মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকেন্দ্রের কৃষ্ণগহ্বরের নতুন ছবিতে জানা গেল অজানা তথ্য

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

সুবর্ণবাঙলা অনলাইন ডেস্ক

মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকেন্দ্রের কৃষ্ণগহ্বর স্যাজিটারিয়াস এ*-এর নতুন ছবি।

ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ (ইএইচটি) দিয়ে তোলা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকেন্দ্রের কৃষ্ণগহ্বরের নতুন ছবি প্রকাশ হয়েছে। প্রচণ্ড ভারী এই কৃষ্ণগহ্বরের নাম স্যাজিটারিয়াস এ*। সম্প্রতি প্রকাশিত ছবিতে পোলারাইজড লাইট বা সমবর্তিত আলোয় কৃষ্ণগহ্বরটির চৌম্বকক্ষেত্র দেখা যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট গবেষণাপত্রটি প্রকাশ হয়েছে ২৭ মার্চ, অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল লেটারস-এ।

এর আগে ২০১৭ সালে একই টেলিস্কোপ দিয়ে কৃষ্ণগহ্বরের প্রথম ছবি তোলা হয়েছিল। সেটা ছিল এম৮৭ গ্যালাক্সির কেন্দ্রের অতি ভারী কৃষ্ণগহ্বর। এই ছবি প্রথম উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় ২০১৯ সালে। ওই টেলিস্কোপ দিয়েই তোলা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের অতি ভারী কৃষ্ণগহ্বর স্যাজিটারিয়াস এ*-এর ছবি প্রথমবারের মতো প্রকাশ হয় ২০২২ সালের ১২ মে।


২০১৭ সালে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপের তোলা অতি ভারী কৃষ্ণগহ্বর এম৮৭* এর প্রথম ছবি।

এবার টেলিস্কোপটি দিয়ে তোলা নতুন ছবিতে চৌম্বকক্ষেত্রটি দেখা গিয়েছে যা বিজ্ঞানীদের কাছে অবাক করা বিষয়। কারণ, এম৮৭* (এম৮৭ গ্যালাক্সির কেন্দ্রের অতি ভারী কৃষ্ণগহ্বর) স্যাজিটারিয়াস এ* থেকে অনেক ভারী। স্যাজিটারিয়াস এ* সূর্যের চেয়ে মাত্র ৪.৩ মিলিয়ন গুণ ভারী, আর এম৮৭*-এর ভর প্রায় ৬.৫ বিলিয়ন সূর্যের সমান!

নতুন ছবিটিতে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে স্যাজিটারিয়াস এ*-এর চারপাশের চৌম্বকক্ষেত্র। চৌম্বকক্ষেত্রের গঠনের মানচিত্র তৈরি করার জন্য কৃষ্ণগহ্বরটির চারপাশের প্রচণ্ড উত্তপ্ত অঞ্চলে যেসব পদার্থ আছে, তা থেকে বিকিরিত আলোর পোলারাইজেশন পরিমাপ করা হয়েছে। পোলারাইজেশনকে বাংলায় পোলারায়নও বলা হয়। তবে এর খাঁটি বাংলা সমবর্তন। বহুতলে স্পন্দনশীল কোনো তরঙ্গকে একটি তলে স্পন্দনশীল করাকেই বলে সমবর্তন।

এই অঞ্চলটির চৌম্বক ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য বুঝতে পারলে কৃষ্ণগহ্বর থেকে বিকিরিত তেজস্ক্রিয়তা ও পদার্থ কী পরিমাণ শক্তিশালী হতে পারে, সে ব্যাপারে একটা সাধারণ ধারণা পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।

বাঁয়ে এম৮৭ ও ডানে স্যাজিটারিয়াস এ*

নাসা হাবল ফেলোশিপ প্রকল্পের আইনস্টাইন ফেলো ও গবেষণার সহদলনেতা সারা আইসাওনের মতে, নতুন এই ছবি থেকে জানা গেছে মিল্কিওয়ের কেন্দ্রের কৃষ্ণগহ্বর স্যাজিটারিয়াস এ*-এর একদম কাছেই রয়েছে শক্তিশালী, পাকানো ও সুবিন্যস্ত চৌম্বকক্ষেত্র। দীর্ঘকাল ধরেই আমরা মনে করি, কৃষ্ণগহ্বর কীভাবে চারপাশের পদার্থ গিলে নেয় ও জেট নির্গত করে, তাতে এই চৌম্বকক্ষেত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।’

সাধারণত অতি ভারী কৃষ্ণগহ্বর তার আশপাশের অঞ্চল থেকে অনেকটা পদার্থ গিলে নেয়। আবার কিছু পদার্থ ও বিকিরণ বেরিয়ে আসে প্রচণ্ডভাবে, ফোয়ারার মতো। ইংরেজিতে যাকে বলে জেট (প্রচণ্ড বেগে ফোয়ারার মতো বেরিয়ে আসা পদার্থ ও বিকিরণ)। এই জেট কীভাবে তৈরি হয়, সে ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত নন বিজ্ঞানীরা। প্রশ্ন হলো, স্যাজিটারিয়াস এ*-এর কি এ ধরনের জেট রয়েছে?

বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, স্যাজিটারিয়াস এ*-এর চৌম্বকক্ষেত্র অনেকটাই এম৮৭*-এর মতো। সে হিসেবে তারা ধারণা করছেন, স্যাজিটারিয়াস এ*-এরও এ ধরনের জেট থাকার কথা। এ বিষয়টি এতদিন অজানা ছিল। নতুন এ ছবির ভিত্তিতে এটি বিজ্ঞানীদের সম্পূর্ণ নতুন ধারণা।

সারা আইসাওন বলছেন, ‘আমরা এ ধরনের শক্তিশালী ও সুবিন্যস্ত চুম্বকক্ষেত্রের সঙ্গে জেট নিঃসরণের সরাসরি সম্পর্ক আছে বলে মনে করি। এমনটাই আমরা দেখেছি এম৮৭*-এর ক্ষেত্রে। তবে স্যাজিটারিয়াস এ*-এর এরকম কোনো জেট এখনো দেখা যায়নি। তবে একই ধরনের জ্যামিতিক গঠন ও চৌম্বকক্ষেত্র দেখে আমাদের ধারণা, সম্ভবত আমাদের গ্যালাক্সিকেন্দ্রের কৃষ্ণগহ্বরটিরও এরকম জেট আছে, যেটা এতদিন লুকিয়ে ছিল আমাদের দৃষ্টিসীমার আড়ালে। এই জেট আসলেই থেকে থাকলে বিষয়টা হবে দারুণ রোমাঞ্চকর!’

২০২২ সালে প্রকাশিত স্যাজিটারিয়াস এ*-এর ছবি

তবে স্যাজিটারিয়াস এ*-এর জেট যে থাকতে পারে, এটা দেখে অবশ্য বিজ্ঞানীরা খুব একটা অবাক হননি। এম৮৭*-এর চারপাশে প্রচুর গ্যাস ও ধুলো। প্রতিবছর এটি দুই থেকে তিনটি সূর্যের সমপরিমাণ পদার্থ গিলে নেয়। তার মানে, এর চৌম্বকক্ষেত্র যথেষ্ট পরিমাণ পদার্থ মেরুর দিকে জড়ো করতে পারে, যা জেট হিসেবে নির্গত হয়।

সে হিসেবে স্যাজিটারিয়াস এ*-এর পদার্থ গিলে নেওয়ার হার এত কম যে বিজ্ঞান সংবাদমাধ্যম স্পেস ডটকম একে তুলনা করেছে একজন মানুষের প্রতি ১০ লাখ বছরে এক দানা চাল খাওয়ার সঙ্গে। কাজেই এরকম ‘ডায়েট’-এ থাকা কোনো কৃষ্ণগহ্বরের জেট যে অতটা দৃশ্যমান হবে না, এটুকু তো স্পষ্টই।

পরবর্তী লক্ষ্য হলো, এই পুরো সিস্টেমটা কীভাবে নড়াচড়া করে, কীভাবে জেট নির্গত করে, তা বের করার চেষ্টা করা। এর মাধ্যমে এই কৃষ্ণগহ্বর তো বটেই, আমাদের গ্যালাক্সি ও এতে কীভাবে নক্ষত্রের জন্ম হলো, সে সব বিষয়ে আরও ভালোভাবে জানা যাবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।

ছবি ও তথ্যসূত্র: স্পেস ডট কম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *