ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান এখন দৃশ্যমান

খোলা কলাম জাতীয় জীবনযাপন

পিআইবি ফিচার

মোস্তাকিম স্বাধীন

কর্মব্যস্ত ঢাকায় একসময় রাস্তায়, ফুটপাতে, হাটবাজারে, আবাসিক এলাকায় ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত মানুষের পদচারণায় ছিল বিরক্তিকর ও অস্বস্তিকর পরিবেশ। কিš‘ এখন পথেঘাটে সেই আগের মতো ভিক্ষুকদের আর দেখা যায় না। শুধু রাজধানীকেন্দ্রিক এলাকাগুলোয় নয়, ঢাকা ও আশপাশের সবখানে চোখ ফেরালে এ দৃশ্য এখন অনেকটা কম দেখা যায়। এর কারণ ভিক্ষাবৃত্তি পরিবর্তন করে নতুনভাবে বাঁচতে শিখেছে এখন বহু মানুষ।

গত কয়েক দশক পেছন ফিরে দেখলে স্মরণ পড়বে রাজধানী ঢাকার ব্যস্ততম ফার্মগেটের সেই ফুটওভার ব্রিজটি। এই ব্রিজের ওপর বিকলাঙ্গ অথবা অন্ধ মানুষ ভিক্ষা করত, পথচারীরা সেই ভিক্ষুকদের ২ টাকা, ৫ টাকা দিয়ে সাহায্য করত। রাস্তার ফুটপাতজুড়ে বয়স্ক নারী ও শিশুরা অসহায়ভাবে সাহায্য চাইত। এখন সেই দৃশ্যপট বদলে গেছে। আজকের দিনে রাজধানীর ফার্মগেটে এখন অন্যরকম পরিবেশ দেখতে পাওয়া যায়। নতুন ও আধুনিক ফুটওভারব্রিজ, প্রশস্ত রাস্তা এবং মেট্রোরেল সেটশন ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মিলন স্থল হয়েছে সে স্থানটিতে। ব্যস্ত পথচারীদের এখন আগের মতো ভিক্ষুকদের বাড়তি উপদ্রব সহ্য করতে হয় না।

দেশ ও জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশেষ ১০টি উদ্যোগ বাস্তবায়নের কাজ হাতে নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই ১০ উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে আমার বাড়ি ও আমার খামার প্রকল্প, আশ্রয়ণ প্রকল্প, ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রকল্প, শিক্ষা সহায়তা কার্যক্রম, নারীর ক্ষমতায়ন, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, কমিউনিটি ক্লিনিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, বিনিয়োগ বিকাশ এবং পরিবেশ সুরক্ষা কর্মসূচি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ এ উদ্যোগগুলোর অন্যতম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন করা। সে লক্ষ্যেই ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান এখন অনন্য বাস্তবমুখী পদক্ষেপ।

১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত সংবিধানের ১৫(ঘ) ও ১৯ অনু”েছদে বলা হয়েছে, সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি অথবা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতৃ ও পিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কারণে কিংবা অভাবগ্রস্ততার কারণে সরকারি ও সামাজিক অধিকার লাভের এবং মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করার জন্য নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র কার্যকরী ব্যবস্থা নিশ্চিত করিবেন। এই আইনের পর ভিক্ষুকদের নিয়ে রাষ্ট্রে কোনো বড়ো ধরনের কর্মসূচি কোনো সরকার গ্রহণ করেনি। ফলে দারিদ্র্যপীড়িত এসব অসহায় ভিক্ষুকের সংখ্যা শহর ছেড়ে গ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে।

২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় আসার পর দারিদ্র্য নিরসন ও ভিক্ষাবৃত্তির মতো অমর্যাদকর পেশা থেকে মানুষকে নিবৃত্ত করার লক্ষ্যে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য রাজস্ব খাতের অনুক‚লে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ২০১০ সালে এই কর্মসূচি গ্রহণ করেন। এক তথ্যে বলা হয়েছে, এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে ঢাকা শহরের ১০টি এনজিওর মাধ্যমে এক জরিপের পর পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে ১০ হাজার ভিক্ষুক নিয়ে ডেটাবেজ তৈরি করা হয়। সেই কর্মসূচির পাইলটিং পর্যায়ে ভিক্ষুক পুনর্বাসন কর্মসূচি পরিচালনার জন্য ভিক্ষুকের সংখ্যা বিবেচনায় প্রাথমিকভাবে ময়মনসিংহ, ঢাকা, বরিশাল ও জামালপুর বিভাগকে নির্বাচন করা হয়। এসব এলাকায় প্রতিটি জেলা থেকে ৫০০ জন করে ২ হাজার জনকে পুনর্বাসন করা হয়। ২০১৮ সালে ভিক্ষুকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালায়ের তত্ত¡াবধানে ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান নীতিমালা গ্রহণ করা হয়। সেসময় এ প্রকল্পের অধীনে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবকে প্রধান করে একটি জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো দেশের ১৮টি জেলায় ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য অর্থ প্রেরণ করা হয়। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ সত্তে¡ও এক শ্রেণির কিছু জনগোষ্ঠী শহর বা গ্রামের গুরত্বপূর্ণ এলাকায় বিশেষ করে বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে ঘিরে ভিক্ষাবৃত্তির জন্য ভিড় জমায়। ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে বর্তমান সরকার ভিক্ষুকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে এখন বদ্ধপরিকর।

ভিক্ষুক ও ভিক্ষাবৃত্তির ইতিহাস অনেক প্রাচীন। ১৪৯৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ রাজা সপ্তম হেনরির সময় ভিক্ষাবৃত্তির ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। সেসময় দরিদ্র এবং সামাজিক বিভিন্ন কারণে ভিক্ষাবৃত্তির ব্যাপক প্রচলন ঘটে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, নদীভাঙন, দুর্যোগ এবং অশিক্ষার কারণে শুধু নয়, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সরকারের শোষণ ও লুটপাটের কারণে মানুষ ভিক্ষাবৃত্তি করতে বাধ্য হয়েছিল। অর্থনৈতিক দুর্বলতা ও সামাজিক নির্যাতনে নিঃস্ব মানুষ ভিক্ষার সঙ্গে জড়িত হয়। এ ভিক্ষাবৃত্তিকে একশ্রেণির মানুষ ব্যাবসা হিসাবে সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। অর্থনৈতিক সাফল্য না থাকায় এ প্রবৃত্তি রাষ্ট্র ও সমাজে চরম অপমানজনক, অসম্মানসূচক ও ঘৃণার বিষয় হিসাবে মূল্যায়ন করা হয়। মানুষ হিসাবে সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে ভিক্ষাকে সমাজ থেকে চিরতরে দূর করতে চায় বর্তমান সরকার। ভিক্ষাবৃত্তিকে কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সামাজিকভাবে বয়কট করতে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, অসহায়ত্বের কারণে ভিক্ষাকে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে বন্ধ করলেও ব্যাপক জনসচেতনতা, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনের প্রসার না ঘটলে ভিক্ষার মতো সামাজিক ব্যাধি দূর হবে না। দেখা যায়, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই আর্থিক দুর্দশায় নিপতিত নাগরিকের জন্য সম্পদ হস্তান্তরের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি রয়েছে।

বাংলাদেশে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। চলতি বছর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই বাজেটের অর্থ বাড়িয়ে ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। বিগত দুই দশকে বাংলাদেশে ব্যাপক সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে সরকার সর্বদা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

ভিক্ষুকদের এ অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে বর্তমান সরকার ভিক্ষুকদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসন কার্যক্রমের মাধ্যমে বিশেষ করে কর্মসৃজন পদ্ধতিতে আত্মনির্ভর হিসাবে গড়ে তুলতে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ঢাকা শহরের ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষিত এলাকায় আটক করা ভিক্ষুকদের নির্দিষ্ট কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্রে আবাসনের এবং অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তার সুবিধা প্রদান করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভিক্ষুক পুনর্বাসনের কাজটি পদ্ধতিগতভাবে করার জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে প্রায় ১৪ হাজার ৭০৭ জন ভিক্ষুককে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় পুনর্বাসন করা হয়েছে। ঢাকায় ইতোমধ্যে সিটি করপোরেশনের বেশকিছু এলাকা ভিক্ষকমুক্ত ঘোষিত হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো বিমানবন্দরের প্রবেশপথের পূর্বপাশের চৌরাস্তা, বিমানবন্দর পুলিশ ফাঁড়ি ও আশপাশের এলাকা, হোটেল র‌্যাডিসনসংলগ্ন এলাকা, ভিআইপি রোড, বেইলি রোড, হোটেল সোনারগাঁও ও হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (রূপসি বাংলা) এলাকা, রবীন্দ্র সরণি, সংসদ ভবন এলাকা, মিন্টো রোড এবং ক‚টনৈতিক জোনগুলো। শুধু ভিক্ষুকমুক্ত নয়, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা তৈরি করে মর্যাদাকর জীবনযাপনে মানুষকে পথ দেখিয়েছে বর্তমান সরকার।

ভিক্ষুকদের স্বাভাবিকভাবে সামাজিক মর্যাদায় ফিরিয়ে এনে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানসহ রাস্তাঘাট উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামকে শহর এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে প্রধানমন্ত্রী জনসাধারণের মধ্যে একটি উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। বাংলাদেশ এখন সেই স্বল্পোন্নত অবস্থান থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। ভিক্ষা থেকে নিজেদের মুক্ত করে স্বাভাবিক ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার এই প্রত্যয় আগামীর বাংলাদেশকে অনন্য এক সুখী-সমৃদ্ধ হিসাবে পথ দেখাবে। পিআইবি ফিচার।

(লেখক: মোস্তাকিম স্বাধীন, নির্বাহী প্রযোজক, একুশে টেলিভিশন)

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *