‘আমার বাড়ি, আমার খামার’ প্রকল্প, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আত্মকর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখছে’

অন্যান্য জাতীয় হোম

পিআইবি ফিচার


এমরানা আহমেদ

নীলফামারী সদর উপজেলার হাটখোলা ইউনিয়নের হরিবল্লভ গ্রামের রিমি বেগম এখন একজন সফল নার্সারি উদ্যোক্তা। তিন কন্যাসন্তানের মা রিমি বেগম এখন এক আত্মপ্রত্যয়ী সংগ্রামী নারী হিসাবে তাঁর এলাকায় বেশ সুপরিচিত। ৭ ফেব্রুয়ারি সরেজমিন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপচারিতায় রিমি জানান, ‘সংসারের অভাব-অনটন যখন তাঁকে ঘিরে ধরে, তখনই তাঁর সামনে উপায় হিসাবে এলাকায় সরকারের ‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের কর্মসূচি’ বাস্তবায়নের সুযোগ আসে’। আলাপচারিতায় আত্মপ্রত্যয়ী রিমি বেগম বলেন, ২০১২ সালের শুরুতেই আমি হরিবল্লভ হাঠাপাড়া গ্রাম ইউনিয়ন সমিতির সদস্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হই এবং নিয়মিত স য় জমাতে শুরু করি। একপর্যায়ে সমিতির সদস্যদের মধ্যে বিনিয়োগের যোগ্য পুঁজি গঠিত হলে সদস্যদের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে নার্সারি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথমবার ১০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করি। মাত্র ১০ শতাংশ জমি লিজ নিয়ে শুরু করি নার্সারি ব্যাবসা, সেটাই আলোর মুখ দেখায় আমায়। দ্বিতীয়বার ১৫ হাজার, তৃতীয়বার ২০ হাজার এবং সর্বশেষ ২৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে বছরান্তে নার্সারির পরিধি বৃদ্ধি করে ক্রমাগতভাবে বাড়তি আয়ের পথ সুগম করি। এই প্রতিবেদকের মাধ্যমে রিমি বেগম জানান, ‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের সহজ শর্তে ঋণ এবং নিজেদের পুঁজি গঠনের মধ্য দিয়ে সরকারের আত্মকর্মসংস্থানের এ উদ্যোগ দরিদ্র মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১০টি বিশেষ উদ্যোগের প্রথমটি হচ্ছে, ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্প। গ্রামের দরিদ্র মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে সরকারের এ প্রকল্প একটি বিপ্লবে পরিণত হয়েছে। ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পটি ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের জুন মাস মেয়াদে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০০৯ সালের নভেম্বরে একনেক কর্তৃক অনুমোদিত হয়। ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের নাম পরবর্তী সময়ে ‘আমার বাড়ি, আমার খামার’ রাখা হয়। প্রাথমিক জরিপের ভিত্তিতে গ্রামের দরিদ্র মানুষের জন্য সমবায়ভিত্তিক ‘গ্রাম উন্নয়ন সংগঠন’ সৃষ্টি করে সদস্যদের দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, ঋণ, অনুদান ও কারিগরি সহায়তা দেওয়া হয় এবং সেই সঙ্গে দরিদ্রদের মধ্যে দুগ্ধবতী গাভি, মৎস্য, হাঁস-মুরগি ও ফসলের বীজ বিতরণ করা হয়। এ প্রকল্পের ভিশন হচ্ছে নিজস্ব পুঁজি গঠন ও বিনিয়োগে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং জীবন-জীবিকায়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসন ও টেকসই উন্নয়ন। ‘আমার বাড়ি, আমার খামার প্রকল্প’ পল্লী স য় ব্যাংকের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। এ ব্যাংকের ৪৯ শতাংশ অংশের মালিক এ প্রকল্পের উপকারভোগীরা। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এই বিপ্লবের মূল সুর হচ্ছে ‘দিনবদলের স্বপ্ন আমার বাড়ি, আমার খামার’।

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের আওতায় সমিতি গঠন হয়েছে ১ লক্ষ ২০ হাজার ৩২৫টি, উপকারভোগী সদস্য পরিবার ৫৬ লাখ ৭৭ হাজার, সদস্য স য় ২ হাজার ৮৬ কোটি টাকা, সরকার প্রদত্ত বোনাস ২ হাজার কোটি টাকা, ঘূর্ণায়মান তহবিল ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা, মোট ঋণ গ্রহণকারী উপকারভোগীর সংখ্যা ৪৫ লাখ ৯৩ হাজার জন, মোট ঋণ বিতরণ ১১ হাজার ৪১ কোটি টাকা, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা উন্নয়ন ঋণ বিতরণ ৪৯০ কোটি টাকা, প্রকৃত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আয়বর্ধক খামারের সংখ্যা ৩৩ লাখ ৭৩ হাজার, মোট তহবিল ৭ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা (৩০ জুন ২০২১ পর্যন্ত)।

প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, জাতিসংঘ ২০১৬ সাল থেকে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়ন শুরু করেছে। এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ১১টিই বাংলাদেশের প্রস্তাবিত। প্রধানমন্ত্রীর মস্তিষ্কপ্রসূত ১০টি বিশেষ উদ্যোগ আর এসডিজি মূলত একই সূত্রে গাঁথা। এই ১০টি উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ‚তপূর্ব উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ মধ্যবিত্ত আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে।

প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের আশা, দেশের বর্তমান দারিদ্র্যে হার ২২ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে ১৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে এ প্রকল্প বিশেষ ভ‚মিকা পালন করবে। একই সঙ্গে ২০২৫ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্যের হার ৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে কাজ করছে এই প্রকল্প। প্রকল্পটি গ্রহণের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তৃণমূলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সংগঠিতকরণ, তাদের স য়ে উৎসাহ দেওয়া, সদস্যের স য়ের বিপরীতে সমপরিমাণ অর্থ বোনাস দেওয়া, সদস্যদের প্রশিক্ষণ, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় পুঁজি গঠনে সহায়তা এবং আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করাসহ বহুমুখী কর্মকাণ্ড পরিচালনা। এসব উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প’ হাতে নেয়। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ২০০১ সালে প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে প্রকল্পটি ফের চালু করা হয়।

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম এমপি জানান, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) সাফল্যের পর ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) বাস্তবায়নের পথে অগ্রসরমান দেশ। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর দেশের সব মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশেষ কিছু উদ্যোগ হাতে নেন। তার মধ্যে ১০টি বিশেষ উদ্যোগ জনগণের জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ ভ‚মিকা রাখছে। অষ্টম পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনায়ও এ ১০টি বিশেষ উদ্যোগ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মন্ত্রী তাজুল ইসলাম আরও জানান, ২০২৫ সালের মধ্যে বর্তমানে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা এক কোটি পরিবারকে প্রকল্পভুক্ত করে দারিদ্র্যকে শূন্যের কোঠায় নামাতে রোডম্যাপ তৈরি করেছে মন্ত্রণালয়। এর আওতায় রয়েছে সরকারের লিজ নেওয়া মজা খাসপুকুর ডোবা খাল পুনঃখনন করে তাতে মাছ ও হাঁস চাষ করা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আঙিনায় নিচু জমি ভরাট করে তাতে শাকসবজি, ফলজ ও ঔষধি গাছ লাগানো এবং বসত বাড়ি দুর্যোগ সহনীয় করতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করাও রোডম্যাপের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

মাননীয় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশকে একটি সক্ষম ও সামর্থ্যবান রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য সরকারের অঙ্গীকার এ খাতে দৃশ্যমান। এর দীর্ঘমেয়াদি সুফল ইতোমধ্যে দেশের জনগণ পেতে শুরু করেছে। ২০৪১ সালে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ এবং নিরাপদ বদ্বীপ পরিকল্পনার রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে। উন্নত বাংলাদেশের অভিযাত্রায় প্রথম ধাপ হিসাবে এর মধ্যেই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে। তার লক্ষ্য এখন স্মার্ট বাংলাদেশ। (পিআইবি ফিচার)

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *