হামাস-ফাতাহর ঐক্য: ইসরাইলের কপালে চিন্তার রেখা!

আন্তর্জাতিক

সুবর্ণবাঙলা অনলাইন ডেস্ক


ছবি: সংগৃহীত

আগামী বৃহস্পতিবার ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি আগ্রাসনের পাঁচ মাস পূর্ণ হবে। এই সময়ের মধ্যে ৩০ হাজারের বেশি নিরপরাধ ফিলিস্তিনির প্রাণ গেছে। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রীই জানিয়েছেন, এর মধ্যে ২৫ হাজারের বেশি নারী ও শিশু।

এই রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরপরই ইসরাইলি বাহিনী গাজায় সন্তানের ক্ষুধা মেটাতে ত্রাণের অপেক্ষায় থাকা সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ১১২ জনকে হত্যা করে। কিন্তু গুলির ঘটনা বেমালুম চেপে যায় ইসরাইল। দেশটি অন্য জায়গার ভিডিও সম্পাদন করে মিথ্যা তথ্য প্রচার করে। সেনাবাহিনী বলে, গাজাবাসী খাবার নিতে হুড়োহুড়ি করতে গিয়েই পদপিষ্ট হয়ে মারা গেছে। যদিও বিবিসি ভেরিফাই সেই তথ্য ভুল প্রমাণিত করেছে।

ইসরাইলের মিথ্যা দাবির মধ্যেই ফিলিস্তিনবাসীর জন্য হয়তো একটা সুখবর এসেছে। মস্কোতে একটি বৈঠকে কয়েক দশক ধরে শত্রুতার সম্পর্ক রাখা হামাস এবং ফাতাহ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তাদের সঙ্গে অন্যান্য ইসলামি গোষ্ঠীও একসঙ্গে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের ডাক দিয়েছে। এমন ঘোষণায় হয়তো ইসরাইল এবং তার মিত্রদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়তে পারে। তবে হামাস-ফাতাহর ঐক্য বাস্তবায়িত হলে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্নের বাস্তবায়ন অনেকদূর এগিয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

হঠাৎ বিরল ঐক্যের ঘোষণা

নিজেদের মধ্যে বৈরিতা ভুলে গিয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে এক হওয়ার ঘোষণা দিল ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ গোষ্ঠী হামাস ও ফাতাহ। চলমান যুদ্ধে কীভাবে ইসরাইলকে মোকাবিলা করা যায় এবং যুদ্ধের পরে কর্মপরিকল্পনা কী হবে, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয় মস্কোতে। শুক্রবার মস্কো থেকে এক বার্তায় ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলো জানায়, প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) অধীনে আবারও একই ব্যানারের নিচে আসছে সবাই। সবগুলো পক্ষই এবার ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে একমত প্রকাশ করেছে। যদিও হামাস ও ইসলামিক জিহাদকে সন্ত্রাসী বাহিনী হিসেবে ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র পশ্চিমা দেশগুলো। তবে পিএলওর সরকারকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয় তারা।

এর আগেও হামাস ও পিএলও-কে একসঙ্গে আনার নানা চেষ্টা ব্যাহত হয়েছে। তবে সর্বশেষ রাশিয়ার উদ্যোগে এই চেষ্টা সফল হলো। গত বছরের ৩০ জুলাই উদ্যোগ সফল করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফাতাহ ও হামাসসহ ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের সবগুলো পক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে রাশিয়া। ইসরাইলের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক এখন তলানিতে।

গাজা উপত্যকায় দখলদার ইসরাইলি বাহিনীর বিরুদ্ধে অনেকটা একাই লড়াই চালিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। কিন্তু নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর মধ্যপ্রাচ্যের কসাই হিসেবে পরিচিত বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর লেলিয়ে দেওয়া ইসরাইলি সেনাদের নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ আর মেনে নিতে পারছে না ফাতাহ। নিজেদের মধ্যে দা-কুমড়া সম্পর্ক ভুলে গিয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে এক হওয়ার ঘোষণা দিল। এর আগে ইসরাইলি বাহিনীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিজেদের মধ্যকার যাবতীয় বিভেদ ভুলে সব ফিলিস্তিনিকে এক হওয়ার আহ্বান জানান রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ।

হামাস-ফাতাহর বৈরিতা

ফিলিস্তিনের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই দ্বন্দ্ব চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল ২০০৭ সালের জুন মাসে। সে সময় গাজা উপত্যকায় হামাস এবং ফাতাহর লড়াইয়ে বহু মানুষ হতাহত হয়েছিল। এই সশস্ত্র সংঘাত, ‘গাজার যুদ্ধ’ নামেও পরিচিত। এই লড়াই দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে এত গভীর বৈরিতা সৃষ্টি করেছিল যে, সেই সংঘাতের চিহ্ন আজও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ফাতাহ হেরে যাওয়ার পর এবং হামাস যোদ্ধারা গাজার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর এই সহিংসতা শুরু হয়। ঐ সংঘাতের ফলে ফিলিস্তিনের যৌথ সরকারের বিলুপ্তি ঘটে এবং ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে শাসনভার ভাগ হয়ে যায়। ফিলিস্তিনের দুই অংশ-পশ্চিম তীর ফাতাহ আর গাজা হামাসের শাসনে চলে যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক অধ্যাপক নাথান ব্রাউন বিবিসি মুন্ডোকে বলেছেন, ‘হামাস এবং ফাতাহ’র মধ্যে ২০০৭ সালের সংঘাতে প্রচুর রক্তপাত হয়েছিল, তারপর থেকে তাদের মধ্যে তিক্ততা আরো তীব্র হয়। সেই মুহূর্ত থেকে, ফিলিস্তিনি অঞ্চল এবং তাদের নেতারা ভিন্ন ভিন্ন পথ অনুসরণ করে।’ তবে তারও অনেক আগে থেকেই দুই পক্ষের মধ্যে কোন্দল চলছিল বলে তিনি জানান।

ব্যাপক চাপে ইসরাইল

প্রায় পাঁচ মাস ধরে ইসরাইল নৃশংসভাবে ফিলিস্তিনের ৩০ হাজারের বেশি নাগরিককে হত্যা করেছে। গত বছর একটি হাসপাতালে এবং গত সপ্তাহে একটি ত্রাণকেন্দ্রে হামলা চালিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে ইসরাইল। যদিও তারা কোনোটিই স্বীকার করেনি। এরপর ইসরাইলের মিত্র দেশগুলোও সমালোচনা শুরু করেছে। কেবল যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে বারবার ইসরাইলের পক্ষে ভোট দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স ও ব্রিটেনসহ বাকি দেশগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনের পক্ষে ভোট দিচ্ছে।

মিত্ররা ধীরে ধীরে সরে যাওয়ায় চাপে পড়েছে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সরকার। এছাড়া দেশটির অভ্যন্তরেও প্রতিদিনই জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার দাবিতে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হচ্ছে। অথচ নেতানিয়াহু কট্টরপন্থিদের সমর্থন করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের দাবিকে অস্বীকার করে আসছেন। পার্লামেন্টেও তার এ সংক্রান্ত প্রস্তাবটি পাশ হয়েছে। ইসরাইল নিজের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও আত্মরক্ষার অধিকারের কথা বললেও ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা দিতে নারাজ। অথচ ফিলিস্তিন ভূখণ্ডেই ইসরাইলের জন্ম। ইসরাইল বিভিন্ন দেশে অস্ত্র ও প্রযুক্তি পণ্য রপ্তানি করে বেশির ভাগ অর্থ আয় করে। কিন্তু ১২ দেশের দুই শতাধিক এমপি ইসরাইলের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এর আগে বৃহস্পতিবার কলম্বিয়া অস্ত্র আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, হামাস এবং ফাতাহর মধ্যে ঐক্যের ঘোষণার বাস্তবায়ন হলে নেতানিয়াহুর ‘গ্রেটার ইসরাইল’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা গড়ার স্বপ্ন ভেস্তে যাবে। উলটো স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে হবে। যদিও হামাস এবং ফাতাহর মধ্যে এর আগেও কয়েক বার ঐক্যের চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। আর এটাই ফিলিস্তিনবাসীর দুঃখ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *