সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নে নিরলস কাজ করছে

অন্যান্য জাতীয়

পিআইবি ফিচার

বিনয় দত্ত

ময়মনসিংহ জেলার, মুক্তাগাছা উপজেলার ঈশ্বরগ্রামের কামিনী ঘোষ। বর্তমানে তিনি বিধবা। নিঃসন্তান। অথচ বছর-সাতেক আগেও তার সংসার ছিল। আশা ছিল। আ¯’া ছিল। ছিল আনন্দ। সেই আনন্দে চির ধরে যখন লোভী বাস কেড়ে নেয় তার স্বামী সরোজ ঘোষের প্রাণ।
স্বামীর মৃত্যু তাকে পথে বসিয়ে দেয়। কারণ, সরোজ ঘোষ ছিলেন পরিবারের উপার্জনক্ষম। সেই উপার্জন থমকে যায়। কামিনী ঘোষের ভিটে বাড়ি ছাড়া আর কোনো সম্বল নেই। প্রথম কয়েক মাসে আত্মীয়স্বজন এগিয়ে এলেও তারাও পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে টিকতে পারেন না। তাদের আয়ও যে স্বল্প।
একসময় কামিনী ঘোষ জানতে পারেন সরকার বিধবাদের ভাতা দেয়। বিভিন্ন অজুহাতে তারা সময়ক্ষেপণ করেন। পরে তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা ধরেন। তাকে নিজের সম্পর্কে জানান এবং নাম যুক্ত করার অনুরোধ করেন। সেই অনুরোধে কাজ হয়।
কামিনী ঘোষ জানান, ‘বাবারে কত যে কষ্ট করছি, কেউ খবর রাহে না রে বাপ, কেউ খবর রাহে না। আত্মীয়স্বজন যারা আছিল তাগোর তো আয়-রোজগার কম, তারা আর কদিন খবর রাখব। কামের লাইগা এর ধারে গেছি, ওর ধারে গেছি কেউ কাম দেয় না। পরে শুনলাম সরকার বিধবাগো ভাতা দেয়, গেলাম ছুইটা। পরে এক স্যারেরে ধরছি। নামডা তুলছি দেইহা অহন কিছু ট্যাকা পাই। হেই ট্যাকা দিয়া তো দিন চলে না। তয় যা পাই, তাইবা কে দেয় আমাগো।’
বিধবা ভাতার টাকা দিয়ে চলতে হিমশিম খেলেও তখন তিনি এক আত্মীয়ের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নেন। সেই ধারের টাকা দিয়ে পিঠার দোকান সাজিয়ে বসেন। দোকান বলতে কি সেই কাঠামো আছে? রাস্তায় কোনোরকম নিজের সরঞ্জাম নিয়ে বসেন। এভাবে দিন চলতে চলতে এখন তার আর্থিক কষ্ট দূর হয়েছে। খাবারের জন্য তীব্র কষ্ট করতে হয় না। স্বাভাবিকভাবেই চলতে পারেন।
এই স্বাভাবিক পরি¯ি’তি জারি রাখার ব্যাপারে সরকারের আন্তরিকতার কোনো কমতি নেই, এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। তাই ২০২২-২৩ অর্থবছরের চেয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ ১১ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে তা আরও বৃদ্ধি করা হয়েছে।
২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে এই বাজেট বরাদ্দের পর বর্তমানে ১১৫টি প্রকল্প চলমান। এ ১১৫টি চলমান প্রকল্প অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সহযোগিতায় কাজ করে যা”েছ। বরাদ্দ বাড়ানোর মূল কারণ হলো সহযোগিতার পরিধি যাতে আরও বিস্তৃত হয় এবং সহযোগিতার পরিমাণ যেন আরও বাড়ানো যায়।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অন্তর্ভুক্তিমূলক করার জন্য সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। একমাত্র এই খাতের উপকারভোগীরা হলেন সরাসরি সমাজের অসহায় এবং নিম্নশ্রেণি পেশার মানুষ।
করোনা সংকট কাটিয়ে মানুষের জীবন-জীবিকা এগিয়ে নিতে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেটে স্বা¯’্য, বিনিয়োগ, উৎপাদন, কর্মসং¯’ান, মানবসম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। করোনাকালীন সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম কিছুটা বাধাগ্রস্ত হলেও শক্তিশালী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ আবার আগের ধারায় ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছে।
সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় রয়েছেন মোট দাবিদারের ২৫ শতাংশ মানুষ। তাদের মধ্যে অসহায়, নির্যাতিত, তালাকপ্রাপ্ত, দু¯’ ও গর্ভবতী মায়েদের সহায়তা, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, হিজড়া, বেদে এবং অনগ্রসর মানুষসহ বিভিন্ন খাতসংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর সহযোগিতার লক্ষ্যে এ বরাদ্দ বাড়ানো হয়; যাতে তারা স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে।
সামাজিক নিরাপত্তার উদ্দেশ্য হ”েছ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক ও সামাজিক দুর্যোগের কারণে মানুষের মধ্যে সংঘটিত অনাকাক্সিক্ষত অব¯’া মোকাবিলা, বিভিন্ন আইনি সহায়তা, অসু¯’তা, বেকারত্ব, শিল্প দুর্ঘটনা প্রভৃতি ক্ষেত্রেও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় সহায়তা করা।
অনগ্রসর মানুষের প্রতি সরকার কতটা আন্তরিক, এর নমুনা পাওয়া যায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বরাদ্দগুলো কোন কোন খাতে বাড়ানো হয়েছে তা দেখে:
১. ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা এক লাখ বৃদ্ধির পাশাপাশি ভাতার হার ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ৬০০ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে।
২. প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রীদের মাসিক শিক্ষা উপবৃত্তির হার বাড়িয়ে প্রাথমিক স্তরে ৭৫০ থেকে ৯০০ টাকা করা হয়েছে। মাধ্যমিক স্তরে ৮০০ থেকে ৯৫০ এবং উ”চমাধ্যমিক স্তরে ৯০০ থেকে বাড়িয়ে ৯৫০ টাকা করা হয়েছে।
৩. সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমকে লক্ষ্যভিত্তিক, স্ব”ছ ও জবাবদিহিমূলক করার জন্য জিটুপি পদ্ধতির আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। মোট ২৫টি ক্যাশভিত্তিক কর্মসূচির মধ্যে ২২টি কর্মসূচির অর্থ উপকারভোগীদের ব্যাংক/মোবাইলে পাঠানো হ”েছ।
৪. ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষা খাতে চলতি বাজেটের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ১ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা মোট বাজেটের ১৬.৫৮ শতাংশ এবং জিডিপির ২.৫২ শতাংশ।
এমনকি করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পসহ বিভিন্ন খাতের জন্য সুদ বাবদ ভরতুকি হিসাবে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। মহামারির কারণে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক ও ফুটওয়্যার শিল্পে কর্মহীন হয়ে পড়া শ্রমিকদের সহায়তায় ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
এই বর্ধিত বরাদ্দ কতখানি মন্ত্রণালয় খরচ করতে পেরেছে, কতটা অসহায়-সুবিধাবি ত মানুষের সাহায্যার্থে কাজে লাগাতে পেরেছে, তাই বিবেচনা রাখে। সেই বিবেচনায় আশা করছি মন্ত্রণালয় আন্তরিক থাকবে।
এবার যে বিষয়ে গুরুত্ব দিতে চাই তা হলো, সরকার সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অনেক আগ্রহী হলেও কর্মক্ষেত্রে বা সরেজমিনে এর প্রতিফলন মেলে কম। অর্থাৎ সরকার সামাজিক নিরাপত্তা খাতসংশ্লিষ্ট অনেক মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করতে চাইলেও যারা মাঠপর্যায়ে আছেন বা যারা তা বাস্তবায়ন করছেন, তাদের আগ্রহের ঘাটতি নজরে পড়ে। সেই ঘাটতি বিবেচনায় কিছু পর্যালোচনা উল্লেখ করা হলো:
১. সামাজিক নিরাপত্তা খাতের উন্নয়ন প্রকল্প মাঝপথে থেমে যাওয়া।
২. বরাদ্দকৃত বাজেট সময়মতো ছাড় না পাওয়া।
৩. প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা।
৪. ক্রমাগত দীর্ঘসূত্রতার কারণে বাজেট ঘাটতি।
৫. প্রকল্প বাস্তবায়নে কৃত্রিম বাধা তৈরি।
৬. দুর্নীতির জাল পাতা।
৭. ভাতা তুলতে ঘুস দিতে বাধ্য করা।
৮. যোগ্য সুবিধাভোগীদের হাতে বরাদ্দ না পৌঁছানো।
এসব বিষয় মাথায় রেখে সরকার নতুন কর্মপরিকল্পনা সাজাতে পারে। এতে সুবিধাবি ত মানুষ সঠিকভাবে সেবা যেমন পাবেন, তেমনই সরকারের আগ্রহের বিষয়টি টের পাওয়া যাবে। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা খাত যে গুরুত্বপূর্ণ খাত, সেই সম্পর্কে সঠিক ধারণা
পাওয়া যাবে। পিআইবি ফিচার

লেখক: কথাসাহিতিক ও সাংবাদিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *