নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ রোল মডেল

জাতীয়

পিআইবি ফিচার
বোরহান বিশ্বাস

সুমাইয়া আফরিন শাহীন। রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের টেলিকম বিভাগে কাজ করছেন দীর্ঘদিন। পেশার পরিচয় ছাপিয়ে ফুটবল রেফারি হিসাবেই সমধিক পরিচিত তিনি। তবে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বেড়ে ওঠা শাহীনকে খেলাধুলা করতে হয়েছে এক বৈরী পরিবেশের মধ্যে। সংগ্রামের অনেক পথ পাড়ি দিয়ে দেশের নারী রেফারি হিসাবে আজ অনেকেই তাঁকে চেনে। দেশের বিভিন্ন জেলায় ফুটবল মাঠে সবুজ ঘাসের ওপর ছুটে বেড়ান তিনি। খেলোয়াড়দের শাসন করতে তাঁর মুখে থাকে বাঁশি, পকেটে হলুদ, লাল কার্ড। একসময় যাঁর পরিচয় দেওয়ার মতো তেমন কিছু ছিল না। আজ স্বনামেই তিনি পরিচিত। তাইতো গর্ব করেই শাহীন বলেন, আজ কোনো অনুষ্ঠানে গেলে অন্তত একটি চেয়ার আমার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়। পরিবার ও নিকটাত্মীয়দের কাছে এখন তিনি আদর্শ। কোনো ম্যাচ পরিচালনার জন্য ফেডারেশন থেকে ডাক পড়লে অফিস সসম্মানেই তাকে ছুটি দেয়। কারণ, অফিসও যে সেই প্রশংসার ভাগীদার!

প্রধানমন্ত্রীর ১০ বিশেষ উদ্যোগের একটি হলো নারীর ক্ষমতায়ন। শাহীনের মতে, নারীর ক্ষমতায়নের ফলে তাঁর আজকের পর্যায়ে উঠে আসা সম্ভব হয়েছে। একসময় মেয়েরা চাকরি করবে কি না, তা ভাবা হতো; আজ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে তারা নিজেকে যোগ্যতম অবস্থানে নিয়ে গেছে, যাচ্ছে।
নারী রেফারি হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করতে পারা তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড়ো ঘটনা বলে মনে করেন শাহীন। এমন পথ তৈরি করে দেওয়ার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

নারীর ক্ষমতায়নের সুফলের কথা অকপটে স্বীকার করেন সৈয়দা জেরিন ইমাম। পেশায় একজন দন্তচিকিৎসক। ডাক্তারি পড়ার ওপর পিএইচডি করতে চীনে গিয়েছিলেন। খুব কাছ থেকে দেখেছেন সুপার পাওয়ার চীনের জীবনযাত্রা। কীভাবে লিঙ্গ ভেদাভেদ ভুলে ছেলে-মেয়েরা একযোগে কাজ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যা”েছ, সেটি কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন।

জেরিন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করলেন এভাবে চীনে ছোটোবেলা থেকেই বিভিন্ন বিদ্যালয়ে জেন্ডার বিষয়ে ধারণা দেওয়া হয়ে থাকে। স্কুলগুলোর শ্রেণিকক্ষে ট্র্যাফিক আইনসহ নাগরিক জীবনে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় বিষয় লেখা থাকে। আর এ কারণে এসব বিষয়ে পরবর্তীতে বেড়ে ওঠা শিশু-কিশোরদের কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না। লিঙ্গবৈষম্য নেই বলেই নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করে চীনকে আজকের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
জেরিনের মতে, নিজের সংস্কৃতি ঠিক রেখে যে কোনো ছেলে-মেয়েই কর্মক্ষেত্রে এভাবেই দ্রুত এগিয়ে যেতে পারে। নিজ নিজ উন্নয়নে সবাই এগিয়ে গেলে দেশেরও উন্নয়ন হয়। বিশেষত নারীরা এগিয়ে গেলে দেশের উন্নয়নটা  ত্বরান্বিত হয়। এক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সবচেয়ে আদর্শ নারী বলে মনে করেন। পোশাকে বাঙালিয়ানা, কথাবার্তা এবং দেশ নিয়ে চিন্তাভাবনা, বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়ন বা উন্নয়নে তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। এ কাজে প্রধানমন্ত্রীর বিকল্প নেই বলেও মনে করেন জেরিন। আরেকটু এগিয়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে অনুসরণ করলে কোনো নারীই পিছিয়ে থাকবে না। তিনি নারীদের জন্য অনেক কিছু করেছেন, যা আজকের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের নারীদের অনন্য উ”চতায় নিয়ে গেছে। নারীর পদচারণা নেই কোথায়! সবখানেই আছে এবং সফলভাবেই তারা আছে।

তিনি বলেন, কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত এসএমই মেলায় গিয়েছিলাম। সেখানে নারীদের উপ¯ি’তি সত্যিই আমাকে মুগ্ধ করেছে। কিছু চাপা সমস্যা আছে। তবে এ সমস্যাগুলো নিজেদেরই সমাধান করতে হবে। এজন্য সরকারকে দোষ দেওয়া ঠিক হবে না।
বাংলাদেশে সামাজিক উন্নয়নের মধ্যে নারীর ক্ষমতায়ন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিগত দশকে বাংলাদেশ নারীর জীবনমান উন্নয়নে অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছে। ২০০০ সালের পর থেকে মাতৃমৃত্যুর হার দুই-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে দেশ।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম প্রণীত বৈশ্বিক জেন্ডার গ্যাপ সূচকে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দি”েছ। ২০২২ সালে বাংলাদেশের র‌্যাংকিং ছিল ৭১তম, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বো”চ। এক্ষেত্রে ভারত ১৩৫ এবং পাকিস্তান ছিল ১৪৫-এ। বাংলাদেশে জেন্ডার সমতায় সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে বিশ্বের মধ্যে নবম, ভারতের অব¯’ান ৪৮ এবং পাকিস্তানের ৯৫তম। বাংলাদেশ বিশ্বের একমাত্র দেশ, যেখানে ৫৩ বছরে নারী সরকারপ্রধান সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় ছিলেন (৩৩ বছর)।
প্রতিবছর বাজেট ঘোষণার সময় জাতীয় সংসদে জেন্ডার বাজেট উপস্থাপন করা হয়। যেখানে নারী উন্নয়নে কোন ধরনের নীতি, কৌশল ও কর্মসূচি প্রণয়ন করা হবে এবং এর জন্য মন্ত্রণালয় বা বিভাগভিত্তিক যেসব কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করা হবে, তার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়।

নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রশংসনীয় উদ্যোগ
মুক্তিযুদ্ধে নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিশে^ প্রশংসনীয়। সুদৃঢ় প্রশাসনিক ও আইনি কাঠামো, সচেতন সুশীলসমাজের কারণে বাংলাদেশের নারী আন্দোলন আজ শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে, যা নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় এবং নারীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে কার্যকরী ভ‚মিকা রেখেছে। বাংলাদেশ নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণ সনদে (সিডও) স্বাক্ষর করা দেশগুলোর অন্যতম।

দেশ স্বাধীনের পরপরই ১৯৭২ সালে সংবিধানে নারীর সম-অধিকার নিশ্চিত করা হয়। আইন প্রণয়নের সর্বো”চ জাতীয় প্রতিষ্ঠান জাতীয় সংসদে নারীদের পক্ষে কথা বলার জন্য নারী আসন সংরক্ষণ করা হয়। জাতির পিতার পথ ধরে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা নারীর উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, ক্ষমতায়ন ও সম-অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।

তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার দেশের নারীসমাজকে এগিয়ে দিয়েছে কয়েক ধাপ। সেই সঙ্গে বেড়েছে ক্ষমতায়নের সুযোগ। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বেশি নারী। বিশ্বের অন্য দেশগুলোর সরকারের মতো বাংলাদেশ সরকারও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীদের সম্পৃক্ত করতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম প্রকাশিত বৈশ্বিক লিঙ্গ বিভাজন সূচক ২০২০ অনুযায়ী ১৫৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৫০তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে।

মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল একটি বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণ। বাংলাদেশের সংবিধানেও এর প্রতিফলন ঘটেছে। জেন্ডার বাজেটের যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে জেন্ডার সমতা, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হ্রাস, স্বা¯’্য ও টিকাদানের ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন হয়েছে। নারীর আর্থসামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন এখন সর্বত্রই দৃশ্যমান। এজন্য আরও নারী কর্মসংস্খান সৃষ্টি, উদ্যোক্তা হিসাবে গড়ে তোলা ও সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা এবং আর্থিক বরাদ্দ নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে রোল মডেল। নারীর ক্ষমতায়ন মূল্যায়নে যেসব অনুঘটক বা সূচক ব্যবহার করা হয়, এর সবকটিতে বাংলাদেশ এগিয়ে। দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, জাতীয় সংসদের স্পিকার নারী।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ প্রণয়ন করে। দল এবং সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ওই সময় জাতীয় সংসদের স্পিকার পদে একজন নারীকে নির্বাচিত করেন। তিনিই প্রথম, যিনি মন্ত্রিসভায় প্রথম স্বরাষ্ট্রন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে নারীকে দায়িত্ব দেন। সংসদ উপনেতাও হন একজন নারী। এতসব গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীর পদায়নের ফলে নারীর আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাওয়ায় তাঁদের ক্ষমতায়ন দীর্ঘস্থায়ী ও সুদূরপ্রসারী হয়েছে।

সেই ধারাবাহিকতায় উপজেলা পরিষদে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদ সৃষ্টি ও ইউনিয়ন পরিষদে তিনজন নারী সদস্য নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়ার বিধান নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের নারী এখন শুধু বিচারক, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার নন; নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এবং রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছেন দক্ষতার সঙ্গে। শিক্ষা, চিকিৎসা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং ক‚টনৈতিক দক্ষতা, খেলাধুলা, পর্বতারোহণ, নাসাসহ সব চ্যালেঞ্জিং পেশায় সাফল্যের চিহ্ন রাখছেন।

বাংলাদেশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সচিব বা সমমর্যাদার পদে নারী কর্মকর্তা রয়েছেন, যা আগে ছিল না। উ”চ আদালতের বিচারপতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী উপাচার্য, প্রথম কোনো নারী সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল পদে পদায়িত হন।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯(৩) অনুচ্ছেদে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নারীর অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র কর্তৃক নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। নারীর যথার্থ মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে সরকার নারী শিক্ষার বিস্তার, অধিকার প্রতিষ্ঠা, ক্ষমতায়নসহ নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধে ব্যাপক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে উন্নত বিশ্বের উন্নয়ন চিত্র পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, নারীর ক্ষমতায়নের দিক দিয়ে আজকের উন্নত দেশগুলোও যে খুব সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে তা নয়; বরং বিভিন্ন দেশের নারীরা বিভিন্ন বৈষম্যেরও শিকার হচ্ছেন। তবে সার্বিক পরিচিতি বিবেচনা করে অভিজ্ঞজনরা বলছেন, কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ নারী উন্নয়নের রোল মডেল এবং জেন্ডার সমতা অর্জনে ইতিবাচকভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে।

পিআইবি ফিচার
লেখক: সহ-সম্পাদক, দৈনিক জনকণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *