গ্রাম আদালতের সুফল পাচ্ছে দরিদ্র নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী

খোলা কলাম জাতীয়

ইয়াসমীন রীমা

পল্লি এলাকার নারী, দরিদ্র ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী যাতে তাদের প্রতি সংঘটিত অন্যায়ের প্রতিকার স্থানীয় পর্যায়ে গ্রাম আদালতের মাধ্যমে দ্রুত ও স্বল্পব্যয়ে পেতে পারেন, সে লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার স্থানীয় সরকার বিভাগের মাধ্যমে ইউএনডিপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক সহযোগিতায় বাংলাদেশের ১৪ জেলার ৫৭টি উপজেলায় ৩৫১টি ইউনিয়ন (২০০-২১৫) ‘অ্যাক্টিভেশন ভিলেজ কোর্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রকল্পের প্রথম পর্যায় সমাপ্ত করেছে। এখন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে দেশের ২৭ জেলার ১২৮টি উপজেলার ১০৮০টি ইউনিয়নে বাংলাদেশে গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ প্রকল্পটি দ্বিতীয় পর্যায়ে কাজ করছে। জেলাগুলো হলো চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুর, ফরিদপুর, গাজীপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, কুমিল্লা, নেত্রকোনা, চাঁদপুর, কক্সবাজার, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, নওগাঁ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা। চট্টগ্রামে গ্রাম আদালতে গত দুই বছরে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে প্রায় ৯৪ ভাগ ।
সম্প্রতি ৩ পার্বত্য জেলার ২৬ উপজেলার ১২১টি ইউনিয়ন পরিষদকে এ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উল্লেখ্য, প্রকল্প এলাকার অন্তর্ভুক্ত ২৭টি জেলার ১২৮টি উপজেলার ১ হাজার ৮০টি ইউনিয়ন প্রকল্পের চলমান কার্যক্রমে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সংশ্লিষ্ট উপজেলার নির্বাহী অফিসার, উপপরিচালক, স্খানীয় সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে গ্রাম আদালত গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করছে। এ প্রসঙ্গে ইউএনডিপি বাংলাদেশের আবাসিক প্রতিনিধি সুদীপ্ত মুখার্জি বলেন, ‘গ্রাম আদালতের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির ফলে তথ্যানুযায়ী প্রায় ১২ হাজার মামলা জেলা জজকোর্ট থেকে গ্রাম আদালতে অর্পণ করা হয়েছে। গ্রামের মানুষ জমিজমাসহ ছোটোখাটো বিষয়েও মামলা করে থাকেন। এসব মামলা নিষ্পত্তি করতে গিয়ে অনেকে অর্থ ও সময় নষ্ট করে দীর্ঘ সময় হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। গ্রাম আদালতে আড়াই লাখের বেশি মামলা হয়েছিল। যার মধ্যে দুই লাখের বেশি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে। গ্রাম আদালত কার্যকর ও শক্তি বৃদ্ধির ফলে মানুষের আস্থা বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, স্থানীয় বিচারব্যবস্থার সুযোগ পৌঁছে দিতে সরকার ২০০৬ সালে গ্রাম আদালত আইন পাশ করে, যা ২০১৩ সালে সংশোধিত হয়। এ আইনে ইউনিয়ন পরিষদকে ছোটোখাটো মামলার নিষ্পত্তির ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী স্থানীয় পর্যায়ে অনেক মামলাই নিষ্পত্তি হয়ে থাকে। একজন চেয়ারম্যান এবং উভয়পক্ষ কর্তৃক মনোনীত দুজন করে মোট পাঁচজন সদস্য নিয়ে গ্রাম আদালত গঠিত হয়। প্রত্যেক পক্ষ কর্তৃক মনোনীত দুজন সদস্যের মধ্যে একজন সদস্যকে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হতে হবে। নাবালক এবং কোনো নারীর স্বার্থ জড়িত থাকলে সংশ্লিষ্ট পক্ষ সদস্য মনোনয়নের ক্ষেত্রে একজন নারীকে সদস্য হিসাবে মনোনয়ন প্রদান করবে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যান হবেন, তবে কারণবশত চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে অসমর্থ হন কিংবা তার নিরপেক্ষতা সম্পর্কে কোনো পক্ষ কর্তৃক প্রশ্ন উত্থাপিত হলে সেক্ষেত্রে মনোনীত সদস্য ব্যতীত ওই ইউনিয়ন পরিষদের অন্য কোনো সদস্য গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যান হবেন। বিবাদী কোনো পক্ষে যদি একাধিক ব্যক্তি থাকেন, তবে চেয়ারম্যান ওই পক্ষভুক্ত ব্যক্তিদের তাদের পক্ষের জন্য দুজন সদস্য মনোনীত করতে আহ্বান জানাবেন এবং যদি তারা অনুরূপ মনোনয়ন দানে ব্যর্থ হন তবে তিনি ওই ব্যক্তিদের মধ্য থেকে যে কোনো একজনকে সদস্য মনোনয়ন করার জন্য ক্ষমতা প্রদান করবেন এবং তদনুযায়ী অনুরূপ ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি সদস্য মনোনয়ন করবেন। যে ইউনিয়নের মধ্যে অপরাধ সংঘটিত হয় বা মামলার কারণ উদ্ভব হয়, সেই ইউনিয়নে গ্রাম আদালত গঠিত হবে, তবে পক্ষগণ ই”ছা করলে নিজ ইউনিয়ন থেকে প্রতিনিধি মনোনীত করতে পারবেন।
বিধিমালা অনুযায়ী সর্বো”চ ৭৫ হাজার টাকা মূল্যমানের ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তি হয় গ্রাম আদালতে। গ্রাম আদালত গঠিত হওয়ার পর ১৫ দিনের মধ্যে সভা আহ্বান করা হয়। সভায় আবেদনকারী ও বিবাদী উভয়পক্ষের মধ্যে আপসের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেন আদালত। এতে বিরোধ নিষ্পত্তি না হলে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু করে তা নিষ্পত্তি করা হয়। অল্প খরচে, স্বল্পসময়ে এবং সহজে মামলা নিষ্পত্তির সুযোগ থাকায় দিনদিন নির্ভরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এ আদালতে। দরিদ্র নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যেমন: প্রতিবন্ধী, দলিত, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, যারা আইন-আদালতসংক্রান্ত ‘ভয়ের কারণে’ বিচারিক সেবা গ্রহণে আগ্রহী নন, তারাও গ্রাম আদালতে এসে সুফল পাচ্ছেন। কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার ২নং (উত্তর) দুর্গাপুর ইউনিয়নের একাধিক বাদী-বিবাদী জানান, পাঁচ বছর আগেও পরিবারের মধ্যে ঝগড়াবিবাদ হলে স্থানীয় মেম্বার-চেয়ারম্যানদের কাছে বিচার নিয়ে গেলে তারা একপেশে বিচার করতেন। যেদিকে লোক বেশি, সেদিকে সমর্থন জানাতেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ইস্যু টেনে স্থানীয় সালিশব্যবস্থা কৌশলে ভন্ডুল করা হতো। কোনো উপায় না পেয়ে শেষ পর্যন্ত মামলার দিকে ঝুঁকে পড়তেন এসব অসহায় মানুষ। মামলা করে বছরের পর বছর আদালতে ঘুরে ঘুরে আর্থিক, মানসিক ও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বাংলাদেশ গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ প্রকল্পের জাতীয় প্রকল্প পরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব মরণ কুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘দেশের প্রচলিত বিচারব্যবস্থা জনগণের সংখ্যার তুলনায় অপর্যাপ্ত। এ শূন্যতা পূরণে গ্রামে ছোটোখাটো বিরোধগুলো মিটিয়ে ফেলতে গ্রাম আদালত কার্যকরী ভ‚মিকা রাখছে। স্থানীয়ভাবে সহজে, কম খরচে, দ্রুত ও স্ব”ছ প্রক্রিয়ায় বিরোধ নিষ্পত্তি করতে গ্রাম আদালতের ভ‚মিকা প্রশংসনীয়। ইউনিয়ন পরিষদে প্রতিষ্ঠিত গ্রাম আদালত উভয়পক্ষের মনোনীত সদস্যদের মাধ্যমে সমঝোতার ভিত্তিতে বিরোধ নিষ্পত্তি করে থাকে। ফলে সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা বজায় থাকে। এজন্য সরকার সারা দেশের গ্রাম আদালতগুলোকে কার্যকর করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।’
অন্যদিকে গ্রাম আদালতে ১ হাজার ৮২০ সিদ্ধান্তের মধ্যে ১ হাজার ৪৬১টি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়েছে। মামলা গ্রহণ ও নিষ্পত্তি ছাড়াও গ্রাম আদালতের মাধ্যমে প্রায় ৩৮ লাখ টাকা মূল্যের ১৮৯ শতাংশ জমি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয়েছে ১ কোটি ১৮ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। এছাড়াও ইউনিয়ন পরিষদগুলো ৪০ হাজার টাকা ফি আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। বাগেরহাটের গ্রাম আদালতে দুই বছরে ৩ হাজারের বেশি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। আদালতের মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের প্রায় ৩ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করে দেওয়া হয়েছে।
গ্রাম আদালতের কার্যক্রমের সুফল পেয়েছে চুয়াডাঙ্গা, নাটোর, সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, চাঁদপুর ও মেহেরপুরের মানুষ। আইনি জটিলতায় না গিয়ে পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ায় সন্তোষজনক বাদী-বিবাদী উভয়পক্ষই। টাঙ্গাইলের ১১৮টি ইউনিয়নের সবকটিতেই চালু আছে গ্রাম আদালত। তবে দিনাজপুর, নড়াইলসহ কয়েকটি জেলায় এ আদালতকে আরও সক্রিয় হওয়ার দাবি জানিয়েছেন অধিবাসীরা।
জাতীয় মহিলা সংস্থা, কুমিল্লা জেলা কর্মকর্তা তানিয়া আকতার বলেন, ‘বর্তমানে উপকরণাদি, দক্ষ জনশক্তি ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব এবং স্থানীয় জনগণের অসচেতনতা গ্রাম আদালতের মাধ্যমে বিচারিক সুবিধা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হিসাবে কাজ করছে।’
গ্রামাঞ্চলে স্বীকৃত ‘ভিলেজ পলিটিক্স’ শব্দদ্বয়ের ধারক ও বাহক কিছু মন্দ মানুষের কবলে পড়ে অন্যায়-অবিচারের শিকার হচ্ছেছন সরল শ্রেণিভুক্ত মানুষ। পাশাপাশি দুর্নীতির জাঁতাকলে পিষ্ঠ গ্রাম্য সুস্থ সমাজব্যবস্থা। নিরীহ-নিরপরাধ মানুষের ওপর যাতে কোনো মতলববাজ গোষ্ঠী অন্যায় অবিচার করতে না পারে, এজন্য গ্রাম্য এই মন্দ দলভুক্ত মানুষগুলোকে শায়েস্তা করে কীভাবে গ্রামের বিচারব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য করা যায়, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং গ্রাম্য সালিশে অবৈধ ক্ষমতা প্রদর্শনের বিষদাঁত ভেঙে দিয়ে সমাজে সুশৃঙ্খল পরিবেশ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এবং সরকারি সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেসব যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছেন, গ্রাম আদালত এর একটি। এর মাধ্যমে গ্রামের লোকজন তার ইউনিয়ন পরিষদে নিজেদের মধ্যে ছোটো ছোটো দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ পাচ্ছেন।

(পিআইবি ফিচার;
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক)

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *