সুবর্ণবাঙলা অনলাইন ডেস্ক
ফেরি রজনীগন্ধা। ছবি: সংগৃহীত
মেয়াদোত্তীর্ণ ফেরি দিয়ে চলছে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) গাড়ি ও মানুষ পারাপার। গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ফেরিঘাটের কাছে নোঙর করা ফেরি রজনীগন্ধাকে বাল্কহেড ধাক্কা দেওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মেয়াদোত্তীর্ণ ইউটিলিটি রজনীগন্ধা ফেরি দিয়েই চলেছে গাড়ি পারাপার। ২০১৪ সালে ফেরিটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় ফেরির তলা ফেটে পানি ওঠায় আস্তে আস্ত ডুবে যায় ফেরিটি। তবে এ কথা অস্বীকার করেছেন বিআইডব্লিউটিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম মিশা। তিনি বলেছেন, ফেরিটি মেয়াদোত্তীর্ণ নয়, নতুন তৈরি। উল্লেখ্য, বর্তমানে বিআইডব্লিউটিসির বহরে থাকা ৫৩টি ফেরির অনেকগুলোই ৪০ বছরের বেশি পুরাতন।
নৌ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ফেরিটির তলা ফেটে পানি উঠায় এক ঘণ্টা ধরে আস্তে আস্তে ডুবে যায়। আর দোষ চাপানো হচ্ছে বাল্কহেডের ওপর। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক রেহেনা আকতারসহ প্রশাসনের লোকজন। জেলা প্রশাসক জানান, ফেরিডুবির ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সানজিদা জেসমীনকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত শেষে ফেরি ডুবে যাওয়ার মূল কারণ জানা যাবে।
এ ছাড়া বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান মতিউর রহমান বলেন, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ফেরিডুবির ঘটনায় ২০ জন উদ্ধার হয়েছেন। এর মধ্যে চার জন সাঁতরে কূলে আসেন। ডুবে যাওয়া ফেরি থেকে মালবোঝাই একটি কাভার্ড ভ্যান উদ্ধার করা হয়েছে। তবে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। ফেরির চালক হুমায়ুন হোসেন নিখোঁজ রয়েছেন।
শিবালয় থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুর রউফ সরকার জানান, ডুবে যাওয়া ফেরি উদ্ধারে কাজ করছে ডুবুরি ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। এছাড়া রাজধানীর সিদ্দিক বাজার ফায়ার স্টেশন থেকে ডুবুরি ইউনিট ঘটনাস্থলে এসেছেন।
বিআইডব্লিউটিসি আরিচা ঘাট কার্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগের ব্যবস্থাপক মহিউদ্দিন রাসেল জানান, ডুবে যাওয়া ফেরিতে ৯ ট্রাক ছিল। ফেরিটি দৌলতদিয়া থেকে পাটুরিয়া আসার পথে ঘন কুয়াশার কারণে ঘাটের কাছে নোঙর করেছিল।
প্রত্যক্ষদর্শী মো. নাজমুল হোসেন বলেন, আমার গাড়িতে বস্তাভর্তি লোহা ছিল। এসব বস্তা নিয়ে কাঁচপুর একটি কারখানায় যাওয়ার কথা ছিল। রাত ১২টার দিকে ৯টি পণ্যবাহী যানবাহন নিয়ে দৌলতদিয়া ঘাট থেকে রজনীগন্ধা ফেরিটি পাটুরিয়ার দিকে রওনা দেয়। কিন্তু ঘন কুয়াশার পাটুরিয়া ঘাটে যাওয়ার আগেই ফেরিটি নোঙর করা হয়। সকাল ৮টার দিকে ফেরিটি পানিতে ডুবে যাওয়ার সময় নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটতে থাকি। পরে একটি ট্রলার এসে আমাকে উদ্ধার করে নদীর পাড়ে আনে।
এ ব্যাপারে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বাল্কহেডের ধাক্কায় রজনীগন্ধা নামে ইউটিলিটি ফেরি ডুবে যাওয়ার খবর আমি শুনেছি। ঐ ফেরিতে ৯টি ট্রাক ছিল। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে আমাকে জানানো হয়েছে, ফেরিটি ঘাট থেকে খুব কাছাকাছি নোঙর করা ছিল, বাল্কহেড সেটিকে ধাক্কা দিয়েছে। এখানে দুর্বলতা কিংবা অন্য কোনো ঘটনা আছে কি না, সেটি তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া ছাড়া বলা যাবে না।
নৌ-পুলিশকে যুগোপযোগী করতে হবে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, তারা ট্রলার নিয়ে এক জায়গায় যাচ্ছে তাদের নৌযান নেই। নৌ-পুলিশকে শক্তিশালী করতে হবে। তাদের অনেক ইক্যুইপমেন্ট যুক্ত করতে হবে যাতে তারা নৌ পথটাকে নিরাপদ করতে পারে।
বিআইডব্লিউটিসির নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ৫৩ ফেরির মধ্যে ৪৭টিরই সনদ নেই। বেশির ভাগই এসব ফেরির ৪০ বছরের বেশি পুরাতন। এছাড়াও ১৮টি রো রো ফেরির (বড় ফেরি) মধ্যে ১৪টিরই ফিটনেস সনদ নেই। এছাড়াও নেই বেশির ভাগ ফেরিতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি। অনেক ফেরির বয়স ৪০ বছর পার হয়ে গেছে। আইন অনুযায়ী ৪০ বছরের বেশি বয়সী নৌযানের ফিটনেস সনদ দেয় না বাংলাদেশ নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর। তার পরেও চলছে ফেরি সার্ভিস। ঘটছে দুর্ঘটনা।
২০২১ সালের ২৭ অক্টোবর পাটুরিয়া ঘাটে ডুবে যাওয়া ফেরি শাহ আমানতের মেরামতের তথ্য এবং ১৬ জানুয়ারি রজনীগন্ধা ডুবে যাওয়ার কারণ নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। বিআইডব্লিউটিসি জানায়, মাস চারেক আগে ফেরিটি সম্পূর্ণ মেরামত করা হয়েছিল। এতে ফেরির আয়ুষ্কাল বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ডকইয়ার্ড সূত্র জানায়, ভিন্ন কথা। তখন পুরো ফেরি নয়, শুধু এর প্রপেলারটি মেরামত করা হয়েছিল। অন্যদিকে, ভারসাম্যহীনভাবে যানবাহন তোলা বা ‘আনইভেন’ লোডিংয়ের কারণে ফেরি দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে বিআইডব্লিউটিসির প্রধান প্রকৌশলী ধারণা করলেও ফেরির মাস্টার এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।
দুই বছর আগে পদ্মা সেতুর পিলারে ধাক্কা দেয় ফেরি কাকলি। ঘটনায় দায়ী ফেরি কাকলি তৈরি করা হয় ১৯৭৪ সালে। এ ফেরিটির বয়স ৪৭ বছর ছিল। নেই ফিটনেস সনদ। এছাড়া ডাম্প ফেরি থোবাল ১৯৩৮ সালে, ফেরি রায়পুরা, রানীক্ষেত ও রানীগঞ্জ ১৯২৫ সালে তৈরি করা হয়। এগুলোও ফিটনেস ছাড়াই অবাধে চলাচল করছে। বহন করছে বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের সঙ্গে সাধারণ যাত্রী।
২০২১ সালের ২৭ অক্টোবর ঢাকা-মানিকগঞ্জ মহাসড়কে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে কাত হয়ে ডুবে যাওয়া আমানত শাহ বড় ফেরিটি ১৯৮০ সালে ডেনমার্ক থেকে আনা হয়। সে হিসেবে ফেরিটির বয়স হবে ৪০ বছর। অথচ ফেরিটির আয়ুষ্কাল ছিল ২৫ বছর। ২০০৫ সালে এর মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে ২০১০ সালে ফেরি মেরামত করে পুনর্বাসন করে আরও ১০ বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়। তাও ২০২০ সালে শেষ হয়ে গেছে বলে বিআইডব্লিউটিসির সূত্র জানায়।
বিআইডব্লিউটিসির অপর একটি সূত্র জানায়, বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ও দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটে চলাচলকারী বেশির ভাগ ফেরির ফিটনেস সনদের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৪ সালের ২৫ জুলাই। গত সাত বছর ধরে ফিটনেস সনদ ছাড়াই চলছিল এ ফেরিগুলো। শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌ-রুটে ফেরি সার্ভিস বন্ধ থাকায় বিআইডব্লিউটিসির ১৮টি রো রো ফেরি সবগুলো দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটে চলাচল করছিল। এসব ফেরির রয়েছে নানা কারিগরি ত্রুটি। অনেক ফেরিতে ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল স্টিয়ারিংয়ের ব্যবস্থা থাকলেও দুর্ঘটনার সময় মেকানিক্যাল স্টিয়ারিং অকার্যকর। বেশির ভাগ ফেরি ১৯৮০ সালে তৈরি করা হয়েছে।
ফেরি শাহ মখদুম ১৯৮৫ সালে তৈরি করা হয়। ঐ হিসেবে ফেরির বয়স ৩৬ বছর। ওই ফেরির ৫০০ হর্সপাওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি ইঞ্জিন ও ঘণ্টায় প্রায় ১৯ কিলোমিটার বেগে চলার কথা। রো রো ফেরি শাহজালাল তৈরি করা হয়েছে ১৯৮০ সালে। এ ফেরিতে ৫০০ হর্সপাওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি ইঞ্জিন ও ঘণ্টায় প্রায় ১৯ কিলোমিটার গতিতে চলার কথা। রো রো ফেরি ও বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর ফেরির একই সমান শক্তিসম্পন্ন দুটি ইঞ্জিন রয়েছে। এটির গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় ১৯ কিলোমিটার। এছাড়া ডাম্প ফেরি থোবাল ১৯৩৮ সালে, ফেরি রায়পুরা, রানীক্ষেত ও রানীগঞ্জ ১৯২৫ সালে তৈরি করা হয়। এগুলোরও ফিটনেস সনদ নেই।