‘জওয়ান’ কেন দেখা প্রয়োজন?

বিনোদন

অনলাইন ডেস্ক

জওয়ান সিনেমার একটি পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি ভারতীয় সিনেমা ‘জওয়ান’ ভারত, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুক্তি পেয়েছে। ভারতীয় সব ভাষায় মুক্তির প্রতীক্ষায় এ দক্ষিণী সিনেমা। হিন্দি, তামিল ও তেলেগু ভাষায় গত পাঁচ দিনে (এ লেখা পর্যন্ত) আয় করেছে প্রায় ৩৯০ কোটি টাকা। দুদিনে বাংলাদেশে এর আয় ৩৫ লাখ টাকা। সোশ্যাল মিডিয়ার বিবরণে দেখা যাচ্ছে, মুভি শেষ করে দর্শকরা সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে বলছেন—‘ফুল অন এন্টারটেইনমেন্ট অথবা পয়সা উসুল।’ বলা যায় জওয়ানের উন্মাদনায় কাঁপছে বিশ্ব। এত জওয়ান ঘিরে কেন এত হাইপ? এটা কি শুধু ভারতের দর্শকদের জন্য নির্মিত ছবি?

হিন্দি ‘জওয়ান’ শব্দের বাংলা অর্থ যৌবনের দূত (অফুরন্ত প্রাণশক্তি যার ভেতরে থাকে)। সিনেমার নামকরণই হাইপ তৈরিতে প্রাথমিকভাবে সার্থক। বলিউডে সামাজিক সচেতনতা নিয়ে ছবি নির্মাণের প্রবণতা প্রায়ই লক্ষ করা যায়; কিন্তু জওয়ান সিনেমাকে দক্ষিণী পরিচালক অ্যাটলি কুমার নিজে আখ্যায়িত করেছেন ‘সোশ্যালি চার্জড সিনেমা’ হিসেবে। রেড চিলিস প্রযোজনা সংস্থা সিনেমা নিয়ে এসেছে নবযৌবনপ্রাপ্ত নওজোয়ানদের জন্য, যারা অনেক উদ্যমী। যারা শুধু সামাজিকভাবে সচেতন হবে না, তারা আগামীতে সচেতন নাগরিক হিসেবে ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা করতে শিখবে। সচেতন নাগরিক হিসেবে সামাজিক অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শিখবে। অ্যাটলি নিজেও অনেক দক্ষিণী সিনেমার জনপ্রিয় একজন সংলাপ রচয়িতা। তিনি রামানিভাসান এবং ডায়ালগ রচয়িতা টিম মিলে চার বছরের দীর্ঘ গবেষণার ফল জওয়ানের স্ক্রিপ্ট। পুরো ভারতবর্ষে চলে আসা গুরুত্বপূর্ণ অনিয়মের ঘটনাকে তুলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে আলোচ্য সিনেমায়।

‘জওয়ান’ সিনেমা শুধু ছোট ছোট কাহিনির মালা গাঁথেনি; বরং ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য অনিয়মের ঘটনা তুলে ধরে জওয়ানের ভাষায় একটি করে সরাসরি সচেতনতামূলক বার্তা দেওয়া হয়েছে। প্রোটাগনিস্ট শাহরুখ খানের দ্বৈত চরিত্র দুই প্রজন্মকে ইঙ্গিত করে—একদল যারা বয়সে বৃদ্ধ; কিন্তু অভিজ্ঞতায় এবং প্রাণশক্তিতে যুবক অর্থাৎ যাদের মানসিক যৌবন শেষ হয়ে যায়নি তাদের (যেই চরিত্রটি সিনেমায় বিক্রম রাঠোর নামের পুলিশ অফিসার হিসেবে অভিনীত)। অন্যদিকে ৩০ বছর পর শাহরুখের সন্তান হিসেবে অভিনীত শাহরুখেরই দ্বৈত চরিত্র আজাদ রাঠোর, যিনি পেশায় একজন জেলার। যার জন্ম প্রায় একই সামাজিক সিস্টেমের পরিক্রমায়। ফলে সে অনিয়মকে প্রতিহত করতে চায় নিজস্ব নিয়মে। বিভিন্ন ছদ্মবেশে সামাজিক অনিয়মকে প্রতিহত করার পন্থা সঠিক না হলেও, ছয় ভুক্তভোগী নারী সাজাপ্রাপ্ত আসামির টিমকে নেতৃত্ব দিয়ে নিষ্পাপ মাকে দেওয়া কথা রাখার চেষ্টা করে সে। সমাজের নানা স্তরের বৈষম্য নিরসন করেও শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী অভিনীত চরিত্রকে দিয়েও পরিচালক বলিয়ে নেয় যে—This is a wakeup call.

‘জওয়ান’ সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক সামাজিক-সাংস্কৃতিক উপাদান। যেমন—প্রথমেই বাজপাখির চোখে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় উত্তর ভারতের কোনো এক সংখ্যালঘু ট্রাইবাল অঞ্চলে, যেখানে মুমূর্ষু বিক্রম রাঠোরের চিকিৎসা চলছে। এরপরই সেই একই সময় ট্রাইবের ওপর হামলা। এ হামলা কারা করল যদিও স্পষ্ট নয়। তবে সেখানকার প্রেক্ষাপটে বেশ কিছু বিষয় সহজেই বুঝে নেওয়া যায়। যেমন ভারতের সঙ্গে চীন-পাকিস্তান বর্ডার যুদ্ধ। এ ছাড়া বর্ডারের ট্রাইবদের এলাকা দখল বা আন্তঃগোত্রীয় হামলা। জওয়ান সিনেমা সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া মণিপুর হামলার ঘটনা বড় তথ্যসূত্র হিসেবে মনে করিয়ে দেয়।

অন্যদিকে একটা উত্তর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন ট্রাইবের জীবন ঘিরে আছে তাদের নিজস্ব চিকিৎসা ব্যবস্থা বা ট্র্যাডিশনাল হিলিং সিস্টেম, যা পুরো সিনেমা জুড়ে সরাসরি এবং প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এরপরই দেখানো হয়েছে মুম্বাইয়ে মেট্রোরেল ছিনতাই এবং কৃষিমন্ত্রীর থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা দাবির ঘটনা। এ ঘটনার মধ্য থেকে জওয়ানের কণ্ঠে স্পষ্ট উচ্চারিত হয়—‘গাড়ির জন্য লোনের সুদ ৮ শতাংশ; কিন্তু কৃষকের জন্য সুদ ১৩ শতাংশ, যা কমানোর দাবি জানানো হয়। আমরা সবাই কমবেশি জানি, ভারতের মহারাষ্ট্রে কৃষকরা সুদ পরিশোধ না করতে পারায় প্রায়ই আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। যেখানে এ সমস্যা নিরসনে ভারতীয় এনজিওগুলো কাজ করতে হিমশিম খাচ্ছে। বাংলাদেশের কৃষকদেরও প্রায় সময় এ ধরনের দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে।

একের পর এক নির্ভয়া অভিযানে কখনো স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দুর্নীতিকে লোকের সামনে তুলে ধরে। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালগুলোতে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থাসহ নানা ঘটনা দেখা যায় এ সিনেমায়। সেই ঘটনাগুলো আমাদের বাস্তবের বেশ কিছু ঘটনা মনে করিয়ে দেয়; যেমন—মধ্যপ্রদেশের ভোপালের গ্যাস দুর্ঘটনা এবং তাতে অনেক মানুষের আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব এবং প্রক্রিয়ার চাপে কিছু অসৎ কর্তৃপক্ষের চক্রান্তের কারণে দুর্ভোগে পড়ে যাওয়া।

এ সিনেমায় উঠে এসেছে বিভিন্ন কলকারখানা স্থাপনের কারণে পরিবেশ দূষণের বিষয়টি। এমনকি অন্য দেশের সঙ্গে অন্যায় চুক্তি করে অর্থ এবং অস্ত্র পাচারের ঘটনা থেকে শুরু করে ভোটের ব্যালট বক্সের দুর্নীতি পর্যন্ত উঠে এসেছে আলোচ্য সিনেমায়। ফলে সিনেমার মূল ভিলেন হলেন একজন অস্ত্র ব্যবসায়ী, দক্ষিণী অভিনেতা বিজয় সেতুপাথি এ চরিত্রে অভিনয় করেছেন। এর সঙ্গে রয়েছে চিরাচরিত ভারতীয় সিনেমার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পারিবারিক ইমোশনাল কাহিনি।

নায়িকা দীপিকা এবং নয়নতারা দুজনই অত্যন্ত শক্তিশালী অভিনেত্রী। আজাদ এবং বিক্রমের সম্পর্কের পরিচয়ের যোগসূত্রে দীপিকা পাড়ুকোনের এন্ট্রিতেই প্রথম বুঝতে পারা যায় যে, অঞ্চলটি সাউথ ইন্ডিয়ার চেন্নাই, যেখানে দীপিকাকে কুস্তি লড়াইয়ে জিততে দেখা যায়। আবার সিনেমার শেষের দিকে পুলিশ অফিসার চরিত্রে সঞ্জয় দত্তের আবির্ভাব ও শাহরুখের ‘ওনাম’ উৎসবের শুভেচ্ছাই প্রমাণ করে সাউথ ইন্ডিয়ার সংস্কৃতি আবহকে।

গল্পের অনেক বৈচিত্র্য থাকলেও অনেক জায়গায় দুর্বলতা দেখা যায়। হয়তো সিনেম্যাটিক করতে গিয়ে ড্রামাটিক অ্যাকশন রাখা নয়তোবা ডিরেক্টর সব ঘটনা বলতে গিয়ে ডিটেইলিং করার সুযোগ ইচ্ছে করেই নিতে চাননি। যেমন—ভিলেন যখন শাহরুখকে গুলি করে এবং শাহরুখ আকাশ থেকে পড়ে দক্ষিণ থেকে উত্তর ভারতে চলে যায় সেটার একটি রেফারেন্স প্রথম দৃশ্যে ব্যাক ভয়েসে থাকলেও খানিকটা অবাস্তব লাগে। পুরো সিনেমায় আপাতদৃষ্টিতে নারীদের শক্তিশালী কমান্ডো চরিত্রে দেখালেও শেষ পর্যন্ত প্রতিটি নারীকে মনে হয় দুর্বল। সেটি অনেক জায়গায়ই দেখা যায়—বিশেষ করে যখন পুলিশ অফিসার নয়নতারা শাহরুখের টিমে যোগ দেয়। একই দৃশ্যে বাবা এবং ছেলেকে চিনতে পেরে মিলে যায় তখন নারী টিমের কার্যক্রম পুরো বিলুপ্ত।

অন্যদিকে জেলের ভেতরে যখন মারামারি চলছে তখন সব নারী (এমনকি সেই টিম যারা জেলের বাইরে গিয়ে এত ঘটনা ঘটাল, তারাও জেলের লকারের ভেতরে তালা বন্ধ)। ফলে এটাই প্রকাশ পায় যে, এখনো ভারতীয় নারীরা কমান্ডো প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় শেষ পর্যন্ত পরিবারের পুরুষ শক্তির কাছে বন্দি। জেলখানায় জেলার হয়েও শাহরুখের চরিত্র পুলিশ অফিসার নয়নতারার স্বামী, যিনি জাতিসংঘের বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ মহিলা-জেল প্রতিষ্ঠার জন্য পুরস্কারের অধিকারী। আকর্ষণীয় বিষয় হলো, তামিল ঘরানার গান-নাচ এবং পরিচালকের কয়েক সেকেন্ডের শাহরুখের সঙ্গে নাচের স্বপ্ন পূরণ দিয়ে শুধু কমার্শিয়াল বিনোদনই পাওয়া গেল।

এবার আসি টেকনিক্যাল বিষয়ে। সিনেমার দৃশ্যায়ন তামিল সিনেম্যাটোগ্রাফার বিষ্ণুর। যেহেতু তিনি অ্যাকশন দৃশ্য শুট করায় অত্যন্ত দক্ষ, সেহেতু তিনি দক্ষভাবেই তা করেছেন। এ ছাড়া রয়েছে সংগীত পরিচালক অভিনেতা রজনীকান্তের ভাগনে, যিনি নিজের যোগ্যতায়—ডঐণ ঞঐওঝ ঈঙখঅঠঊজণ উ গানের সংগীত পরিচালনা করে খ্যাতি পেয়েছেন। তার প্রথম হিন্দি ছবি হিসেবে জওয়ান সিনেমার গান কিছু ভিন্নতা এনেছে। প্রথম গানটি পুরোটাই সাউথ ইন্ডিয়ান ট্র্যাক। আবার পরেই ‘ছালিয়া’ গানটি বলিউড রোমান্টিক; কিন্তু এই একই গান আবার আরবি ট্র্যাকে এবং ‘রামাইয়া ভাস্তাভাইয়া’ গানের রিমিক্স শুনে এবং দেখে যতদূর মনে হয়েছে, কমার্শিয়াল ছোঁয়া দেওয়ার জন্যই করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের ক্ষেত্রেও নয়নতারার এবং শাহরুখ খানের অ্যাকশন দৃশ্যে কোরিয়ান অ্যাকশন ফাইট দেখাতে গিয়ে এর সঙ্গে কোরিয়ান ট্র্যাকে সাউথ ইন্ডিয়ান উচ্চারণে এ ইংরেজি গান যোগ করা হয়েছে।

আরেকটা বিষয় লক্ষ করার মতো। পুরো সিনেমায় আমরা দেখি শাহরুখ খানের কয়েক ধরনের মুখোশের ব্যবহার। শাহরুখের দ্বৈত চরিত্রের কারণে হয়তো এটি ব্যবহার করা হয়েছে; কিন্তু প্রথম কয়েক দৃশ্যে এবং পোস্টারের প্রমোশনে মাথায় আর শরীরে কমদামি ময়লা গজ জড়ানো শাহরুখ খানের ছবিটি অন্য এক অর্থ বহন করে। এটা সবাই জানে, শাহরুখ খানের সন্তান আরিয়ান ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে তিন পুলিশের করা মাদক মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার হয় এবং তাকে চার সপ্তাহ জেলে থাকতে হয় । এ সময় জোনাল ডিরেক্টর পুলিশ সমির ওয়ানখান্ডের কারণে পরিবারসহ কিং খানকে অনেক হেনস্তার শিকার হতে হয়, যা অনেকটাই সামাজিক, অনিয়ম প্রক্রিয়ার কারণে। যদিও পরবর্তী আট মাস পর সেই পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে ২৫ কোটি রুপি ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ করা হয়। আজও সেই মামলা প্রক্রিয়াধীন। ফলে অনেক সমালোচকদের মন্তব্য, এই গজ-কাপড় পরার প্রতীক প্রচলিত প্রক্রিয়ায় শাহরুখের আহত হওয়ার প্রতীক।

সিনেমার ডায়ালগেও ভিলেনকে শাহরুখ খানকে একবার বলতে দেখা গেছে যার বাংলা অর্থ হলো—‘সন্তানকে ছোঁয়ার আগে বাবার সঙ্গে কথা বলতে হবে।’ বলা হচ্ছে, এটি সেই পুলিশ অফিসার সমিরকে উদ্দেশ্য করে বলা। আবার এই সিনেমাকে ধরে নেওয়া হচ্ছে এটি শাহরুখ খান এবং গৌরী খানের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান রেড চিলিস এন্টারটেইনমেন্টের ‘ক্লিন ইন্ডিয়া বা স্বচ্ছ ভারত’ ক্যাম্পেইনের একটি উদ্যোগ। যেহেতু এটি একটি ক্যাম্পেইন, ফলে অবশ্যই এ সিনেমা শুধু বিনোদনের জন্য নয়, বরং সবার জন্য নির্মিত, সমাজ-সংস্কৃতি নির্বিশেষে স্বচ্ছ ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হচ্ছে। যে কথা সিনেমার সংলাপেই সরাসরি প্রতীকী জওয়ান আজাদকে দিয়ে বলানো হয়েছে এভাবে—‘চাল, নুন, তেল, সাবান কিনতে সবাই কত ভালোমন্দ, কতকিছু বিচার করে। ফলে যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচনেও সবাইকে বিবেচনা করা উচিত, যেন সব অসাম্প্রদায়িক শান্তিপূর্ণ দেশ গড়ে ওঠে।’ ফলে বিনোদন-ব্যবসায়িক লাভ-লোকসান ছাপিয়ে সর্বজনীন সচেতনতার বার্তা পৌঁছানোর নিমিত্তে এই সিনেমা ক্যাম্পেইন। এমন সিনেমার এমন হাইপ তৈরি হওয়ারই কথা।

দৃষ্টি তন্ময়: পিএইচডি রিসার্চ ফেলো, নর্থ ইস্টার্ন হিল ইউনিভার্সিটি, ভারত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *