মেয়েশিশুর বয়ঃসন্ধিকাল: সহযোগিতা করতে হবে অভিভাবকদের

অন্যান্য স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা

জোহরা শিউলী

এগারো বছরের আলেয়া। পড়ছে পঞ্চম শ্রেণিতে। সারা দিন ব্যস্ত থাকে পড়াশোনা আর পুতুলখেলা নিয়ে।
বন্ধুরা এলে জমে উঠে হাঁড়িপাতিল খেলা। স্কুল আর বাসার মধ্যেই নিত্যদিন যাপন। একদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ খেয়াল করল তার ছোটো প্যান্ট ভিজে গেছে রক্তে। প্রস্রাবের স্থান দিয়ে বের হচ্ছে এই রক্ত। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে সে। মাকে জানায়। আলেয়ার ভয় দেখে মা আদর করে বুকে জড়িয়ে নেন। এ সময়ে এটা হয়। মেয়েকে বোঝাবে ভাবছেন এমন সময় মেয়ের এই পিরিয়ড শুরু হয়ে যায়। আলেয়ার ভয় কাটানোর জন্য মা তাকে বোঝাতে শুরু করেন। নয় থেকে বারো বছরের প্রতিটি মেয়েশিশুর এ অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।

মনোবিজ্ঞানীদের ভাষ্যমতে, বয়ঃসন্ধিকালে মস্তিষ্কে চলে ছোটো থেকে বড়ো হওয়ার ভাঙাগড়া। মনোদৈহিক পরিবর্তন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকায় এ সময় ছোটো ছোটো বিষয়ে তারা সহজে রেগে যায়। পিরিয়ড জীবনের অপরিহার্য বিষয় হলেও এর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া সহজ হয় না কিশোরীর জন্য।

কিশোরীর এ শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনে তার পাশে থাকা এবং তাকে বোঝানোর দায়িত্ব শুধু মায়েরই বেশি। ব্যাংকার জিনাত নাহারের ১৩ বছর বয়সি এক মেয়ে আছে। মেয়ের পরিবর্তনটা খুব সহজেই বুঝতে পারেন তিনি। কেমন যেন একটু গুটিয়ে যাওয়া স্বভাব। খেলাধুলা কমিয়ে দিয়েছে। ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকতে পছন্দ করে। কোনো ঘটনায় খুব দ্রæতই প্রতিক্রিয়া দেখায়। পড়ালেখা নিয়ে খুব বেশি চাপ নেয়। মায়ের সঙ্গ তার কেমন যেন বিরক্ত লাগে। এমনকি মেয়ের অনেক বিষয় তিনি স্কুলে মেয়ের বান্ধবীদের কাছ থেকে জানেন।
জিনাত নাহার বলেন, ‘ওকে বোঝার চেষ্টা করি। রাগ করলে কিছুক্ষণ আমিও চুপ করে থাকি। ওকে ভুলটা বোঝার সময় দিই। পিরিয়ড নিয়ে আমি ওকে আগে থেকেই বুঝিয়েছি। ওর ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে দিতাম। ও খুব সহজভাবেই নেয়। ওর বাবা স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনে ওর ঘরে রেখে আসে, ব্যাপারটা ও খুব স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে।’

ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কামরুজ্জামান জানান, তার একমাত্র মেয়ে নাইমা, পাঁচ বছর বয়সে স্ত্রী মারা যান। এখন মেয়ের বয়স ১৪। একাই লালনপালন করেছেন মেয়েকে। মেয়ের সব ইচ্ছা-অনিচ্ছার দিকে নজর রাখেন তিনি। বাবা তার প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে দেন। তারপরও যেন একধরনের মুখভার করা অবস্থা দেখতে পান মেয়ের মধ্যে। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সময় বুঝি মেয়ের মন খারাপ, বয়সটাই এমন। আমি একাই বাবা-মা দুজনের দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করি।’

নিজের কৈশোরের কথা জানালেন অভিভাবক রওশন আরা। তিনি বললেন, ‘আমার যখন প্রথম পিরিয়ড হয়, তখন আমি এ বিষয়ে তেমন জানতাম না। এমনকি আমার মা আমাকে কখনো বলেননি যে একটা সময় এমন হবে। তাই হঠাৎ নিজের এমন পরিস্থিতিতে আমি ভড়কে যাই। পরে মা বুঝিয়ে দেন।’

বয়ঃসন্ধিকালে কিশোরীর পাশে থাকার জন্য মায়ের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এমনটাই মনে করেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের গাইনি ও অবস বিভাগের অধ্যাপক ড. ফারহাত হোসেন। তিনি জানান, কিশোরী মেয়ের সঙ্গে মায়ের সম্পর্কটা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বান্ধবীদের কাছ থেকে মেয়েরা হয়তো শারীরিক পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে পারে; কিন্তু, মনে রাখতে হবে, বান্ধবীরাও তখন বাচ্চা। কিশোরী যদি না জানে তার কী পরিবর্তন হবে, তাহলে বিষয়টা তার জন্য বেশ ভীতিকর হয়। মায়েদের এ বিষয়ে মেয়েদের আগে থেকেই জানাতে হবে। কীভাবে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করবে, তা দেখিয়ে দিতে হবে। কতক্ষণ এটা ব্যবহার করা যাবে, এ বিষয়ে জানাতে হবে। মাসিকের সময় ব্যথা হতে পারে। মাসিকের আগে আগে মেজাজ খিটখিটে হয়। লজ্জা বা সংকোচ অনেক সমস্যার সৃষ্টি করে। প্রথম পিরিয়ডের পর অনেক মা মেয়েকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসেন, যা বেশ ইতিবাচক পদক্ষেপ।

এ সময় মেয়েকে প্রয়োজনীয় পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার দেওয়া উচিত, যা তার মানসিক বিকাশে সহায়তা করবে। কিশোরীর এই শারীরিক পরিবর্তন থেকেই মানসিক সমস্যার শুরু, এটি বুঝতে হবে। এ সময় হরমোনের পরিবর্তন মেয়েটিকে অনেক আবেগপ্রবণ করে দেয়। সব ধরনের অনুভ‚তির প্রকাশই তীব্র হয়। মেয়ের ওপর রাগ করেন অনেক বাবা-মা। তখন ছোট্ট মেয়েটির মনেও খেলা করে অভিমান।
এ সময়টাতে তার পর্যাপ্ত মানসিক সাহায্য প্রয়োজন। শারীরিক ও মানসিক এ পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে বুঝিয়ে বলতে হবে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মেয়ে বয়ঃসন্ধিতে তার মা-বাবার কাছ থেকে পিরিয়ড, বয়ঃসন্ধি এবং মেয়েদের শারীরিক পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে পারে, ভবিষ্যতে তারা সুস্বাস্থ্য পায় এবং আত্মবিশ্বাসী হয়। তাই প্রত্যেক মাকে তার মেয়েসন্তানের বিষয়ে হতে হবে সচেতন। জানাতে হবে তাদের এই পরিবর্তনটির কথা। শরীরের এটা খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।

স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন
একটা সময় পিরিয়ড হলে কাপড় ব্যবহার করা হতো। প্রত্যন্ত অ লে এখনো অনেকে করেন। কাপড় বা তুলা ব্যবহার না করে মেয়ের হাতে তুলে দেন স্যানিটারি প্যাড। বাজারে অনেক ধরনের স্যানিটারি প্যাড পাওয়া যায়, সেগুলো তুলনামূলক স্বাস্থ্যকর। প্রথমেই ঠিক করতে হবে আপনার স্যানিটেশনের জন্য আপনি কী ব্যবহার করতে চান এবং সেই অনুযায়ী তা সংগ্রহে রাখতে হবে।

বদলানোর সময় নির্দিষ্ট রাখতে হবে
ব্লিডিং কম হচ্ছে এই ভাবনা থেকে কেউ কেউ একটি ন্যাপকিন অনেকক্ষণ পরে থাকেন। রক্তপাত কম হোক বা বেশি, একটি স্যানিটারি ন্যাপকিন কখনোই দীর্ঘ সময় ব্যবহার করবেন না। একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর বদলে ফেলুন। সময়টা যেন ৩ থেকে ৪ ঘণ্টার বেশি না হয়। যদি রক্তপাত বেশি হয়, তাহলে প্যাড নষ্ট হওয়ামাত্রই বদলে ফেলুন। কারণ, প্যাডে জমে থাকা রক্ত দিয়ে নানারকম জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারেন। এ কারণে নানারকম অসুখ কিংবা ফাঙ্গাল ইনফেকশনের শিকার হতে পারেন।

সঠিকভাবে পরিচ্ছন্নতা
এ সময়ে পরিচ্ছন্নতায় যেমন মনোযোগী হতে হবে, তেমনই জানতে হবে কীভাবে সঠিক পদ্ধতিতে পরিষ্কার হওয়া যায়। পরিষ্কারের সময় ওপর থেকে পায়ুপথের দিকে হাত ঘুরিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। কখনোই বিপরীতদিকে পরিষ্কার করা ঠিক নয়। এতে পায়ুপথে জীবাণু সংক্রমণ হতে পারে। ইউরিন ইনফেকশনের প্রধান কারণ হলো এই ভুল পদ্ধতিতে পরিচ্ছন্ন হওয়া।

প্যাড ব্যবহারে সচেতনতা
যে প্যাড ব্যবহারে স্বস্তিবোধ করবে কিশোরী, তেমন প্যাড ব্যবহার করা উচিত। তবে খেয়াল রাখতে হবে, এটি যেন স্বাস্থ্যসম্মত হয়। প্যাড ব্যবহারের ক্ষেত্রে অধিক শোষণ ক্ষমতার দিকে না গিয়ে নরম তুলা বা সুতি কাপড়ের তৈরি অরগানিক প্যাড কেনা যেতে পারে।

ব্লিডিং যখন কম
বিশেষ এ সময়টাতে শেষের দিকে আর ইচ্ছা করে না প্যাড পরে থাকতে। ২৪ ঘণ্টা একটানা প্যাড পরে থাকাটাও ঠিক না। এতে ব্যাকটেরিয়াল ও ফাঙ্গাল ইনফেকশন হতে পারে। ব্লিডিংয়ের পরিমাণ কম থাকলে এবং কিশোরী যখন ঘরে অবস্থান করে, তখন চেষ্টা করতে হবে প্যাড ছাড়াই থাকতে।

নিয়মিত গোসল
আমরা অনেকেই আছি ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতায় এতটা মনোযোগী হতে পারি না। কিন্তু পিরিয়ডের সময়টাতে ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরি”ছন্নতা জরুরি। তেমনই জরুরি নিয়মিত গোসল করা। গোপনাঙ্গ পরিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার রাখতে হবে সম্পূর্ণ শরীর। গোসলে গরম পানি ব্যবহার করা গেলে তা আরও ভালো।

প্রস্তুতি থাকতে হবে বিশেষ সময়টাতে
ক্লাসে কিংবা খেলাধুলার সময় হুট করে শুরু হয়ে যায় পিরিয়ড। আর বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় এজন্য অনেককে। কিশোরীকে আগে থেকে সচেতন করা গেলে বিশেষ এই সময়টিতে বিব্রত হতে হবে না কাউকে। ব্যক্তিগত প্রস্তুতি রাখা জরুরি। মাসের কোন সময়টাতে মেয়ের পিরিয়ড হলো, তা যদি মা লিখে রাখেন, তাহলে কাজটি সহজ হয়ে যাবে। আর এভাবেই প্রস্তুতি নেওয়া সহজ হবে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার তৃতীয়টি হচ্ছে সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ। আজকের কিশোরী আগামী দিনের মা। তাই সুস্থ্য কিশোরী মানেই সুস্থ্য মা। তাই মেয়েশিশুর বয়ঃসন্ধিকালটা যাতে সুন্দরভাবে কেটে যায়, সেদিকে অভিভাবকদের নজর রাখতে হবে। (পিআইবি ফিচার)

লেখক: সাংবাদিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *