এবার ডিগবাজি মারলেন পাকিস্তানের সেই নির্বাচন কমিশনার

আন্তর্জাতিক

সুবর্ণবাঙলা ডেস্ক

গত ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে নির্বাচনের পর থেকেই একের পর এক দৃশ্যের অবতারণা হচ্ছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল পিটিআইসহ আরও কয়েকটি দল নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তুলে।

এমন পরিস্থিতির মধ্যেই রাওয়ালপিন্ডি ডিভিশনের নির্বাচন কমিশনার লিয়াকত আলী চাতা রীতিমতো সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনে কারচুপির কথা প্রকাশ করেন তিনি। সেই সঙ্গে নিজের দায়ও স্বীকার করে নেন এ কর্মকর্তা।এরপরই তিনি তার পদ থেকে সরে দাঁড়ান।

তবে হঠাৎ করে আবার ডিগবাজি মেরে নির্বাচনে কারচুপি সংক্রান্ত সব অভিযোগ প্রত্যাহার করেছেন সাবেক এই কর্মকর্তা।

লিয়াকত আলী চাতা বলেছেন, এই ঘটনায় তিনি অত্যন্ত লজ্জিত এবং বিব্রত। একই সঙ্গে কারান্তরীণ সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করে তিনি নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ তুলে পদত্যাগ করেছিলেন বলে দাবি করেছেন।

বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের (ইসিপি) কাছে দেওয়া এক বিবৃতিতে চাতা বলেছেন, ‘আমি আমার কর্মকাণ্ডের সম্পূর্ণ দায় নিচ্ছি এবং আমার বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে নিজেকে সমর্পণ করছি।’

এর আগে, গত শনিবার রাওয়ালপিন্ডির এই নির্বাচন কমিশনার ভোটে জালিয়াতি হয়েছে বলে স্বীকার করে নাটকীয়ভাবে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। ওই দিন তিনি বলেছিলেন, রাওয়ালপিন্ডিতে বড় ধরনের নির্বাচনী কারচুপির ঘটনায় বিবেকের তাড়না থেকে তিনি পদত্যাগ করছেন। তার এই ঘোষণা দেশটিতে রাজনৈতিক পারদ ব্যাপক বাড়িয়ে তুলেছে।

সংবাদ সম্মেলনে বিরল স্বীকারোক্তি দিয়ে নির্বাচন কমিশনার চাথার রাওয়ালপিন্ডি বিভাগে নির্বাচনে কারচুপির দায়ভার গ্রহণ করেন। তিনি বলেছিলেন, আমরা ৫০ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত প্রার্থীদের বিজয়ীতে রূপান্তরিত করেছি।

তার এমন স্বীকারোক্তির পর পিটিআই, জামায়াত-ই-ইসলামি (জেআই) ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল— যাদের বেশিরভাগই ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করেছে— তারা এই ঘটনায় তদন্ত দাবি করে। নির্বাচনে কারচুপির প্রতিবাদে দেশটিতে বিক্ষোভ কর্মসূচিও পালন করছে এসব দল।

একই সংবাদ সম্মেলনে চাথা পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি কাজী ফয়েজ ইসা নির্বাচনে কারচুপির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছিলেন। অভিযোগের জবাবে দেশটির প্রধান বিচারপতি সাবেক এই কমিশনারকে তার বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগের সমর্থনে প্রমাণ দেখানোর দাবি জানান।

তবে নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে বলে যে অভিযোগ করেছিলেন, তা প্রত্যাহার করে চাথা বলেছেন, ‘এ সবই ইমরান খানের প্রতিষ্ঠিত পিটিআইয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে করা হয়েছিল। পিটিআইয়ের নেতারা ভবিষ্যতে আমাকে লোভনীয় পদ দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।’

বিবৃতিতে চাথা বলেছেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর পিটিআই যখন পাঞ্জাবে সরকার গঠন করে, তখন তিনি পাঞ্জাবের প্রাদেশিক সচিবসহ অন্যান্য জ্যেষ্ঠ পদে ছিলেন। সচিব পদটি প্রাদেশিক সরকারের শীর্ষ পদগুলোর একটি। প্রাদেশিক সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় আমি পিটিআইয়ের জ্যেষ্ঠ এবং বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছিলাম।

তিনি বলেন, পিটিআই ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনি পিটিআইয়ের প্রখ্যাত নেতাদের একজনের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। চাতা বলেন, গত বছরের ৯ মের ঘটনার পর পিটিআইয়ের অন্যান্য নেতাদের মতো ওই নেতাও পলাতক ছিলেন, তাকে পলাতক অপরাধী (পিও) হিসেবে ঘোষণাও দেওয়া হয়েছিল।

‘আর পুরো সময়জুড়ে তার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছিল আমার। আমি তাকে বিভিন্ন বিষয়ে সতর্কতার সঙ্গে সাহায্য করেছি। ফল হিসেবে পিটিআইয়ের বিশিষ্ট ওই নেতার সঙ্গে আমার সম্পর্ক উচ্চ-স্তরের বিশ্বাসের ভিত্তিতে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে।’

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের তিনদিন পর পিটিআইয়ের ওই নেতার সাথে সাক্ষাতের জন্য গোপনে লাহোর ভ্রমণ করেছিলেন তিনি। ‘এই বৈঠকেই তিনি আমাকে একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে, আমি যদি পিটিআইয়ের নির্বাচনে কারচুপির এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে কাঠগড়ায় তোলার অভিযোগের প্রতি সমর্থন জানাই, তাহলে তিনি ভবিষ্যতে আমার জন্য লোভনীয় পদ নিশ্চিত করবেন।’

চাতা বলেন, ‘পিটিআই নেতা তাকে বলেছিলেন, পুরো পরিকল্পনাটি দলের জ্যেষ্ঠ নেতৃত্বের পরামর্শ এবং অনুমতিতে সাজানো হয়েছে। আমি চাকরি থেকে অবসর নিতে যাচ্ছি এই বিষয়টি বিবেচনা করে উল্লিখিত ব্যক্তি প্রস্তাবটি দিয়েছিলেন। আমার অবসর ঘিরে যে চাপের মধ্যে ছিলাম সে বিষয়েও তিনি অবগত ছিলেন।’

‘পিটিআইয়ের ওই নেতা আমাকে প্রধান বিচারপতির নাম বিশেষভাবে বলতে বলেছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, পিটিআইয়ের শীর্ষ নেতৃত্ব তাকে বিশেষভাবে এটা করতে বলেছে। প্রধান বিচারপতির নামে অভিযোগ তোলার পেছনে নানাবিধ উদ্দেশ্য ছিল।’

তিনি বলেন, একইভাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) সিকান্দার সুলতান রাজাকেও পুরো পাকিস্তানজুড়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলার লক্ষ্যে অভিযুক্ত করা হয়েছে। চাতা বলেন, তিনি ১৭ ফেব্রুয়ারি সংবাদমাধ্যমে কথা বলেছিলেন। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ওই দিন কারচুপির বিরুদ্ধে দেশজুড়ে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছিল পিটিআই।

‘শেষ পর্যন্ত, সংবাদ সম্মেলনে সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট, রাষ্ট্রবিরোধী এবং বিদ্বেষপূর্ণ বিবৃতি দেওয়ার জন্য আমি অত্যন্ত লজ্জিত ও বিব্রত বোধ করছি। এই কর্মকাণ্ড আমার পাশাপাশি পুরো প্রশাসনের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে,’ যোগ করেন তিনি।

গত ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে পিএমএল-এন ৭৯টি আসন নিয়ে জাতীয় পরিষদের বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আর পিপিপি পেয়েছে ৫৪টি আসন। অন্য আরও চারটি দলকে সঙ্গে নিয়ে ৩৩৬ আসনের জাতীয় পরিষদে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করেছে পিএমএল-এন ও পিপিপি। যদিও নির্বাচনে সর্বোচ্চ ৯২টি আসনে জয় পেয়েছে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *