ফের শ্রমিক অসন্তোষ অস্থির শিল্পাঞ্চল

আইন আদালত জাতীয় রাজনীতি

গাজীপুরে ভাঙচুরের পর কারখানায় আগুন
সুবর্ণবাঙলা ডেস্ক

সরকার ও তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের নানা পদক্ষেপের পরও অস্থিরতা থামছে না শিল্পাঞ্চলে। শ্রমিক অসন্তোষ ও গ্যাস-বিদ্যুতের জন্য ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন, যা নিয়ে উদ্বিগ্ন বিদেশি ক্রেতারাও। সর্বশেষ গতকাল বুধবার পর্যন্ত বিক্ষোভের মুখে আশুলিয়া-সাভার ও গাজীপুরের প্রায় ১১৪টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। গাজীপুরে বিগবস নামে একটি পোশাক কারখানায় ভাঙচুরের পর আগুন ধরিয়ে দিয়েছে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা।

এদিকে শ্রম পরিস্থিতি উন্নয়ন এবং শ্রম অসন্তোষ নিরসনে ‘শ্রম সংক্রান্ত অভিযোগ পর্যবেক্ষণ কমিটি’ গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। গতকাল শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আরএমজি এবং নন-আরএমজি সেক্টরের শ্রম অসন্তোষ পরিস্থিতি পর্যালোচনায় মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা জানান। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শ্রম আইন ২০০৬ এর ১৩(১) ধারা অনুযায়ী সাভার-আশুলিয়ায় ৫১টি এবং গাজীপুর এলাকায় তিনটি কারখানা বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছে বিজিএমইএ সূত্র। এ ছাড়া এসব এলাকায় স্ব-বেতনে (লিভ উইথ পে) ছুটি রয়েছে এমন কারখানার সংখ্যা ৬০টি।

বিজিএমইএর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, আশুলিয়া জোনের কারখানাগুলো বন্ধ করেছেন উদ্যোক্তারা। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বৈঠক করছি। আশা করছি, শনিবারের মধ্যে অসন্তোষ কমে আসবে। বিজিএমইএ সূত্র আরও জানায়, সারা দেশে খোলা কারখানার সংখ্যা ২ হাজার ২৮টি। কারখানা খোলার রাখা সত্ত্বেও কাজ বন্ধ রয়েছে দুটিতে। ১ হাজার ৩০৯ কারখানা (৬১.০৫ শতাংশ) শ্রমিকদের আগস্ট মাসের বেতন পরিশোধ করা হয়েছে।

গতকাল সকালে আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার মো. সারোয়ার আলম বলেন, আশুলিয়া অঞ্চলে মোট ২২টি কারখানা শ্রম আইনের ১৩(১) ধারায় বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। কারখানা খোলা থাকা সত্ত্বেও শ্রমিকরা কাজ না করায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে ৮টিতে। তিনি আরও বলেন, শিল্পাঞ্চলের কোথাও কোনো সহিংসতার ঘটনা নেই। যারা পারছেন, কারখানা চালাচ্ছেন। যারা পারছেন না, ছুটি দিয়ে দিচ্ছেন।

পোশাক খাতের একটি শিল্পগ্রুপের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, আর কোনো পথ খোলা ছিল না। সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে কারখানা চালু রাখার। কিন্তু নিরীহ শ্রমিক ও সম্পদ রক্ষায় মালিকপক্ষ কারখানা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।

শিল্প সংশ্লিষ্টদের একটি সূত্র জানায়, শ্রমিক অসন্তোষ শুরুর পর পরিস্থিতি ঘোলাটে হলে অনেক মালিকই ১৩ (১) ধারায় কারখানা বন্ধের দাবি তুলেছিলেন। বিজিএমইএর সভায়ও সেই দাবি তোলা হয়েছিল। কিন্তু সামগ্রিকভাবে শ্রমিকদের এবং শিল্পের স্বার্থে সে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। গতকাল পর্যন্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পর বিভিন্ন গ্রুপ বা কারখানার মালিকপক্ষ নিজেরাই এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন।

এদিকে বকেয়া বেতন-ভাতা এবং বিভিন্ন দাবিতে গাজীপুরের চক্রবর্তী এলাকায় নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়ক অবরোধ করে গতকাল বিক্ষোভ করেছে বেক্সিমকো গ্রুপের শ্রমিকরা। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে ওই অঞ্চলের আরও কয়েকটি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।

গাজীপুরের টঙ্গীতে বিভিন্ন দাবিতে তিন কারখানার শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে। বিক্ষোভকালে বহিরাগত শ্রমিকদের সঙ্গে কারখানা শ্রমিকদের সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন আহত হয়েছে। এদিন সকাল ৮টা থেকে স্থানীয় তিস্তার গেট এলাকার হক অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের সহস্রাধিক শ্রমিক কারখানার সিইও আফতাব উদ্দিনের পদত্যাগ, বেতন বৃদ্ধি, বৈষম্য দূরীকরণসহ ১৪ দফা দাবিতে উৎপাদন কাজ বন্ধ করে কারখানার সামনে অবস্থান নেয়। একপর্যায়ে কারখানা ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। পরে ওই শ্রমিকরা পার্শ্ববর্তী মেঘনা রোডে গার্মেন্টস এক্সপোর্ট ভিলেইজ লিমিটেড, ব্রাভো অ্যাপারেলস লিমিটেড ও পিনাকী গার্মেন্টসের সামনে জড়ো হয়ে শ্রমিকদের নিচে নামতে বলে। একপর্যায়ে তারা কারখানার গেট ও জানালায় ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। পরে বাধ্য হয়ে শ্রমিকদের ছুটি দিয়ে দেয় এই দুটি কারখানা। পরে হক অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের শ্রমিকরা তাদের নিজেদের কারখানার সামনে গেলে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের দাবিগুলো মেনে নেয়।

অন্যদিকে চেরাগআলী এলাকার ড্রেসম্যান ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেড সহস্রাধিক শ্রমিক সার্ভিস বেনিফিট, হাজিরা বোনাস, নিয়োগে সমতা, দুই কর্মকর্তার পদত্যাগসহ ১৪ দফা দাবিতে সকাল ৯টা থেকে কারখানার সামনের সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে। সাড়ে ১০টার দিকে কারখানাটির ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।

অ্যাডমিন ম্যানেজার কবিরসহ কয়েকজন কর্মকর্তার পদত্যাগ, শ্রমিকদের সঙ্গে খারাপ আচরণ না করা ও আন্দোলনরত শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত না করাসহ ১৪ দফা দাবিতে সকাল ৯টা থেকে আফতাব সিএনজি পাম্প সংলগ্ন যমুনা অ্যাপারেলসের শ্রমিকরা বিক্ষোভ করে। পরে তাদের দাবি মেনে নিয়ে এক দিনের জন্য কারখানাটির ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।

গাজীপুর শিল্প পুলিশের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোশারফ হোসেন বলেন, ড্রেসম্যান কারখানার শ্রমিকদের দাবিগুলো সমাধানের চেষ্টা চলছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক। কারখানা এলাকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে।

অন্যদিকে গাজীপুরে একটি তৈরি পোশাক কারখানার গোডাউনে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে নগরীর কাশিমপুর থানার চক্রবর্তী এলাকায় বেক্সিমকো কারখানার শ্রমিকরা বেতনের দাবিতে বিক্ষোভের একপর্যায়ে বিগবস করপোরেশন লিমিটেড কারখানার ওয়্যার হাউসে আগুন ধরিয়ে দেয় বলে কারখানার ম্যানেজার মোজাম্মেল হক টিপু জানান। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গেলে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা তাদের গাড়ি ভাঙচুর করে।

কাশিমপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বেক্সিমকো গ্রুপের কারখানার শ্রমিকরা বকেয়া বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ করে। এ সময় তারা অন্যান্য কারখানাও বন্ধ করতে বিভিন্ন কারখানায় হামলা ও ভাঙচুর চালায়।

প্রত্যক্ষদর্শী ও কারখানা কর্তৃপক্ষ জানায়, চক্রবর্তী এলাকায় অবস্থিত বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিজ কারখানার শ্রমিকরা সকাল থেকে বকেয়া বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে। একপর্যায়ে দুপুরে শ্রমিকরা সারাবো এলাকাসহ আশপাশের এলাকার বিভিন্ন পোশাক কারখানায় ছুটি ঘোষণার দাবি করে। এ ছাড়া ওইসব কারখানার শ্রমিকদের কাজ বন্ধ রেখে তাদের সঙ্গে বিক্ষোভে অংশ নিতে বলে। কিন্তু কারখানার কাজ বন্ধ করে আন্দোলনে অংশ না নেওয়ায় বেক্সিমকো কারখানার শ্রমিকরা বিভিন্ন কারখানার সামনে গিয়ে জানালার কাচ ও গেটে ভাঙচুর চালায়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা নিয়ে গত সোমবার সন্ধ্যায় বিজিএমইএ কার্যালয়ে একটি জরুরি বৈঠক হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন কারখানা মালিক, শ্রমিক সংগঠনের নেতা ও রাজনৈতিক নেতারা। বৈঠকে শ্রমিকদের হাজিরা বোনাস ও টিফিন বিল বাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে আশুলিয়ার সব পোশাক কারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী প্রায় সব কারখানা খুলে দেওয়া হলেও শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেওয়ায় মঙ্গলবার ৪২টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।

বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, সোমবারের বৈঠকে শ্রমিকদের চারটি দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। টিফিন বিল ও হাজিরা ভাতা বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বৈষম্য রাখা হবে না, যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ হবে। আর কোনো শ্রমিক ছাঁটাই করলে তার ব্যাপারে রেস্ট্রিকশন থাকবে না, যাতে সে অন্যত্র সহজে চাকরি পেতে পারে।

জানতে চাইলে বিজিএমই সহসভাপতি নাসির উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যা তো সরকার ছাড়া কেউ সমাধান করতে পারবে না। আর শ্রমিক অসন্তোষের বিষয়ে সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিজিএমইএ কাজ করছে। তবে এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হবে। আর উৎপাদন ব্যাহত হলে দেশের অর্থনীতির চাকা স্থবির হয়ে পড়বে।

এদিকে গতকাল শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আরএমজি এবং নন-আরএমজি সেক্টরের শ্রম অসন্তোষ পরিস্থিতি পর্যালোচনায় মতবিনিময় সভা হয়। সভায় শ্রম পরিস্থিতি উন্নয়ন এবং শ্রম অসন্তোষ নিরসনে ‘শ্রম সংক্রান্ত অভিযোগ পর্যবেক্ষণ কমিটি’ গঠনের কথা জানান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তার সভাপতিত্বে সভায় অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবরা উপস্থিত ছিলেন।

আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, সভায় বেশি কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর আগে কেবিনেট মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছিল একটি পর্যালোচনা কমিটি বা পর্যবেক্ষণ কমিটি করার। আসলে শ্রমিকদের বিভিন্ন সমস্যা নিরসনে যে কমিটিগুলো আছে, যেমন—শ্রম অধিদপ্তর ও শ্রম আদালত, বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন কারণে সেগুলোর ওপর শ্রমিকরা আস্থা হারিয়েছেন। সেটা ফিরিয়ে আনতে হবে কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে, যা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। আপাতত শ্রমিকরা যে সমস্যাগুলো ফেস করছেন, তাদের দাবিগুলো যাতে নিদিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে ফেস করতে পারেন, সে লক্ষ্যে একটি কমিটি করা হয়েছে। আরএমজি এবং নন-আরএমজি সেক্টরের শ্রম অসন্তোষ ও শ্রম পরিস্থিতির বিদ্যমান সমস্যা পর্যালোচনা করে সুপারিশ দেওয়ার জন্য, শ্রম সংক্রান্ত অভিযোগ পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে শ্রম অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক এবং শ্রম অধিদপ্তরের ট্রেড ইউনিয়ন ও সালিশির পরিচালককে সদস্য সচিব করে করা হয়েছে। কমিটিতে তিনজন শ্রমিক নেতা, দুজন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং মালিকপক্ষের দুজন সদস্য আছেন।

তিনি আরও বলেন, বিজয় নগরে আমাদের যে শ্রম ভবন আছে, সেখানে শ্রমিকরা তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া পেশ করতে পারবেন। কমিটি পর্যালোচনা করে সুপারিশ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা সংস্থার কাছে পাঠাবে। শ্রমিকদের যে ন্যায্য দাবিগুলো আছে, সেগুলোর মধ্যে যেটা স্বল্প মেয়াদে বা দ্রুত সমাধানযোগ্য সেটা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন কালবেলার টঙ্গী ও সাভার প্রতিনিধি)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *