সুবর্ণবাঙলা প্রতিবেদন
ফ্রান্সের প্যারিসের কার্ডিওলজিস্টদের কনফারেন্সে রোবটের মাধ্যমে হার্টের ধমনীতে রিং পরানোর অভিজ্ঞতা উপস্থাপন করেছেন বাংলাদেশের ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার। তিনি জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিটউ ও হাসপাতালের অধ্যাপক।
বৃহস্পতিবার ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউরো পিসিআর (ঊঁৎড় চঈজ) কনফারেন্স বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি হয়ে তিনি দূর নিয়ন্ত্রিত রোবটের মাধ্যমে হার্টের ধমনীতে রিং পরানোর অভিজ্ঞতা উপস্থাপন করেন। ইউরো পিসিআর (ঊঁৎড় চঈজ) হলো বিশ্বের ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্টদের হৃদরোগ বিয়য়ক অভিজ্ঞতা উপস্থাপনের একটি বড় কনফারেন্স।
অনুষ্ঠানে ফ্রান্স, আমেরিকার প্রতিনিধিরা তাদের অভিজ্ঞতা উপস্থাপন করেন। বাংলাদেশ এশিয়ার মধ্যে ইন্ডিয়া ও চীনের পর তৃতীয় দেশ যারা এই ধরনের উচ্চ প্রযুক্তিসস্পন্ন দূর নিয়ন্ত্রিত রোবটের মাধ্যমে হার্টের ধমনীতে রিং পরানোর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি ডা. প্রদীপ সোনারগাঁ হোটেল থেকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিটউ ও হাসপাতালের ৭২ বছর বয়সি সিদ্দিক নামের এক রোগীর হার্টের মূল রক্তনালিতে একটিতে ৯০% এবং আরেকটিতে ৮০% ব্লকে দূরনিয়ন্ত্রিত রোবটিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিনামূল্যে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর ধমনীতে ২ রিং স্থাপন করেন। এর মাধমে চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার ক্যাথল্যাব ছিল রোগী এবং সোনারগাঁও হোটেলের কনফারেন্স রুমে স্থাপিত রোবটিক কন্ট্রোল ইউনিটের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করে রোবটিক টিমপ্রধান ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার নিখুঁতভাবে রোগীর হার্টে ২টি রিং পরান। পুরো অপারেশন প্রক্রিয়াটি উদ্বোধন ও প্রত্যক্ষ করেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক মীর জামাল উদ্দিন।
ডা. প্রদীপ বলেন, রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি যে কোনো দেশের জন্য যুগান্তকারী ও সর্বাধুনিক হৃদরোগ চিকিৎসা পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কোনো চিকিৎসা সেবা দেওয়া হলো। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতসহ বিশ্বে ১৬০টি দেশে রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টি (রোবট দিয়ে হার্টের রিং পরানো) সেন্টার রয়েছে এর মধ্যে ভারতের ছয়টি সেন্টার রয়েছে। এই চিকিৎসার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতাল রোবোটিক যুগে পদার্পণ করল।
রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি বা রোবট দিয়ে হার্টের রিং পরানোর তিন ধরনের সুবিধা আছে- একটি হলো রোগীর, আরেকটি কার্ডিওলজিস্ট যিনি রিং পরান তার জন্য এবং তৃতীয় সুবিধা হলো দেশের জন্য।
রোবটিক এনজিওপ্লাস্টির প্রথম সুবিধা হলো হার্টের রিং পরানোর জটিল প্রক্রিয়াটি রোবটের মাধ্যমে খুব সূক্ষ্ম ও নিখুঁতভাবে করা যায়। অনেক সময় হার্টের রিং নিখুঁতভাবে পজিশন করার জন্য এক মিলিমিটার সামনে অথবা এক মিলিমিটার পেছনে নেওয়ার প্রয়োজন হয়; কিন্তু হাত দিয়ে করলে নিখুঁতভাবে এই কাজটি করা কঠিন হয়। রোবটের মাধ্যমে নিখুঁতভাবে এটি সম্পন্ন করা যায়।
রোগীদের জন্য আরেকটি সুবিধা হলো হৃদরোগ চিকিৎসকরা সরাসরি এনজিওপ্লাস্টি করতে গেলে যে সময় লাগে রোবটের মাধ্যমে সেটি করতে অনেক কম সময় লাগে। যে কারণে অল্প সময়ে বেশি রোগীর চিকিৎসা সেবা দেওয়া যায়। হার্টের ভিতরে ক্যাথেটার, ওয়্যার (তার), বেলুন, রিং যত কম সময় রাখা যায় রোগীর জন্য তত নিরাপদ তাই রোবটিক এনজিওপ্লাস্টির মাধ্যমে রিং পরাতে সময় কম লাগে বলে জটিলতাও কম হয়।
ডা. প্রদীপ বলেন, রোবটিক এনজিওপ্লাস্টিতে চিকিৎসকদের জন্য সুবিধা হলো যেসব চিকিৎসক অনেক এনজিওপ্লাস্টি করেন একটা সময় এসে তারা দুটি সমস্যায় পড়েন। প্রথমত হলো রেডিয়েশনের কারণে অনেক চিকিৎসক ব্রেন ক্যান্সার ও চোখে ক্যাটারাক্টসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার ঝুঁকিতে পড়া। এছাড়া হৃদরোগ চিকিৎসকরা যখন অপারেশন থিয়েটার বা ক্যাথলেবে কাজ করেন রেডিয়েশন প্রটেকশনের জন্য তারা ১২ থেকে ১৫ পাউন্ড ওজনের একটি বিশেষ জামা দীর্ঘক্ষণ যাবত পরতে হয় ফলে ঘাড়ের নার্ভের চাপ পড়ে। পরবর্তীতে চিকিৎসক খুব বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘাড় ও হাতে ব্যাথার কারণে এনজিওপ্লাস্টি করতে পারেন না। বর্তমানে অনেক সিনিয়র ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট এই সমস্যার জন্য চিকিৎসা সেবা দিতে পারছেন না। এক্ষেত্রে রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টির মাধ্যমে রেডিয়েশন ছাড়াই এবং ভারি বিশেষ জামা পড়া ছাড়াই ক্যাথল্যাবের কন্ট্রোল রুমে, তার অফিসে, সুযোগ-সুবিধা থাকলে বাসায় বসে অথবা দেশের বাইরে থেকেও ইন্টারনেটের মাধ্যমে হার্টের রিং পরাতে পারবেন।
তিনি বলেন, দেশের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো অত্যাধুনিক এই চিকিৎসা প্রযুক্তি চালু হলে রোগীকে আর দেশের বাইরে যেতে হবে না। রোবটিক চিকিৎসার জন্য প্রতি বছর অসংখ্য লোক ভারত, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন। আমরা যদি সেবাটি জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে পরিপূর্ণভাবে চালু করতে পারি তাহলে খুব কম খরচে রোগীদের এই সেবা দেওয়া যাবে। এর মাধ্যমে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে এবং অনেক বড় অংকের একটি অর্থ দেশে থেকে যাবে।
ডাক্তার প্রদীপ কুমার কর্মকার ভারতের হায়দ্রাবাদের এপোলো হসপিটাল এবং চীনের সাংহাই থেকে রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।