তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি আদায়

শিক্ষা-গবেষণা ও ক্যাম্পাস

আমজাদ হোসেন হৃদয়

এমফিলের থিসিস নকল করে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন। তার বিরুদ্ধে গবেষণানীতি অমান্য করে একই গবেষণাপত্র এমফিলে ও পিএইচডিতে ব্যবহার করার প্রমাণ রয়েছে। শিরোনাম পাল্টে আগের অংশ পরে এবং পরের অংশ আগে উল্লেখ করে একই লেখা দিয়ে দুটি ডিগ্রি নিয়েছেন তিনি।

রেফারেন্স ছাড়া অন্যের লেখা ব্যবহার করে যেমন প্ল্যাজিয়ারিজম করেছেন, তেমনি নিজের লেখায় ব্যবহৃত উদ্ধৃতি-কবিতা-বক্তব্যের উল্লেখ না করে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। ফলে যা ছিল তার এমফিল থিসিস তা অনেকাংশেই তার পিএইচডি থিসিস। এক পরিশ্রমে দুটি ডিগ্রি! ঈর্ষণীয় সাফল্য পেয়েছেন তিনি দ্রুততম সময়ে লেকচারার থেকে অধ্যাপক।

অভিযোগ, গবেষণায় তাড়াহুড়া করেছেন তিনি। আরও ছয় মাস কাজ করার কথা বললেও তা না করে তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করেন তার পিএইচডি থিসিসে স্বাক্ষর করতে। চার বছর আগে ওঠা এ অভিযোগের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যদিও এ সময়ে চৌর্যবৃত্তির দায়ে শাস্তি পেয়েছেন বেশ কয়েকজন শিক্ষক। গত বছর ২৯ আগস্ট অধ্যাপক মোহাম্মদ বাহাউদ্দীনের বিরুদ্ধে উপাচার্যের কাছে এমফিল ও পিএইচডি থিসিসে চৌর্যবৃত্তির লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের স্বেচ্ছায় অবসরগ্রহণকারী সহযোগী অধ্যাপক ড. আরিফ বিল্লাহ। তৎকালীন উপাচার্যের গড়িমসিতে অভিযোগটি বিবেচনায় আসেনি বলে অভিযোগ রয়েছে। কলা অনুষদের ডিনকে এর তদন্ত রিপোর্ট দিতে বলা হলেও তার হদিস পাওয়া যায়নি। বর্তমান উপাচার্যের কাছেও সেটি হস্তান্তরিত হয়নি। সম্প্রতি আবারও উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামালের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ড. আরিফ বিল্লাহ।

অভিযোগে অধ্যাপক মোহাম্মদ বাহাউদ্দিনের এমফিল ও পিএইচডি থিসিসের সাদৃশ্যের কিছু নমুনা ও এতদসম্পর্কিত কিছু তথ্য সংযুক্ত করা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, ‘তার চৌর্যবৃত্তির বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ২০২৩ সালের ২৮ আগস্ট ভিসির কাছে আবেদন করেছিলাম। দুর্ভাগ্যজনক, আবেদনটি আমলে নেওয়া হয়নি।’

লিখিত অভিযোগে বলা হয়, অধ্যাপক বাহাউদ্দিন দুটি শিরোনামে একই গবেষণা প্রকাশ করেছেন। প্রথমে এমফিল থিসিস সম্পন্ন করা হয়েছে, তারপর একই থিসিস হুবহু পিএইচডি থিসিসে ব্যবহার করা হয়েছে। এমফিল ও পিএইচডি থিসিসে ব্যবহৃত রেফারেন্সবিহীন উদ্ধৃতি, হুবহু সাদৃশ্য ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে ৩৩ পৃষ্ঠার পর্যবেক্ষণ সংক্ষেপ পরিসংখ্যান আকারে তুলে ধরেন অভিযোগকারী।

ড. আরিফ বলেন, “এমফিল থিসিসের শিরোনাম ‘বাংলাদেশে মরমি সাহিত্য ও রুমি চর্চায় ছৈয়দ আহমদুল হকের অবদান’। অন্যদিকে পিএইচডির শিরোনাম ‘সৈয়দ আহমদুল হক ও বাংলাদেশে সুফিবাদ’। আহমদুল হকের নামের বানানে এমফিল থিসিসে ছৈয়দ এবং পিএইচডি থিসিসে সৈয়দ লেখা হয়েছে। একজন প্রখ্যাত ব্যক্তির নামের বানান দুরকম হওয়া নিশ্চয় ঠিক নয়। গবেষক হিসেবে তার উচিত ছিল সঠিক নামটি উভয় থিসিসে লিপিবদ্ধ করা। আর যদি দুটো নাম কোনো কারণে ব্যবহৃত হয়ে থাকে তাহলে তার ব্যাখ্যা দেওয়া। এ ছাড়া থিসিসে প্রচুর বানান ভুল রয়েছে। একই রেফারেন্সের এমফিল থিসিসে পৃষ্ঠা নাম্বার এক আর পিএইচডি থিসিসে আরেক, যা সম্ভব নয়। এসব অসংগতির জন্য গবেষণার মানের কথা বাদ দিলেও নৈতিক স্খলনের বিষয়টি কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া যায় না।”

বাহাউদ্দিনের এমফিল থিসিসের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন অধ্যাপক ড. কেএম সাইফুল ইসলাম খান। পিএইচডিতেও তিনি তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। পরে পর্যাপ্ত সময়ের অভাবে সহ-তত্ত্বাবধায়ক নিতে বলেন। পিএইচডির সহ-তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন অধ্যাপক (তৎকালীন সহযোগী অধ্যাপক) ড. তারিক জিয়াউর রহমান সিরাজী।

তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম খান পিএইচডিতে সম্মতি না দিলেও তাকে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়েছে বলে দেশ রূপান্তরকে তিনি জানিয়েছেন।

ঢাবির মতো সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে গবেষণায় জালিয়াতির প্রমাণ মিললেও প্রশাসন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ। তারা গবেষণা নকলকারী শিক্ষক বাহাউদ্দিনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান। সুফিবাদ ও মরমিবাদ বিশেষভাবে ভিন্ন কিছু নয়। একটু পার্থক্য যদিও আছে। তাই বলে শিরোনামে পাল্টে আগের অংশ পরে এবং পরের অংশ আগে উল্লেখ করে একই লেখা দিয়ে দুই ডিগ্রি নেওয়ার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

সাবেক সহযোগী অধ্যাপক আরিফ বিল্লাহ বলেন, ‘অধ্যাপক বাহাউদ্দিন যে এমফিল ও পিএইচডি করেছে সেটা একই বিষয়ের ওপর। এটা করে অতি দ্রুত বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেয়ে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়েছে। আগেও তার নামে অভিযোগ এসেছে, বিভিন্ন অডিও রেকর্ডও ফাঁস হয়েছে। কিন্তু প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আমি চাই তার বিষয়টি বিবেচনা করা হোক।’

এ বিষয়ে জানতে ফোন করা হলেও অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন ফোন রিসিভ করেননি।

গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ড. কেএম সাইফুল ইসলাম খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি তাকে আরও কাজ করতে বলেছিলাম, কিছু পরিবর্তন আনতে বলেছিলাম। আরও ছয় মাস কাজ করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। এটা বলার পর সব ধরনের বেয়াদবি সে আমার সঙ্গে করেছে। আমি তার থিসিস আটকে রেখেছিলাম। পরে পরিস্থিতির চাপে পড়ে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছি। এটা খুবই দুঃখজনক, এর দায়ভার আমি নেব না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগের অভিযোগের বিষয়টি আমি জেনেছিলাম কিন্তু সেটি আমার কাছে আসেনি। সম্প্রতি আমার কাছে ড. আরিফ বিল্লাহ লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এর তদন্তের জন্য একটি কমিটি করে দেব। তদন্ত শেষে বাকি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *