রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ না হলে কীভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে, প্রশ্ন আনু মুহাম্মদের

জাতীয় রাজনীতি

সুবর্ণবাঙলা অনলাইন ডেস্ক

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ‘স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের পথ: বৈষম্যহীন বাংলাদেশের সন্ধানে’ শীর্ষক সেমিনারে সমাপনী বক্তব্য দেন। ঢাকা, ২০ জানুয়ারি

ধর্মনিরপেক্ষ না হলে একটা রাষ্ট্র কীভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে—এই প্রশ্ন তুলে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে হচ্ছে রাষ্ট্র, জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ—এসব বিষয়ে রাষ্ট্র নিরপেক্ষ থাকবে। রাষ্ট্র সবাইকে সমান অধিকার ও সুযোগ দেবে। কোনো রাষ্ট্র যদি এই অবস্থানটা না নেয়, তাহলে তো সে রাষ্ট্র এমনিতেই অন্য ধর্মাবলম্বীদের আলাদা করে দিচ্ছে।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে সংবিধানের মূলনীতি থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি বাদ দেওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আনু মুহাম্মদ এ কথা বলেন। আজ সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে ‘স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের পথ: বৈষম্যহীন বাংলাদেশের সন্ধানে’ শীর্ষক সেমিনারে সভাপ্রধান হিসেবে সমাপনী বক্তব্য দেন তিনি। দিনব্যাপী এই সেমিনারের আয়োজন করে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ বিশ্লেষণমূলক জার্নাল ‘সর্বজনকথা’। সর্বজনকথার সম্পাদক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।

আনু মুহাম্মদ বলেন, সংবিধান সংস্কারের একটা প্রস্তাব করা হয়েছে, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটা বাদ দেওয়া হয়েছে। এই শব্দটা বাহাত্তরের সংবিধানে ছিল। তিনি বলেন, ‘তাতে যে আমরা ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ পেয়েছি, তা নয়। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকলেও আমাদের বিভিন্ন সরকার ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল।…বর্তমান সরকার ও সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর কাছে এখন আমরা “ইনক্লুসিভ” (অন্তর্ভুক্তিমূলক) শব্দটা শুনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘কারও কারও কাছ থেকে এই প্রশ্নও শুনি যে আমরা ধর্মনিরপেক্ষ হব নাকি অন্তর্ভুক্তিমূলক হব? এই প্রশ্নটা আমি বুঝতে পারি না। কারণ, ধর্মনিরপেক্ষ না হলে একটা রাষ্ট্র কীভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে?’

আনু মুহাম্মদ বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে হচ্ছে রাষ্ট্র, জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ—এসব বিষয়ে রাষ্ট্র নিরপেক্ষ থাকবে। সে সবাইকে সমান অধিকার ও সুযোগ দেবে। কোনো রাষ্ট্র যদি এই অবস্থানটা না নেয়, তাহলে তো সে এমনিতেই অন্য ধর্মাবলম্বীদের আলাদা করে দিচ্ছে। সে কী করে অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে?

এ প্রসঙ্গে আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ যাচ্ছে, কিন্তু বাদ দিয়ে কোথায় যাবে। সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্ম অনুযায়ী রাষ্ট্র চলবে, এটা যদি হয়, তাহলে ভারতে বিজেপি তো ঠিকই আছে। অথচ ভারতে মুসলমানদের জন্য প্রকৃত অর্থে একটা বড় নিরাপত্তার জায়গা হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। যে জন্য শাহি মসজিদের ইমাম থেকে শুরু করে ভারতের যত মুসলিম ধর্মীয় নেতা আছেন, সবার একটাই দাবি—ভারত যেন ধর্মনিরপেক্ষ থাকে এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি যেন প্রতিষ্ঠিত হয়। সুতরাং এখানে যারা ধর্মনিরপেক্ষতাকে অস্বীকার করে, তারা ভারতের মুসলমানদের নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ফেলছে।

গণ-অভ্যুত্থানের সময় দেয়ালচিত্রগুলোকেই ঘোষণাপত্র হিসেবে বিবেচনার কথা উল্লেখ করে সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, ‘সেখানে যে আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে, বর্তমান অন্তর্র্বতী সরকার ও তাদের ঘনিষ্ঠ সংগঠনগুলো তা থেকে অনেক পেছনে আছে।’

মতপ্রকাশে বাধা ও বৈষম্য
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর মতপ্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের পর দেখা যাচ্ছে, মতপ্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করা, সহিংসতা বা চাপ সৃষ্টি করা, হামলা-হুমকির একটা নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। সেটা অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মের নামে হচ্ছে। তিনি বলেন, অভ্যুত্থানে সব ধর্ম-মত, নারী—সবাই অংশ নিয়েছে। তখন গণতান্ত্রিক চৈতন্যটা খুব শক্তিশালী ছিল। কিন্তু আন্দোলন শেষ হয়ে যাওয়ার পর অসহিষ্ণু বা নিপীড়ক একেকটা পক্ষ আবির্ভূত হচ্ছে।

পাকিস্তানের ২২ পরিবারের চেয়ে বাংলাদেশের ২২ পরিবার অনেক বেশি সম্পদশালী—এমন মন্তব্য করে আনু মুহাম্মদ বলেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের সম্পত্তি ও লুণ্ঠনের প্রক্রিয়ায় এখনো ছেদ পড়েনি। সেই সম্পত্তি রাষ্ট্রের মালিকানায় নিয়ে আসার কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। কিন্তু সরকার বলছে তাদের টাকার অভাব এবং সে জন্য জনগণের ওপর ভ্যাটের বোঝা চাপিয়েছে। দেশে বৈষম্য বৃদ্ধির বিষয়টা একটা সামগ্রিক নীতিকাঠামোর মধ্য দিয়েই এসেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা এরশাদ, খালেদা জিয়া, হাসিনা দেখি। কিন্তু অদৃশ্য কিছু শক্তি আছে, যাদের আমরা অত বেশি চোখে দেখি না।’

শিল্প, কৃষি, অনানুষ্ঠানিক খাত, জ্বালানি-বিদ্যুৎ, শিক্ষা, চিকিৎসা—এসব জায়গায় কী ধরনের পরিবর্তন হলো, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ করতে গেলে তা অনুসন্ধান করে সামগ্রিক পরিকল্পনায় করতে হবে বলে উল্লেখ করেন আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, এই পরিবর্তন করতে গেলে একটা অদৃশ্য সরকার দেখা যাবে। বাংলাদেশে একটা অদৃশ্য সরকার এসব নীতি প্রণয়ন করে, যারা কখনো আলোচনায় আসে না।

রাজনৈতিক দলেও প্রয়োজন সংস্কার
রাজনৈতিক দলগুলোরও সংস্কার বা পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি দলগুলোর সুনির্দিষ্ট তিনটি ক্ষেত্রে পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন।

আনু মুহাম্মদের মতে, রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব যাঁরা দেবেন, তাঁদের একটা অবসরের বয়স ঠিক করতে হবে। দলের সব পর্যায়ের কমিটি যেন নির্বাচনের মাধ্যমে হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া জাতীয় রাজনৈতিক দল তাকেই বলা যাবে, যে দলে সমাজের সব অংশ বা বৈচিত্র্যের (নারী-পুরুষ, অন্য লিঙ্গ, অন্যান্য ধর্ম, বিভিন্ন বিশ্বাস) প্রতিনিধিত্ব থাকবে।

বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের সমালোচনা
বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের কড়া সমালোচনা করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, যে নীতিমালার কারণে শেখ হাসিনার এই লুণ্ঠন ও সম্পদ পাচারের মডেলটা দাঁড়িয়েছিল, সেই নীতিমালা প্রণয়নের প্রধান কারিগর হচ্ছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি গোষ্ঠী। তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

অন্তর্র্বতী সরকারও বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের ওপরই ভরসা করছে উল্লেখ করে আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, বাংলাদেশের কিছু পরামর্শক, অর্থনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ, আমলা এবং কিছু ব্যবসায়িক গোষ্ঠী—এদের সম্মিলিত একটা জোটের মধ্য দিয়ে অর্থনীতির এই দশা। ফলে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের কথা বলে আবার এদের ওপরই ভর করলে কোনো পার্থক্য হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *