যে কারণে ইরানি হামলায় তেমন ক্ষতি হয়নি ইসরায়েলের

আন্তর্জাতিক

সুবর্ণবাঙলা ডেস্ক

হিজবুল্লাহর জ্যেষ্ঠ নেতা হাসান নাসরাল্লাহ হত্যার প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েলের ওপর হামলা করেছে ইরান। মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) রাতে প্রায় ২০০টি ব্যালেস্টিক মিসাইল ছোড়া হয়েছে। এ ধরনের মিসাইল ব্যাপক বিধ্বংসী ও সচরাচর প্রতিরোধ করা কঠিন। কিন্তু ইসরায়েল বেশিরভাগ মিসাইল ভূমিতে পড়ার আগেই আকাশে ধ্বংস করে দিয়েছে। যে কটি আঘাত করতে সক্ষম হয়েছে তাতে ইসরায়েলের মধ্য ও দক্ষিণ অঞ্চল এবং পশ্চিম তীরে সামান্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মিসাইল ছোড়ার সংখ্যা, লক্ষ্যে আঘাত করার মাত্রা ও ক্ষয়ক্ষতির প্রভাবের আলোকে বিশ্লেষকরা একে ব্যর্থ সামরিক অভিযান বলছেন।

ইসরায়েলের সামরিক ঘাঁটি, বিমান ঘাঁটি ও গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সদর দপ্তরে হামলার লক্ষ্য ছিল ইরানের । মঙ্গলবার রাতে ইসরায়েলের আকাশে মুর্হুমুহু মিসাইল হামলা শব্দ ও সাইরেনের শব্দ শোনা গিয়েছিল। কিন্তু বিশাল হামলার তুলনায় নেগেব মরুভূমিতে নেভাতিম বিমান ঘাঁটিতে সামান্য ক্ষতি হয়েছে। পশ্চিম তীরে একজন নিহত হয়েছেন, কিন্তু ইসরায়েলে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

ইরানের সামরিক বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি ঘোষণা দিয়েছেন, ইরানের ভূখণ্ডে পাল্টা হামলা হলে, ইসরায়েলজুড়ে আরও অনেক অবকাঠামোর উপর হামলা করা হবে। প্রয়োজনে বারে বারে তীব্র হামলা করা হবে।

গত এক বছর ধরে ফিলিস্তিনের গাজা শহরকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা পেজার ও ওয়াকিটকিতে যোগাযোগ করতেন। ওগুলোতে গোপনে বিস্ফোরক ভরে পরে সেগুলোকে বিশেষপদ্ধতিতে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। যোগাযোগ নেটওয়ার্ক ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এরপর গোয়েন্দা তথ্যেরভিত্তিতে লেবাননে হাসান নাসরাল্লার গোপন ডেরায় বিমান হামলা করে তাকে হত্যা করা হয়। হাসান নাসরাল্লাহ ছাত্রাবস্থা থেকে ইরানের ধর্মীয় নেতা খামেনির ঘনিষ্ঠ। তার মৃত্যুতে ইরান পালটা জবাব দেবে, এটা অনুমেয় ছিল। যে কারণে মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা বাড়ার শঙ্কা করা হয়েছিল কয়েকদিন ধরেই। এখন একটা যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছে মধ্যপ্রাচ্যে। ইসরায়েলে হামলার পর, তার ঘনিষ্ঠ মিত্র আমেরিকা যাতে কোনো হস্তক্ষেপ না করে সেজন্য আহবান জানিয়েছে ইরান। কিন্তু আমেরিকার প্রতিরক্ষামন্ত্রী এই আক্রমণকে জঘন্য হামলা বলে অভিহিত করেছেন।

ইরান এবার হাইপারসনিক ফাতেহ-২ মিসাইল ব্যবহার করেছে। যা ঘন্টায় ১০ হাজার মাইল গতিবেগে লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করতে পারে। আড়াই বছর আগে আমেরিকার গোয়েন্দা প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ইরানের কাছে তিন হাজারের মতো ব্যালেস্টিক মিসাইল রয়েছে। ইসরায়েলের সঙ্গে যদি পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধ বেঁধে যায় সে ক্ষেত্রে ইরান তার ব্যালেস্টিক মিসাইলের সংখ্যা আরএ বাড়াতে চাইবে।

কয়েক মিনিটের মধ্যে এত মিসাইল হামলা প্রতিরোধের চেষ্টা ইসরায়েলের অত্যন্ত জটিল আকাশপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকেও বিপর্যস্ত করেছে। ইসরায়েলের হামলা প্রতিরোধী মিসাইলগুলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং এর মজুত নিশ্চিত অনিশ্চয়তার মধ্যে।

আকাশের মধ্যেই ব্যালিস্টিক মিসাইল ধ্বংস করার কাজটি করে মূলত আমেরিকা ও ইসরায়েলের গবেষকদেরা তৈরি এরো-৩ ও এরো-২ ব্যবস্থা। ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের সময় এটি প্রথম ব্যবহার করা হয়। এই ব্যবস্থাকে সহায়তা করে মধ্যমমাত্রার ডেভিডস্ট্রিং ব্যবস্থা।

ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আয়রন ডোম মূলত স্বল্পদূরত্বের হামলা মোকাবেলা করতে পারে। হামাস গাজা থেকে থেকে যে রকেট ছুঁড়ত, সেগুলো মূলত আইরন ডোম ব্যবস্থার ঠেকিয়ে দেওয়ার কারণেই ইসরায়েলের তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি করতে পারেনি।

এরো-৩ মিসাইল প্রতিরোধ ব্যবস্থা ৬২ বা তারচেয়ে বেশি উচ্চতায় উড়ে আসা ও ১৪৯০ মাইল দূরত্বের হামলাব প্রতিরোধ করতে সক্ষম। এরো-২ মিসাইল প্রতিরোধ ব্যবস্থা ৩১ মাইল উঁচু ও ৬২ মাইল দূরত্বের ছোড়া হামলা ঠেকাতে পারে।

ডেভিড স্ট্রিং সিস্টেম ৯.৩ মাইল উঁচু ও ১৮৬ মাইল দূরত্বের হামলা ঠেকাতে সক্ষম। আর আয়রন ডোম খুব নিচ দিয়ে উড়ে আস হামলা প্রতিরোধ করতে পারে। এটি ৪৩ মাইল দূরত্বের হামলা ধ্বংস করে দিতে সক্ষম। ইসরায়েলের আয়রন ড্রোম প্রযুক্তি হলো সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে জটিল ও কার্যকরী আকাশ পথে হামলা প্রতিরোধী ব্যবস্থা। গাজা থেকে হামাস ও লেবানন থেকে হিজবুল্লাহ যখন কোনো স্বল্পমাত্রার রকেট, মিসাইল বা ড্রোন হামলা চালাতে এই ব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা সনাক্ত করে ফেলত। তারপর এটি তার নিজস্ব প্রতিরোধী মিসাইল ছুড়ে শত্রু হামলা ধ্বংস করে। এই ব্যবস্থা এটাও নিরুপণ করতে পারে যে হামলাটি কোনো জনবহুল এলাকায় পড়বে কিনা। ২০১১ সালে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে ইসরায়েল। বিভিন্ন শহরে চার থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরত্বেও হামলা রোধ করার জন্য ১০টি আয়রন ডোম ব্যবস্থাপনা আছে। এমনকি সাগরে বিমাণবাহী রণতরী ও যুদ্ধজাহাজকে বিমান ও মিসাইল হামলা থেকে মোকাবিলা করার জন্য আয়রন ডোমের একটি নৌসংস্করণ তৈরি করেছে ইসরায়েল।

গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনমতে, প্রতিটি এরো মিসাইলের পেছনে সাধারণত খরচ পড়ে সাড়ে তিন মিলিয়ন ডলার।। ডেভিড স্ট্রিং প্রতিরোধী মিসাইলের খরচ এক মিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে দুইশর মতো ছোড়া ইরানের মিসাইল প্রতিরোধ করতে গিয়ে ইসরায়েলের কয়েকশ মিলিয়ন ডলারের ব্যবস্থা ব্যবহার করতে হয়েছে। অপরদিকে প্রতিটি মিসাইল নির্মাণে ইরানের খরচ এক লাখ ডলারের মতো।

সম্প্রতি হামলায় এখন পর্যন্ত কয়েকটি মিসাইল ইসরায়েলের ভূমিতে আঘাত হেনেছে। তবে গত এপ্রিলেও ইসরায়েল অনেকগুলো ব্যালিস্টিক মিসাইল ছুড়েছিল, কিন্তু মাত্র ৯টি ইসরায়েলের ভূমিতে আঘাত করতে সক্ষম হয়েছিল। দুটি বিমান ঘাটির সামান্য ক্ষয়ক্ষতি করেছিল সেবার। সেবার ৩০০ ড্রোন ও ক্রুজ মিসাইল ব্যবহার করা হলেও এবার তা ব্যবহার করা হয়নি। ইরানের তৈরি শাহিদ ড্রোন রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহার করছে। এগুলোর সমস্যা হলো এগুলোর গতি অনেক কম। যা যুদ্ধ বিমান ও ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ধ্বংস করে ফেলতে পারে।

ইসরায়েল এই হামলার প্রতিশোধ নিবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু কখন ও কীভাবে তা বাস্তবায়ন করবে সেটি খোলাসা করেনি। ইসরায়েলের হামলার তীব্রতা কেমন হতে পারে তা গাজা ও লেবাননবাসী রক্ত দিয়ে বুঝতে পেরেছে। ভবিষ্যতে ইরানের উপরও সাজানো, ভয়ংকর ও পরিকল্পিত হামলা অপেক্ষা করছে এটা বলা বাহুল। ইসরায়েলের এই পাল্টা প্রতিশোধের উপর নির্ভর করছে, মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধ বেঁধে যায় কি না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *