দেশজুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ, রোগী ফেলে আন্দোলন!

জাতীয় রাজনীতি স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা

সুবর্ণবাঙলা ওয়েব ডেস্ক

ওয়ার্ড ফাঁকা রেখে চিকিৎসকরা কর্মবিরতি পালন করেন রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে 

লাফিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। পরিসংখ্যানই জানান দিচ্ছে, কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে এডিস মশাবাহিত এ রোগ। গতকাল শনিবার এ বছরের সর্বোচ্চ ডেঙ্গু রোগী আক্রান্ত হওয়ার তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত ২৪ ঘণ্টায় ৮২০ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার বিপরীতে আছে আরেক দুঃসংবাদ। ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে চিকিৎসাসেবা ফেলে কর্মবিরতিতে গেছেন বেসরকারি ট্রেইনি চিকিৎসকরা। এতে ব্যাহত হচ্ছে ডেঙ্গু চিকিৎসা, ভোগান্তিতে পড়েছেন রোগী ও স্বজনরা।

এরই মধ্যে ডেঙ্গু ৫৮ জেলায় ছড়িয়েছে। নগর থেকে গ্রাম– সবখানেই মিলছে ডেঙ্গু রোগী। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন আরও দু’জন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ২ হাজার ৫০২ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ১ হাজার ৭৭৩ জন ও ঢাকার বাইরে ৭২৯ জন। গত ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত সারাদেশে ১২ হাজার ১১৮ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ঢাকায় ৮ হাজার ৫৭৪ জন ও ঢাকার বাইরের রোগীর সংখ্যা ৩ হাজার ৫৪৪। এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৬৭ জন। এর মধ্যে গত ৮ দিনে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

এদিকে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা, যথাযথ পরিকল্পনা, পূর্ব প্রস্তুতি ও কার্যকর বাস্তবায়নের ঘাটতির কারণেই রাজধানীসহ প্রায় সারাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে বলে মনে করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। পাশাপাশি চলমান পরিস্থিতিকে ‘জনস্বাস্থ্য সংকট’ ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।

রোগীতে ঠাসা হাসপাতাল

রাজধানীর হাসপাতালে হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী। শয্যা না পেয়ে মেঝে ও বারান্দাতে ঠাঁই হয়েছে অনেকের। অতিরিক্ত এসব রোগীর চিকিৎসা দিতে চিকিৎসকদের অবস্থা হিমশিম। এর মধ্যে চিকিৎসকের কর্মবিরতি ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ পরিস্থিতি তৈরি করছে। বিশেষ করে ডেঙ্গু আক্রান্তদের হাসপাতালে জ্বর নিয়ে আসার পর চিকিৎসকের দেখা পেতেই দিন পার হচ্ছে। একাধিক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ট্রেইনি চিকিৎসকরা কাজ বন্ধ রাখায় রোগীদের স্বাভাবিক সেবায় ব্যাঘাত ঘটছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চারটি মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তির ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ডেঙ্গু রোগী। এই হাসপাতালে ২২৪ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন। এই চার ওয়ার্ডে ৪৬০ জন ট্রেইনি চিকিৎসক প্রতিদিন দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মোট ট্রেইনি চিকিৎসক রয়েছেন দেড় হাজারের মতো। এসব চিকিৎসকের ৭০ শতাংশ রোগীর চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। এই বিপুল সংখ্যাক চিকিৎসক ছাড়া হাসপাতালে একধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং মুগদা জেনারেল হাসপাতাল ঘুরে কোথাও একজন ট্রেইনি চিকিৎসকের দেখা মেলেনি। ঢামেক হাসপাতালের অধিকাংশ ওয়ার্ডে রোগীরা চিকিৎসকের অপেক্ষায় ছিলেন। চাপ সামাল দিতে না পেরে রোগীর সঙ্গে নার্সদের খারাপ আচরণ করতে দেখা যায়। এক রোগীর স্বজন সুজন আহমেদ বলেন, ডেঙ্গু পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে চিকিৎসকের অপেক্ষায় বসে আছি। গত শুক্রবার ভর্তি হলেও এখনও চিকিৎসা শুরু হয়নি।

অনেক রোগী ও স্বজনরা অভিযোগ করেন, জ্বর নিয়ে আসার পর চিকিৎসকের দেখা পেতেই সারাদিন চলে যাচ্ছে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর চিকিৎসক দেখাতে না পেরে অনেকের ফিরে যেতে হয়েছে। ভর্তি রোগীর স্বজনরা অভিযোগ করেন, রক্ত পরীক্ষার জন্য ভোর ৪টা থেকে লাইন দিতে হয়। রক্ত দেওয়ার পর রিপোর্ট পেতে লাগছে লম্বা সময়। রিপোর্ট হাতে পেলেও চিকিৎসককে দেখাতে পারছেন না রোগীরা।

ঢামেক হাসপাতালে আজিমপুরের বাসিন্দা মা মাকসুদা বেগম বলেন, ১৩ বছরের ছোট ছেলে ডেঙ্গু আক্রান্ত। শনিবার সকালে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। সারাদিন অপেক্ষা করে চিকিৎসকের দেখা পাইনি। একজন নার্স রিপোর্ট দেখে নিশ্চিত হন ডেঙ্গু হয়েছে। ৬০২ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি হলেও শনিবার আড়াইটা পর্যন্ত তার কোনো চিকিৎসা দেওয়া হয়নি।

যে কারণে আন্দোলন

মূলত সরকারি হাসপাতালে রোগীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করেন বেসরকারি ট্রেইনি চিকিৎসকরা। সপ্তাহে তিন-চার দিন সরকারি চিকিৎসকরা শুধু হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। বাকি সময় সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার দায়িত্ব এই ট্রেইনি চিকিৎসকদের। এরা ছাড়া হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম অনেকটাই অচল হয়ে পড়ে। হঠাৎ গতকাল থেকে তাঁরা ভাতা বাড়ানোর দাবিতে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি শুরু করেন। তাদের দাবি, ভাতা ২০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার করা।

দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা হাসপাতালে ফিরবেন না বলে হুমকি দিয়েছেন। আজ রোববার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তাদের গণঅনশনের কথা রয়েছে। বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজ ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রায় সাড়ে ৮ হাজার চিকিৎসক এ আন্দোলনে রয়েছেন। ঢাকার বাইরেও অনেক হাসপাতালের ট্রেইনি চিকিৎসকরা এ কর্মবিরতিতে রয়েছেন।

পোস্ট গ্র্যাজুয়েট প্রাইভেট ট্রেইনি ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের (পিজিপিটিডিএ) সহসভাপতি তানভীর আহমেদ বলেন, সরকার আমাদের ভাতা বাড়ানোর গেজেট জারি না করা পর্যন্ত আমরা আমাদের কর্মবিরতি চালিয়ে যাব।

ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. নাজমুল হক বলেন, এ সময় কর্মবিরতিতে যাওয়া চিকিৎসকদের ঠিক হয়নি। আমাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ট্রেইনি চিকিৎসক রয়েছেন। তাই আমরা স্বাভাবিক রোগীর সেবা বজায় রাখতে সমস্যায় পড়ছি। আন্দোলন দীর্ঘ হলে ভোগান্তি বাড়বে। তিনি বলেন, তাঁরা পরিস্থিতি সম্পর্কে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, রোগীদের জিম্মি করে আন্দোলন না করে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে চিকিৎসকরা তাদের দাবি জানাতে পারতেন। তাঁরা বেতন বাড়ানো দাবি করতেই পারেন। তবে কর্মবিরত পালন করা ঠিক হয়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *