাছ থেকে কিনে খুচরা বাজারে বিক্রি করছেন তিনি। আড়তে না এলে এই মাছ তার পক্ষে কিনে বিক্রি করা সম্ভব হতো না। এ মাছ বিক্রি নিষিদ্ধ জেনেও কেন বিক্রি করছেন– জানতে চাইলে তিনি জবাব দেননি।

শুধু শাপলাপাতা মাছ নয়, এর পাশাপাশি শিকার নিষিদ্ধের তালিকায় থাকা হাঙ্গর, কাইন, বাইন, শুশুকসহ বিপন্নপ্রায় অন্যান্য প্রজাতির নানা ধরনের মাছ ও জলজপ্রাণী প্রতিদিনই প্রকাশ্যে মোংলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে। সমুদ্র ও সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী থেকে ধরা বিপন্ন প্রজাতির এসব মাছ সুস্বাদু হওয়ায় অনেক ক্রেতাই চড়া মূল্যে কিনে থাকেন।

এ বিষয়ে মোংলা মৎস্য বাজার সমবায় সমিতির সভাপতি আফজাল ফরাজির কাছে জানতে চাওয়া হয়। তাঁর দাবি, তাঁরা নিষেধ করলেও আড়তদাররা কথা শোনেন না। ফলে বাজারে অনেক খুচরা বিক্রেতা এসব মাছ বিক্রি করে থাকেন। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

তিনি জানান, এ বিষয়ে কখনও বাজার মনিটরিং হয়নি। তবে ২০২১ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বন বিভাগের পক্ষ থেকে আড়তদার ও খুচরা বিক্রতাদের সচেতন করতে পোস্টারিং ও মাইকিং করা হয়েছিল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক আড়তদার বলেন, অন্যান্য মাছের সঙ্গে শিকার নিষিদ্ধ মাছ জেলেরা তাঁদের কাছে বিক্রি করতে নিয়ে আসেন। তখন ব্যবসার খাতিরে জেলেদের কাছ থেকে এসব মাছ কিনতে অনেকে বাধ্য হন। এ ছাড়া বাজারে চাহিদার কারণেও তাঁরা এসব মাছ কেনেন। তবে কখনও তারা বন বিভাগের অভিযানের মুখে পড়েননি।

জেলেদের নেতা কার্তিক দাস বলেন, অন্যান্য মাছের সঙ্গে শিকার নিষিদ্ধ এসব মাছও তাঁদের জালে ধরা পড়ে। কোনো আড়তদারই তাঁদের কাছ থেকে এসব মাছ কিনতে অনীহা প্রকাশ করেন না। এগুলো যে শিকার করা নিষিদ্ধ– তা আগে না জানলেও এখন তাঁরা জানেন।

মোংলা উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম জানান, শিকার নিষিদ্ধ সামুদ্রিক মাছ বাজারে বিক্রি হলেও এ ব্যাপারে তাঁদের কিছু করার নেই। এটা রোধ করা ও ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব বন বিভাগের ওপর বর্তায়।

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বনের জলভাগে হাঙ্গর, কাইন, বাইন, শাপলাপাতা, শুশুক ও ডলফিনসহ বিলুপ্তপ্রায় কয়েক প্রজাতির মাছ ও জলজপ্রাণী রয়েছে। এগুলো শিকার, আহরণ, পরিবহন, মজুত ও বিক্রি সম্পূর্ণ বেআইনি বলে বন বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। আইন ভেঙে এসব বিপন্ন প্রজাতির মাছ ধরাসহ অন্যান্য কাজ করলে শাস্তির ব্যবস্থাও রয়েছে। কিন্তু প্রতিদিনই আইন ভেঙে অবৈধভাবে এসব মাছ সাগর ও সুন্দরবন থেকে শিকার করে নদীপথ হয়ে মোংলা বাজারে আসছে।

মোংলা বাজার মনিটরিং কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) মোংলার সমন্বয়কারী নুর আলম শেখ বলেন, শিকার ও বিক্রি নিষিদ্ধ জেনেও বিক্রেতারা অতি মুনাফার লোভে অবাধে এসব প্রজাতির মাছ বিক্রি করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে তিনি বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের উদাসীনতা ও কঠোর নজরদারির অভাবকে দায়ী করেন।

এ বিষয়ে পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) রানা দেব বলেন, তাঁদের অফিস থেকে মোংলা বাজার ২০ কিলোমিটার দূরে। সময়মতো সেখানে গিয়ে অভিযান চালাতে পারেন না। পৌঁছানোর আগেই ব্যবসায়ীরা মাছ বিক্রি করে ফেলেন। তিনি বলেন, বন্যপ্রাণী আইন ২০১২ অনুযায়ী শিকার নিষিদ্ধ এসব মাছ ধরা, পরিবহন, সংরক্ষণ, বেচাকেনা করলে জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে।

তবে পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, যেসব মাছ ব্যবসয়ী এই অবৈধ কাজ করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়। এর পরও বন বিভাগের চোখ ফাঁকি দিয়ে নদীপথে বিপন্ন প্রজাতির এসব মাছ বাজারে আসছে। এ ব্যাপারে আরও কঠোর অভিযান চালানো হবে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আব্দুর রউফ বলেন, সুন্দরবন এবং বঙ্গোপসাগর থেকে বিপন্ন প্রজাতির মাছ আহরণ ঠেকাতে সংশ্লিষ্টদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে এবং জেলেদের সচেতন করতে হবে। তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবন থেকে এ জাতীয় মাছ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।(সৌজন্যে: সমকাল)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *