এবারও পার পেয়ে যাবেন মতিউর!

আইন আদালত

স্টাফ রিপোর্টার


মতিউর রহমান

অস্বাভাবিক অর্থসম্পদ এবং এর উৎস সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে পঞ্চমবারের মতো সাবেক রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর আগে চারবার মতিউরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পায় দুদক। কিন্তু প্রতিবারই নানা কৌশলে নানা প্রভাব খাটিয়ে দুর্নীতির বিষয়ে অভিযোগের ক্লিন চিট পেয়েছিলেন ছাগলকা-ের মতিউর রহমান। জানা যায়, মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম দুদকে অভিযোগ আসে ২০০৪ সালে। সে সময় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচারের।
অভিযোগ আছে, হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করা টাকা প্রবাসী কোনো এক আত্মীয়ের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে এনে তা রেমিটেন্স বাবদ দেখিয়ে দিয়েছিলেন ট্যাক্স ফাইলে। ২০০৮ সালে আবারও দুদকে অভিযোগ জমা পড়ে তার বিরুদ্ধে। এবার অভিযোগ বিলাসবহুল পণ্যের শুল্ক মাপ করিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন। কিন্তু তদন্ত শুরু হতে না হতেই প্রভাবশালীদের চাপে তা চাপা পড়ে যায়, ক্লিন চিট পান মতিউর।
এরপর ২০১৩ ও ২০২১ সালে আরও দুবার দুদকে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়া হয়। অভিযোগ ছিল অবৈধ সম্পদ ও সম্পত্তির। কিন্তু কৌশলী মতিউর অবৈধ সম্পদকে পারিবারিক ব্যবসা ও ঋণ দেখিয়ে প্রস্তুত করেন ট্যাক্স ফাইল। ফলে আবারও ক্লিন চিট। অপরাধী অপরাধ আড়াল করতে নানা পন্থার আশ্রয় নেবে। প্রশ্ন ওঠে : দুদক কেন খতিয়ে দেখেনি বিষয়গুলো? তবে এবারও কি ক্লিন চিট পান মতিউর? নাকি আগের ও বর্তমানের সকল অপরাধের শাস্তি মিলবে তার কপালে।
তবে পঞ্চমবারের মতো তদন্তে নেমে দুদক আগের চারবারের প্রতিটি বিষয়ে পর্যালোচনা করার আশ্বাস দিয়েছে। একই সঙ্গে আশ্বাস দিয়েছে, যে বা যাদের মাধ্যমে বারবার দায়মুক্তি পেয়েছে মতিউর, তা-ও খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের।
১৪ দিন পর দেখা মিলল স্ত্রী লাকীর : জনকণ্ঠের নরসিংদী স্টাফ রিপোর্টার জানান, মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী, নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ লাকীর দেখা মিলেছে ১৪ দিন পর। বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার দিকে ব্যক্তিগত গাড়িতে করে উপজেলা পরিষদে আসেন তিনি। পরে তিনি আসন্ন এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা উপলক্ষে এক প্রস্তুতিমূলক সভায় যোগদান করেন।
সভায় সভাপতিত্ব করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইকবাল হাসান। এ সময় উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি শফিকুল ইসলাম ও বিভিন্ন কলেজের প্রধানগণ উপস্থিত ছিলেন। সভা চলাকালীন ভেতরে সাংবাদিকদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। সভা শেষে লাকী নিজ কার্যালয়ে আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মী ও ইউপি চেয়ারম্যানদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। সভা শেষে বের হলে সাংবাদিকরা কথা বলতে চাইলে তিনি কোনো কথা না বলেই গাড়িতে উঠে চলে যান।
জানা যায়, ছাগলকা- সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর থেকে রায়পুরার উপজেলা চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ লাকী আত্মগোপনে ছিলেন। তাকে কার্যালয় অথবা বাড়ি বা তার পার্কে কোথাও দেখা যায়নি। কল করেও পাওয়া যায়নি, এমনকি তিনি কোথায় ছিলেন, তা-ও কেউ বলতে পারেনি। কোনো ছুটি না নিলেও ঈদের পর লায়লা কানিজ লাকী কার্যালয়ে যাননি। তিনি সর্বশেষ ঈদুল আজহার দুই দিন আগে অফিস করেছিলেন।
চেয়ারম্যান অফিস না করায় হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন সেবাপ্রত্যাশীরা। তাদের অভিযোগ, ঈদের ছুটি শেষে অফিস খোলার পর বুধবার পর্যন্ত লায়লা কানিজ লাকী অনুপস্থিত ছিলেন। ওই সময় অনেক ভুক্তভোগী উপজেলা পরিষদে এসে তাকে না পেয়ে ফিরে গেছেন। এতে সেবাবঞ্চিত হয়েছেন তারা।

স্থানীয়রা বলছেন, লায়লা কানিজের বাবা কফিল উদ্দিন আহম্মদ ছিলেন একজন খাদ্য কর্মকর্তা। তার মেয়ে লায়লা কানিজ সরকারি তিতুমীর কলেজে শিক্ষকতা করলেও রাজস্ব কর্মকর্তার সঙ্গে বিয়ের পর তার ভাগ্য খুলে যায়। গত ১৫ বছরে তার সম্পদ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। তিনি এসব সম্পদ গড়েছেন তার স্বামী আলোচিত সাবেক রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের অবৈধ উপার্জনে। শিক্ষকতার আয়ে বা পেনশনের টাকায় তার এত সম্পদ থাকার কথা নয়।
ইফাতের সঙ্গে থাকা তরুণী কে : মতিউরের ছেলে ইফাত সম্পর্কে জানা গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। পশু ও পাখিপ্রেমী ইফাতের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে দেখা যেত এক তরুণীকে। পাখিমেলাসহ বিভিন্নস্থানে ওই তরুণীসহ উপস্থিত হতেন ইফাত। ২৩ বছর বয়সী ওই তরুণীর সঙ্গে কী সম্পর্ক ছিল ১৯ বছর বয়সী ইফাতের তা জানা গেছে অনুসন্ধানে। যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজে অনার্সে অধ্যয়নরত ওই তরুণীর নাম উম্মে হাফসা। যশোর জেলা সদরের খোলাডাঙ্গা গ্রামের এই তরুণী থাকেন রাজধানী ঢাকায়। বাবা টিটু মুন্সি একজন খুদে ব্যবসায়ী।
২০২০ সালে এসএসসি পাস করা হাফসা নামের এই তরুণী ঢাকায় এসে পরিচিত হন ইফাতের সঙ্গে। তারপর রাতারাতি পাল্টে যায় হাফসার ভাগ্য। ইফাতের সঙ্গে বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত হন তিনি। বাসার আসবাবপত্র থেকে শুরু করে অনেক কিছুই কিনে দিয়েছেন ইফাত। এমনকি গত ঈদে হাফসার বাড়িতে তিনটি গরু কিনে দিয়েছেন তিনি। মেয়ে ঢাকায় থাকলেও কোথায়, কীভাবে থাকেন তা জানেন না হাফসার বাবা টিটু মুন্সি। তিনি জানান, গত ঈদের আগে ইফাতকে বন্ধু পরিচয় দিয়ে বাড়িতে নিয়ে যায় হাফসা। বিয়ে হয়েছে কি-না, তা নিশ্চিত করতে পারেননি তিনি।
একটি সূত্র জানিয়েছে, ইফাতের ভাড়া করা ফ্ল্যাটে থাকতেন হাফসা। হাফসাকে অনেকেই ইফাতের স্ত্রী হিসেবে জানেন। ছাগলকা-ের পর মাকে নিয়ে দেশ ছেড়েছেন ইফাত। তবে হাফসা ঢাকাতেই রয়েছেন বলে জানা গেছে। নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে মতিউর রহমানের। অনেকেই মনে করছেন স্ত্রী ও ঘনিষ্ঠদের নামে রয়েছে তার বিপুল টাকা। এই তালিকায় থাকতে পারেন হাফসাও।

মতিউরের ঘনিষ্ঠরা জানান, কানাডা ও মালয়েশিয়াতে বিপুল সম্পত্তি রয়েছে তার। সরকারি চাকরির সুবাদে অবৈধ অর্থ আদায়সহ অবৈধ বাণিজ্যেও জড়িত রয়েছেন মতিউর। পিতার অবৈধ অর্থে বিলাসী জীবনযাপন করেন তার দুই স্ত্রী ও সন্তানরা।
ছাগল কিনে আলোচিত ইফাত পাখি পুষতেও পছন্দ করেন। লাখ লাখ টাকা মূল্যের পাখি সংগ্রহে রয়েছে তার। ঘরে রয়েছে মিসরের বাজরিগার, অস্ট্রেলিয়ার গালা কাকাতুয়া পাখিসহ নানা প্রজাতির বিড়ালও।

ইফাত রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সাদিক অ্যাগ্রো থেকে একটি ছাগল ছাড়াও ঢাকার অন্তত সাতটি খামার থেকে এ বছর ৭০ লাখ টাকার গরু কিনেছেন। গত বছরও কিনেছেন ৬০ লাখ টাকার পশু। এ ছাড়াও বিলাসবহুল গাড়ি কেনাও তার শখ। পিতার অবৈধ আয়ের টাকায় এই বিলাসিতা করতেন ইফাত। মতিউর তার সন্তানদের বিলাসিতার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করতেন।
মতিউর কোথায় আছেন, তার স্ত্রী-সন্তানরা কোথায়, কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে অসাধু এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে? এ রকম নানা প্রশ্ন এখন জনমনে। সম্প্রতি একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে তার। হজের পোশাক পরিহিত অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও মতিউর রহমানকে দেখা গেছে ওই ছবিতে। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। বর্তমানে ঢাকাতেই অবস্থান করছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সভাপতি পদ হারানো মতিউর রহমান।
শীর্ষ এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, এ বিষয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশনা পেয়েই মাঠে নামেন গোয়েন্দারা। মতিউর যাতে দেশ ছেড়ে যেতে না পারেন এ জন্য তাৎক্ষণিকভাবেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *