ফুলবাড়ী (কুড়িগ্রাম) সংবাদদাতা
৫ আগস্ট আওয়ামীলীগ সরকার পতনের পর থেকেই প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে বেশ দূরত্ব দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী গ্রেপ্তার ও আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের মৃত্যুতে সেই দূরত্ব আরও বেড়েছে। তবে রাজনীতির এমন অস্থিতিশীল অবস্থাতেও মিলেমিশেই থাকছেন বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তবর্তী খলিশাকোঠাল ও বসকোঠাল গ্রামের বাসিন্দারা।
সীমান্তে বাংলাদেশ ও ভারতের নাগরিকদের নেই সম্পর্কের ব্যবধান। চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে কাঁটাতারের বেড়া। মাইলের পর মাইল কাঁটাতারের বেড়া থাকলেও সম্পর্কের ব্যবধান নেই বাংলাদেশ অংশে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার খলিশাকোঠাল ও ভারতের অংশে কোচবিহার জেলা সাহেবগঞ্জ থানার বসকোঠাল গ্রামের মানুষ-জনের মধ্যে।
যেখানে অধিকাংশ মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে পাশের দেশ ভারত যাওয়া মানেই পাসপোর্ট-ভিসার মতো কিছু আনুষ্ঠানিকতা লাগে। যেখানে এক দেশ থেকে অন্য দেশ যাওয়ার বেশ আগেই কিছু প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হয়। কিন্তু ভিন্ন চিত্র দেশের উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের সীমান্তঘেষা খলিশাকোঠাল সীমান্তে যারা বসবাস করে আসছেন তাদের কাছে বিষয়টি একেবারে ভিন্ন রকমের। তাদের অনেকের কাছে সীমান্ত অদৃশ্য। পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই তারা আসা-যাওয়া করেন এপার-ওপার।
বাংলাদেশের সীমানায় ভারতীয়দের ও ভারতীয় সীমানায় বাংলাদেশিদের দেখা মিলে অহরহই। তারা এই সীমান্তের জমিতে কাজ করার জন্য প্রতিটি দিন ‘সীমানা অতিক্রম’ করেন এবং প্রতিটি দিন একে অপরের বাড়িতে যাওয়া-আসাসহ খাবারও আদান প্রদান করে আসছেন। তবে তাদের জন্য ‘সীমানা অতিক্রম’ শব্দটি সম্ভবত প্রযোজ্য না। কারণ, কৃষিকাজসহ নিত্য প্রয়োজনীয় কাজের জন্যে তারা শুধুমাত্র যাওয়া আসা করেন। শুধুই ফুলবাড়ী উপজেলার খলিশাকোঠালসহ উপজেলা জুড়ে ৩৬ কিলোমিটার সীমান্তে নয়, জেলার বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় একই চিত্র দেখা গেছে দুই দেশের নাগরিকদের মাঝে সম্প্রীতির বন্ধন।
খলিশা কোঠাল সীমান্তের বাসিন্দা আবুল কাসেম (৬১)। তার বাবা চাচারা দুই ভাই। আবুল কাসেমের বাবা এন্তাজ আলী। এন্তাজের ভাই মনছুর আলী। আপন দুই ভাইয়ের বাড়ির দূরত্ব মাত্র ১০ থেকে ১৫ গজ। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর যখন বাংলাদেশ-ভারত ভাগ হয় তখন দুই ভাই দুই দেশের নাগরিক। এন্তাজ আলী বাংলাদেশের নাগরিক ও মনছুর আলী ভারতের নাগরিক। দুই ভাই দুই দেশের নাগরিক হলেও তাদের মধ্যে সম্পর্কের ব্যবধান ও বাংলাদেশ-ভারতে যাওয়া আসাতে কোনো দিনও বাঁধা পড়েনি। এন্তাজ আলী ও মনছুর আলী মারা যাওয়ার পর তাদের ছেলে-মেয়েসহ আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশীদের মাঝেও সেই সম্পর্কের ব্যবধান এখনো কমেনি। পাশাপাশি দুই দেশের নাগরিকদের ভালো সম্পর্কে কারণে কিছু বাংলাদেশি নাগরিক ভারতীয় নাগরিকদের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করে আসছেন। তবে দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে যে সম্প্রীতির বন্ধন তৈরি হয়েছে সেটি, সীমান্তের জিরোলাইন থেকে ১৫০ গজ ও সর্বোচ্চ ৩০০ গজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
খলিশা কোঠাল সীমান্তে বসবাসরত বাংলাদেশি বাসিন্দা আবুল কাসেম (৬১) জানান, আমার বাড়ি থেকে ভারতে আমার জ্যাঠাতো ভাইয়ের বাড়ির দূরত্ব মাত্র ১০ থেকে ১৫ গজ। আমরা সব সময় দুই পরিবারের মাঝে প্রতিনিয়ত যাওয়া আসা করি। আমার বাপ-জ্যাঠার আমল থেকে আজ পর্যন্ত কোনো আমাদের দুই পরিবারের সম্পর্কের ব্যবধান কমেনি। দিন রাতে যাওয়া আসা হয়ে থাকে। শুধু আমাদের দুই পরিবারের মাঝে নয়। এখানে আমরা জ্যাঠাতো ভাইয়ের বাড়ির সাথে এক লাইনে প্রায় ২০ টি ভারতীয় পরিবারের বসবাস। সঙ্গে আমাদের বাংলাদেশি পরিবারও প্রায় ২৫ টি। তাদের সঙ্গে আমরা অত্যন্ত মিলেমিশে যুগের পর যুগ বসবাস করে আসছি। সেটি দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি -বিএসএফরাও জানেন। প্রায় দিনই বিজিবি ও বিএসএফ সদস্যরা খোঁজ খবর নেন এবং আমাদের বাড়ির কাছেই প্রায় সময় পতাকা বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। সব সময় বিজিবি ও বিএসএফ সদস্যরা খোঁজ খবর রাখেন। ফলে আমরা দুই দেশের নাগরিকরা খুবই শান্তিপূর্ণ ভাবে বসবাস করে আসছি। যার কারণে আমাদের দুই দেশের নাগরিকদের আজ পর্যন্ত কোন বিবাদের সৃষ্টি হয়নি। তিনি আরও জানান বাড়ীর পূর্ব ও উত্তর দিকে প্রায় দুই কিলোমিটার কাঁটাতারের বেড়া নেই। কিন্তু তিন ফিট লম্বা সিঙ্গেল কাঁটাতারের বেড়া থাকায় ২৪ ঘন্টা ভারতীয় বিএসএফ সদস্যরা টহল দেন।
ওই সীমান্তের বাংলাদেশি নাগরিক হযরত আলী জানান, আমার বাড়ি থেকে মাত্র পাঁচ ফুট দুরস্ত প্রতিবেশী ভারতীয় নাগরিকের বাড়ি। আমরা এই সীমান্তে দুই দেশের প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ টি পরিবার বসবাস করে আসছি। আমাদের মধ্যে আজ পর্যন্ত কোনো দ্বন্দ্ব হয়নি। তারাও আমাদের বাড়িসহ আশপাশের বিভিন্ন বাড়িতে যাওয়া আসা করে। আমরাও তাদের বাড়িতে যাওয়া আসা করি। কোনো সমস্যা নেই। এছাড়াও প্রায় দিন বিজিবি ও বিএসএফ সদস্যরা আসেন খোঁজ খবর নিতে।
আপনার বাড়িটি এখান থেকে কতদূর এমন প্রশ্ন করলে ওই ভারতের বসকোঠাল গ্রামের বাসিন্দা বলেন, এখান থেকে ২০ গজ দুরে ঐ যে দেখা যাচ্ছে আমার বাড়ি। আমার বাপ-দাদার আমল থেকে বাংলাদেশের প্রতিবেশীর বাড়িতে যাওয়া আসা করি। যদি বাংলাদেশ একটি আলাদা দেশ। কিন্তু এই টুক জায়গায় আসতে পাসপোর্ট ভিসা লাগে না আমাদের। আমরা এভাবেই সীমান্তে যুগের পর যুগ মিলেমিশে বসবাস করছি। সেটি আমাদের বিএসএফ ও বাংলাদেশের বিজিবি সদস্যরা জানেন।