গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনা নিয়ে আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর যত মিথ্যাচার

আন্তর্জাতিক

সুবর্ণবাঙলা অনলাইন ডেস্ক


আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। ছবি : সংগৃহীত

গত বুধবার (১২ জুন) দোহায় সংবাদ সম্মেলনে আমেরিকার প্রস্তাবিত গাজায় যুদ্ধবিরতির চুক্তি নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন তার বক্তব্যে কিছুটা অসৎ ছিলেন। শুরুতে এবং প্রশ্নোত্তর পর্বে তার বিভিন্ন বক্তব্য ছিল একেবারেই অসত্য কিংবা চরম বিভ্রান্তিকর।

প্রথমত, ব্লিঙ্কেন জোর দিয়ে বলেন, তিন ধাপের যুদ্ধবিরতির চুক্তি নিয়ে গত ৩১ মে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ঘোষণাটি ছিল ‘ইসরায়েলের প্রস্তাব’ এবং ইসরায়েল সেটি পুরোপুরি সমর্থন করেছে।

প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রস্তাবটি মানতে ইসরায়েলকে বাধ্য করতে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ প্রয়োগের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে ব্লিঙ্কেন বলেন, সেটির কোনো প্রয়োজন হয়নি কারণ, ইসরায়েল আগেই তা মেনে নিয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্লিঙ্কেন মিথ্যাচার করেছিলেন। মূলত বাইডেনই এই চুক্তির প্রস্তাব করেছিলেন কারণ, আগস্টে নির্ধারিত তার দলের ‘ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কনভেনশনের’ আগেই তিনি বিশৃঙ্খল গাজা নীতি থেকে বের হয়ে আসতে চাইছিলেন।

‘ইসরায়েলের প্রস্তাব’ বলে দেওয়া বাইডেনের ঘোষণাও সত্য ছিল না। বাইডেনের ওই ঘোষণার পর গত দুই সপ্তাহে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা চুক্তির ব্যাপারে এগিয়ে আসেননি এবং ওই চুক্তি সমর্থনের ঘোষণাও দেননি। বরং তারা এর বিপরীত কাজটিই করেছেন।

গত দুই সপ্তাহ ধরে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা এটা পরিষ্কার করেছেন, তারা বাইডেনের খসড়া প্রস্তাবের বিরোধী। উপরন্তু, নেতানিয়াহু এবং অন্য কর্মকর্তারাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ইসরায়েল গাজায় যুদ্ধ অব্যাহত রাখার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে তা বাইডেনের প্রস্তাবের মৌলিক শর্তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

গত সোমবার জাতিসংঘে ইসরায়েলি প্রতিনিধি রুট শ্যাপিয়ার বেন নাফট্যালির তেল আবিবের অবস্থানের বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না। তিনি বলেন, যুদ্ধ নিয়ে ইসরায়েলের লক্ষ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি এবং হামাসের সামরিক ও প্রশাসনিক সক্ষমতা ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত তার দেশ যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, স্থায়ী যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে ইসরায়েল অর্থহীন এবং অন্তহীন আলোচনায় যুক্ত হতে পারে না। ইসরায়েলের অবস্থানের কারণে দেশটির সাবেক শীর্ষ কূটনীতিক অ্যালন লিয়েল প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেন, তেল আবিব অবশ্যই আমেরিকানদের দেওয়া প্রস্তাবকে গ্রহণ করেনি।

প্রকৃতপক্ষে, যুদ্ধের শুরু থেকে ইসরায়েল তার ‘সম্পূর্ণ বিজয়’ অর্জনের বিষয়টিই এখনো অনুসরণ করে যাচ্ছে। যদিও এই ‘সম্পূর্ণ বিজয়’ এর সঙ্গে হামাসকে নির্মূলের যে দাবি যুক্ত রয়েছে, তার চেয়ে বরং গাজাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া এবং প্যালেস্টিনিয়ানদের মিসর কিংবা জর্ডানে যেতে বাধ্য করা তাদের জন্য আরও বেশি বাস্তবসম্মত।

যাই হোক না কেন, বাইডেনের প্রস্তাবের দু’টি ধাপে স্থায়ীভাবে যুদ্ধ সমাপ্তির যে আহ্বান রয়েছে সেটির প্রতি ইসরায়েলের সম্মান জানানোর কোনো ইচ্ছেই নেই। এখানেই প্রকৃত রহস্য লুকিয়ে আছে। বাইডেনের প্রস্তাবিত চুক্তির শব্দের মধ্যেই প্রথম ধাপের পর ইসরায়েল কীভাবে চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসবে সেই পন্থাও রয়েছে। কারণ, প্রস্তাবের শর্তাবলিতে বলা হয়েছে যে, কেবল ইসরায়েলের সম্মতি সাপেক্ষেই প্রথম ধাপের শেষ দিকে দ্বিতীয় ধাপ বাস্তবায়ন করা যাবে। যদি ইসরায়েল দ্বিতীয় ধাপে আগ্রহী না হয় এবং আলোচনায় বন্ধ করে দিতে চায় তাহলে যুদ্ধবিরতিও শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু ইসরায়েলি কর্মকর্তারা যে এমন দুর্বল যুদ্ধবিরতি চুক্তিও মানতে নারাজ, সেটি তারা স্পষ্ট করেছেন।

ব্লিঙ্কেনের দ্বিতীয় মিথ্যা হলো, প্রস্তাবের ব্যাপারে হামাসের অবস্থান সম্পর্কে। সংবাদ সম্মেলনে তিনি ইঙ্গিত করেন, বাইডেনের প্রস্তাব এবং গত ৬ মে হামাসের দেওয়া প্রস্তাবের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। এরপর প্রস্তাবের ব্যাপারে অবিশ্বাস ও শর্ত পরিবর্তনের চেষ্টার জন্য হামাসকে দোষারোপ করেন ব্লিঙ্কেন। এমনকি পূর্বে হামাস যেসব শর্ত মেনে নিয়েছিল এখন সেগুলোও তারা পরিবর্তন করতে চাইছে বলে দাবি করেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

কিন্তু তার এসব কথার কোনোটিই সত্য নয়। প্রথমত, বাইডেনের প্রস্তাব এবং হামাসের ৬ মে’র প্রস্তাব পুরোপুরি ভিন্ন। হামাসের প্রস্তাবে প্রথম ধাপের পর ইসরায়েলের জন্য চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগই রাখা হয়নি। এ ছাড়া, ওই প্রস্তাবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো গাজায় ইসরায়েলের অবৈধ অবরোধ তুলে নেওয়া এবং যুদ্ধের পরিসমাপ্তি।

ব্লিঙ্কেন বলেন, বাইডেনের প্রস্তাবের অসংখ্য জায়গায় পরিবর্তন চাইছে হামাস। একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের কথা হামাস তুলে ধরেছিল, আর তা ছিল- ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার। কারণ, গত ৩০ মে আইডিএফ সেনারা ফিলাডেলফিয়া করিডরের দখল নেয়। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, যা ব্লিঙ্কেন নিজের সুবিধামতো বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

তৃতীয়ত, ব্লিঙ্কেন বলেছেন ‘পুরো বিশ্ব’ প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানালেও একমাত্র হামাসই এর থেকে পিছিয়ে রয়েছে। তার এই বক্তব্যও চরম বিভ্রান্তিকর। বিগত কয়েকমাস ধরে আমেরিকা ও ইসরায়েল বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান কিংবা বাধাগ্রস্ত করেছে। এরপরই যুক্তরাষ্ট্র ৩১ মে’র অপূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলো ওই প্রস্তাবে ভোট দিয়েছে।

তবে এর অর্থ এই নয়, সেটি খুব দুর্দান্ত ছিল অথবা আগের প্রস্তাবের তুলনায় ভালো ছিল। বরং যুক্তরাষ্ট্রের বাধাদানের মনোভাবের কারণেই তারা এই প্রস্তাবে ভোট দিয়েছে। কারণ দেশগুলো জানত, এই প্রস্তাবটিই তাদের জন্য একমাত্র সুযোগ। এর মাধ্যমে আমেরিকা ও ইসরায়েল অন্তত সাময়িক যুদ্ধবিরতি হলেও মেনে নেবে।

তবে সোমবার জানা গেছে চীন, রাশিয়া, মাল্টা এবং আলজেরিয়াসহ কয়েকটি দেশ প্রস্তাবের ব্যাপারে নিজেদের আপত্তি তুলে ধরেছিল। ফলে বাইডেনের প্রস্তাবের পক্ষে ‘পুরো বিশ্ব’ রয়েছে বলে ব্লিঙ্কেনের দাবি এক্ষেত্রেও বিভ্রান্তিকর।

চতুর্থত, ব্লিঙ্কেন যুদ্ধবিরতিকে ১২ দিন ঝুলিয়ে রাখার জন্য হামাসকে দায়ী করেছেন। বুধবার সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি তিনি উল্লেখ করেন। এভাবে প্রতিবারই তিনি গাজায় প্যালেস্টিনিয়ানদের দুর্ভোগের জন্য হামাসকে দায়ী করেছেন। ব্লিঙ্কেন বলেন, ‘হামাস প্রস্তাবে সাড়া দিতে গিয়ে ১২ দিন সময় নষ্ট করেছে। এই সময়ে বিশ্ব থেমে থাকেনি, গাজা যুদ্ধও থমকে যায়নি। বরং প্রতিটা দিনই সেখানকার মানুষকে কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। ব্লিঙ্কেন এক্ষেত্রে আরো একবার মিথ্যাচার করেছেন।

বাইডেন ৩১ মে চুক্তির ব্যাপারে ঘোষণা দিলেও বিশ্লেষকদের মতে, এ ব্যাপারে হামাসকে লিখিত বিস্তারিত কোনো খসড়া প্রদান করা হয়নি। অনেক পরে সেটি তাদের দেওয়া হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গত ৫ মে পর্যন্তও বাইডেনের প্রস্তাবিত চুক্তির খসড়া কপি হামাসের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। অবশেষে ৬ জুন তারা সেটি হাতে পায়। এরপর গ্রুপটি ১১ জুন প্রস্তাবের বিষয়ে সাড়া দেয়। অর্থাৎ, মাঝে ৫ দিনের ব্যবধান। কোনোভাবেই সেটি ব্লিঙ্কেনের বিভ্রান্তিকর দাবি অনুযায়ী ১২ দিন নয়।

বাইডেনের ৩১ মে ঘোষিত প্রস্তাব এবং পরে হামাসের কাছে তার পাঠানো প্রস্তাবের লিখিত খসড়ার মধ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য অসংগতি রয়েছে কিনা সেটি যাচাইবাছাইয়ের জন্য গ্রুপটির পাঁচ দিন সময় নেওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু প্যালেস্টিনিয়ানদের দুর্ভোগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কোনো না কোনো উপায়ে হামাসকে দোষারোপ করার বিষয়টি গাজায় ইসরায়েলকে গণহত্যার দায় থেকে সুরক্ষা দেওয়ারই নামান্তর। তাই ব্লিঙ্কেন যা বলবেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

প্রকৃতপক্ষে, ইসরায়েল, প্যালেস্টাইন এবং গাজা নিয়ে বাইডেন প্রশাসনের মিথ্যাচারের ইতিহাস রয়েছে। তবে, একটি সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে ব্লিঙ্কেন যে পরিমাণ মিথ্যা বুলি আওড়েছেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। সাম্প্রতিক কূটনৈতিক চালে গাজা যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটবে না, কিন্তু এটি বাইডেনকে তার ঘরের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করবে। পরিশেষে বাইডেন তার আমেরিকার ভোটারদের বলতে পারবেন, যুদ্ধ থামাতে তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু হামাসের কারণে তা সম্ভব হয়নি।

(আল জাজিরায় প্রকাশিত Unpacking Blinken’s lies on the on the Gaza ceasefire  মতামত কলাম থেকে অনূদিত। অনুবাদ করেছেন মোহসিন কবির)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *