গবেষণায় আগ্রহ কম
বছর শেষে ফেরত যাচ্ছে বরাদ্দের টাকা
২০২১ সালে ৩৬ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল পিএইচডি গবেষণা হয়নি * গবেষণার টাকা বিলিবণ্টন করে দেয় ৬ বিশ্ববিদ্যালয় * নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে ভরসা ব্যক্তিগত উদ্যোগ
এখানেই শেষ নয়, সরকার প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে যে বরাদ্দ দেয় তা যথাযথভাবে ব্যয় না করার অভিযোগও আছে। নিয়ম অনুযায়ী, এই খাতের টাকা সুনির্দিষ্ট গবেষণা প্রস্তাবের বিপরীতে খরচ করতে হবে। কিন্তু ঢাকাসহ দেশের ৬টি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতনের সঙ্গে মাসে ৫ হাজার করে টাকা বিলিবণ্টন করে দিয়েছে।
২৮ অক্টোবর সরকারি হিসাবসংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় এ নিয়ে আলোচনা হয়। কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) টাকা ফেরত চেয়ে চিঠি দেয়। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষক ওই টাকা ফেরত দেননি। উলটো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে বিষয়টিকে অপ্রাসঙ্গিক দাবি করে নিন্দা জানানো হয়েছে। ৬টির মধ্যে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই ৮৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা শিক্ষকদের মাঝে বিলিয়েছে।
জানতে চাইলে ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাদ্দের অর্থ ব্যয় করতে না পারার নেপথ্যে যৌক্তিক কারণ আছে। সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবের বিপরীতে অর্থ বরাদ্দ দিতে হয়। শিক্ষকদের কাছ থেকে হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মানসম্পন্ন প্রস্তাব পায়নি। এমন অবস্থা ঘটলে বরাদ্দে কিছু অর্থ ব্যয় অবশিষ্ট থাকে। এছাড়া আরেকটি কারণ আছে, তা সমতাকেন্দ্রিক। যেহেতু বরাদ্দের পরিমাণ কম। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সব শিক্ষককেই টাকা দেওয়ার চিন্তা রাখে। এমন অবস্থায় অঙ্ক নির্ধারণ করে দেয় যে, সর্বোচ্চ কত টাকা দেওয়া হবে। এখন যদি প্রকল্প অনুযায়ী কারও বেশি অর্থ লাগে, সে চাইলেও পায় না। ওই অবস্থায়ও একটা অংশ অব্যয়িত রয়ে যায়। তবে প্রস্তাবের বাইরে গিয়ে অর্থ ব্যয় করা আর্থিকবিধি লঙ্ঘনের শামিল। এটি কোনো কিছুর প্রভাবেই ব্যয় করা কাম্য হতে পারে না।
জানা গেছে, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি চিহ্নিত বাকি ৫ বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে-জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, ইসলামি এবং যশোর ও মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ইউজিসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এমন ক্ষেত্রে সাধারণত বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টান্ত ছোটগুলো অনুসরণ করে থাকে। শিক্ষক রাজনীতির কারণে ভোটের হিসাব কষতে গিয়ে গবেষণার টাকা এভাবে খুশিমতো খরচ করা হয়েছে। আর্থিকবিধি প্রতিপালন না করার কারণেই গবেষণা তহবিল ‘তছরুপ’ নিয়ে আলোচনা হয় সংসদীয় কমিটির সভায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ খাতের বরাদ্দ সংকট, অর্থ ফেরত বা বরাদ্দের টাকা নয়ছয়ের ঘটনার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে দেশে এখন পর্যন্ত গবেষণার পরিবেশই তৈরি হয়নি। বিশ্বব্যাপী গবেষণার মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও স্বতন্ত্র গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা থিংকট্যাংক সারা দুনিয়ায় আছে, কিন্তু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মৌলিক গবেষণা ও নতুন জ্ঞান সৃষ্টির মূল কেন্দ্র হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সমাজ বা জীবনঘনিষ্ঠ সমস্যা ও ইস্যু নিয়ে অধ্যাপকের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় এই গবেষণা। এ ক্ষেত্রে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায় থেকে তহবিল সংস্থান হয়ে থাকে। উন্নত বিশ্বে এই রেওয়াজ চালু আছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত আশানুরূপভাবে গড়ে উঠেনি এই সংস্কৃতি। বরং এর পরিবর্তে একেকটি বিশ্ববিদ্যালয় শুধু পাঠদান এবং পরীক্ষা নিয়ে চাকরির বাজারের জন্য গ্র্যাজুয়েট তৈরির প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে।
এসব প্রতিষ্ঠানে গবেষণা অনেকটাই ব্যক্তি (প্রফেসরের) উদ্যোগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কেউ পদোন্নতির শর্তপূরণের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি করেন বা গবেষণা প্রবন্ধ লেখেন। আবার কেউ নামের আগে ‘ডক্টর’ বা চাকরির আগে পর্যন্ত সময়ক্ষেপণের জন্য গবেষকের খাতায় নাম লেখান। চাকরি পেলে গবেষণা ছেড়ে প্রবেশ করেন কর্মজীবনে। বিদেশি সংস্থা বা বিভিন্ন উদ্দেশ্য পূরণে কিছু গবেষণার রেকর্ড আছে। কিন্তু আবিষ্কার আর নতুন কিছু সৃষ্টির গবেষণা নেই বললেই চলে।
কুয়েটের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আলমগীর বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসলে মানসম্পন্ন গবেষণা হয় না। এর নানা কারণ আছে। প্রথমত, গবেষণার জন্য পরিবেশ দরকার। এই পরিবেশ বলতে ল্যাবরেটরির পর্যাপ্ত সুবিধা এবং গবেষককে বোঝানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ স্তরের গবেষক লাগবে। এগুলো হচ্ছে, আন্ডারগ্র্যাজুয়েট এবং মাস্টার্স। এছাড়া আছে পিএইচডি, পোস্ট ডক্টরাল এবং স্বাধীন গবেষক বা গবেষণা সহকারী। গবেষণা যেন নিয়মিত হয় তা নিশ্চিত করতে হয়। এজন্য ফেলোশিপ দিতে হয়। সম্মানজনক বেতন দিতে হবে, যাতে তাদের সংসার চলে। এসব নিশ্চিত করতে না পারলে সময় কাটানো আর জীবিকা নির্বাহের জন্য গবেষকরা আসবেন। চাকরি পাওয়ার পরে তারা চলে যাবেন। শুধু ডিগ্রির লোভ দেখিয়ে গবেষক পাওয়া যাবে না। দ্বিতীয়ত, আলোচিত কোনো গবেষণার জন্য ৫-১০ বছর ধরে একটি সমস্যা নিয়ে কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিল্পকে তার সমস্যা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রবণতা বাড়াতে হবে। কেননা, তারাই বড় অঙ্কের অর্থ গবেষণায় বিনিয়োগ করতে পারেন। কিন্তু এই চর্চাও এ দেশে গড়ে উঠেনি। তাই কাঙ্ক্ষিত গবেষণাও হচ্ছে না।
ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনেও গবেষণায় উদ্বেগজনক চিত্র বেরিয়ে এসেছে। এতে দেখা যাচ্ছে, ২০২১ সালে ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৬টিতেই এমফিল-পিএইচডিতে কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়নি। মাত্র ১৯ শতাংশ শিক্ষকের পিএইচডি ডিগ্রি আছে। ৫ বছর ধরে এই সংখ্যা কমছে। অর্থাৎ, ২০১৭ সালে পিএইচডিধারী শিক্ষক ছিলেন ৩৪১৬ জন, সেখানে ২০২১ সালে ছিলেন ২৯৪৪ জন। ২০২১ সালে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ছিলেন ১৫৩৯৩ জন।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিস্থিতি আরও করুণ। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক আর সহযোগী অধ্যাপকদের বেশিরভাগই ভাড়া করা। সাধারণত উচ্চতর গবেষণায় নেতৃত্ব দেন ও তত্ত্বাবধান করেন অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকরা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল-পিএইচডি গবেষণা করানোর অনুমতিই নেই।
তবে এমন অবস্থার মধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমিত বরাদ্দের মধ্যে গবেষণার চেষ্টা দেখা যায়। সরকারিভাবেও বরাদ্দ বাড়ছে, যা গত ৩ বছরে প্রতীয়মান। এছাড়া ইউজিসি এমফিল, পিএইচডি এবং পোস্ট ডক্টরাল খাতেও কম-বেশি অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে। গবেষণাকে উৎসাহিত করতে সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা মেলা করে।
এছাড়া বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল। তিনি বলেন, গবেষণা বৃদ্ধিসহ শতবর্ষ উপলক্ষ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
দুটি নীতিমালা হচ্ছে, বাড়বে বরাদ্দ : বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অ্যাপেক্সবডি ইউজিসি দুটি নীতিমালা তৈরি করছে। সংস্থাটির ইউজিসির পরিচালক ড. ফখরুল ইসলাম জানান, প্রস্তাবিত নীতিমালায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দুইভাগ করে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করার কথা আছে। এরমধ্যে একটি গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের একাডেমিক কার্যক্রম এগিয়ে নিতে হবে। এতে যুক্ত থাকবেন প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপকরা। তারা আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ও মাস্টার্স শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করবে। আরেকটি গবেষণা পরিচালিত হবে সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপক এবং সিনিয়র অধ্যাপকদের মাধ্যমে। মানবজীবনের দৈনন্দিন চাহিদাভিত্তিক প্রায়োগিক এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেবেন তারা। এটি শিল্প-কারখানা আর বৈশ্বিক বাস্তবতার আলোকে করা হবে। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আর্থিক বরাদ্দও থাকবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাজন থাকবে না। ইন্ডাস্ট্রি থেকে আসা গবেষণা প্রস্তাব যে কোনো ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ে উপযুক্ত সিনিয়র অধ্যাপক বা খ্যাতিমান শিক্ষকের কাছে যাবে। সিনিয়রদের তত্ত্বাবধানে নবীন গবেষকরা কাজ করতে পারবেন। এর বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে একাডেমিক গবেষণা কার্যক্রমও জোরেশোরে চলবে, যার নেপথ্যে ভূমিকা রাখবেন জুনিয়র শিক্ষকরা। সবমিলে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা-বান্ধব সংস্কৃতি তৈরির স্বপ্ন দেখা হচ্ছে। এতে একটি পর্যায়ে দক্ষতা সম্পন্ন বিশ্বমানের গবেষক তৈরি হবে।(সৌজন্যে: দৈনিক যুগান্তর)