স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা
সুবর্ণবাঙলা ডিজিটাল ডেস্ক
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে বিএনপির সন্দেহ-সংশয় আরও বেড়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে আমলে না নিয়ে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে ছাত্ররা মূলত নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল বলে মনে করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের দৃশ্যমান কোনো পৃষ্ঠপোষক না থাকায় পেছন থেকে কারা তাদের ইন্ধন জোগাচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিএনপির ধারণা, বিভিন্ন কর্মসূচি ও দাবির মধ্য দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মূলত রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘মাইনাস’ করে দেশে অরাজকতা ‘সৃষ্টির’ চেষ্টা চালাচ্ছে।
গত সোমবার রাতে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। গতকাল মঙ্গলবার শহীদ মিনার থেকে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধীরা। এ কর্মসূচি ঘিরে দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এমন প্রেক্ষাপটে সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দুই ঘণ্টাব্যাপী ওই বৈঠকের প্রধান এজেন্ডাই ছিল ছাত্রদের ঘোষণাপত্র।
এর ঘণ্টা দুই পর নিজেদের মধ্যে দফায় দফায় আলোচনা শেষে ঘোষণাপত্র প্রকাশের উদ্যোগ থেকে পিছিয়ে আসার কথা জানান বৈষম্যবিরোধীরা। অবশ্য এর আগেই অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের পক্ষ থেকে জরুরি ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সরকারের তরফ থেকেই ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করা হবে। সরকারের এ উদ্যোগের মধ্য দিয়ে দেশ সম্ভাব্য একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেয়েছে বলে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অভিমত জানান বিএনপি নেতারা।
সূত্র জানায়, বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে নিজেদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। তাদের অভিমত, দেশে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা হিসেবে এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের দাবি তোলে। সেই দাবি পূরণ হলে দেশে সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা ছিল। বিএনপির কঠোর অবস্থানের কারণে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা যায়নি। কিন্তু সেই উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় বাহাত্তরের সংবিধান পরিবর্তনের দাবিতে বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল হলে দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটতে পারে এবং তা হলে জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও জনগণের গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা নস্যাৎ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বিএনপি।
বৈঠক সূত্র জানায়, ছাত্রদের ঘোষণাপত্র প্রকাশের তোড়জোড় নিয়ে বিএনপির উদ্বেগের কারণগুলো জানাতে গত রোববার রাতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। রাজনৈতিক দলগুলোকে পাশ কাটিয়ে ছাত্ররা এককভাবে বিপ্লবের ঘোষণাপত্র দিলে দেশে যে বিশৃঙ্খলা ও সংকট দেখা দিতে পারে, সে বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে অবগত করেন ফখরুল। এর আগে রোববার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও তাদের ঘোষণাপত্র নিয়ে বিএনপি মহাসচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে মির্জা ফখরুল প্রধান উপদেষ্টা ও বৈষম্যবিরোধীদের সঙ্গে তার সাক্ষাতের বিস্তারিত তুলে ধরেন।
ওই বৈঠকে কয়েক নেতা বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র প্ল্যাটফর্মের এই নতুন উদ্যোগের সঙ্গে দেশের গণমানুষ, রাজনৈতিক দল এবং বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কেউ জড়িত নয়। ছাত্ররা তাদের নিজেদের মতো করে বাংলাদেশের একটি চরিত্র দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। তারা যে সংবিধান বাতিল করে দেওয়ার কথা বলছে, সেই সংবিধানের আলোকেই বর্তমান অন্তর্র্বতী সরকার গঠিত হয়েছে এবং রাষ্ট্রের একটা কাঠামোগত অবস্থান আছে।
এসব কর্মসূচিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের কারা পৃষ্টপোষকতা দিচ্ছেন, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে বৈঠকে। এ প্রসঙ্গে বিএনপির মূল্যায়ন—ছাত্রদের সাম্প্রতিক উদ্যোগের পেছনে দৃশ্যমান কোনো পৃষ্ঠপোষক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিএনপি মনে করে ছাত্রদের সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্টতা নেই। জামায়াতে ইসলামীর কোনো সম্পৃক্ততা রয়েছে কি না, তা-ও স্পষ্ট নয়। এসব তৎপরতার পেছনে দেশের রাজনীতি থেকে বিএনপিকে মাইনাস করার ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। ছাত্রদের মতিগতি থেকেও এমনটা প্রতীয়মান হয় বলে মন্তব্য করেন কয়েকজন নেতা।
ছাত্রদের কর্মসূচিতে অর্থের জোগান কারা দিচ্ছে, তা নিয়েও বৈঠকে প্রশ্ন তোলেন বিএনপির একজন নেতা। তিনি বলেন, ছাত্রদের কর্মসূচি ঘিরে সারা দেশ থেকে যেভাবে গাড়িবোঝাই করে ঢাকায় লোকজন আনা হচ্ছে, তার খরচ আসছে কোথা থেকে? কারণ সামনে থেকে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছাত্র। বাকিরাও কয়েকদিন আগেও ছাত্র ছিলেন। বিএনপি কয়েক ঘণ্টার নোটিশে বড় ধরনের জমায়েত করতে পারে, কারণ সারা দেশে তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি রয়েছে। কিন্তু ছাত্রদের কার্যক্রম জনমানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ।
ছাত্রদের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তোলেন বিএনপির আরেক নেতা। তিনি বলেন, ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের কেউ কেউ ছাত্রলীগ করা, আবার কারোর ব্যাকগ্রাউন্ড ছাত্রশিবির। এ কারণে তাদের লক্ষ্য কী, সেটা কারও কাছে স্পষ্ট নয়। সংগত কারণে ছাত্রদের কেউ কাউকে পুনর্বাসন করতে চায় কি না, সে প্রশ্নও সামনে আসছে।
বিপ্লবের ঘোষণাপত্র নিয়ে বৈঠকে অংশ নেওয়া কয়েকজন নেতা বলেন, ঘোষণাপত্র দিতে হয় আন্দোলনের আগেই। শেখ হাসিনার পতনের আগেই ঘোষণাপত্র তুলে ধরা হলে জনগণের এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকত এবং তারা এটি গ্রহণ করবেন কি না, সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পাঁচ মাস পর এ নিয়ে তোড়জোড় করলে সংকট ছাড়া আর কিছু হওয়ার সুযোগ নেই। তাই ঘোষণাপত্রের বিষয়টি এখন খুব একটা বাস্তবসম্মত হয়নি। তা ছাড়া এ নিয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। ছাত্ররা বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্যও তৈরি করতে পারেনি।
ছাত্রদের রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েও আলোচনা হয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে। এ প্রসঙ্গে দলীয় মনোভাব হচ্ছে এমন—ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগে বিএনপির কোনো আপত্তি নেই। দল গঠন করে নির্বাচনের জন্য তারা জনগণের কাছে যাবে—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোনো ষড়যন্ত্র বা কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হলে গণতন্ত্রমনা রাজনৈতিক দলগুলো তো বটেই, জনগণও তা মেনে নেবে না। একই সঙ্গে ছাত্রদের নতুন দল আওয়ামী দোসরদের পুনর্বাসনের প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠলে বিএনপির তাতে আপত্তি রয়েছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কোনো রাজনৈতিক দল গড়ে উঠুক, বিএনপি তা-ও চায় না।