ছেলেমেয়ে মস্ত বড় অফিসার, বৃদ্ধাশ্রমে বাবার নিঃসঙ্গ জীবন

জাতীয় শহর

আবুল খায়ের

ঈদে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা। পিতা-মাতা, ভাইবোনদের মধ্যে চলে আনন্দ। মোটকথা, স্বজনদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বইয়ে যায়। এটাই যেন স্বাভাবিক দৃশ্য ঈদের। কিন্তু ঈদের দিনের এই স্বাভাবিক চিত্র নেই বৃদ্ধাশ্রমে। সেখানে দৃশ্য ভিন্ন। আপনজনহীন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের দিন কাটে কেঁদেকেটে আর আক্ষেপে।

অথচ এই পিতা-মাতাই নিজে না খেয়ে, আরাম-আয়েশে না থেকে ছেলেমেয়েদের বানিয়েছেন সুশিক্ষিত। কেউ উচ্চ সরকারি কর্মকর্তা, কেউ ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার… কেউ ব্যবসায়ী আবার কেউ বিত্তশালী। এত সব আপনজন থাকতেও জীবনের অন্তিম সময়ে বৃদ্ধাশ্রমে কাটছে তাদের নিঃসঙ্গ জীবন। ঈদের দিনে ইত্তেফাকের এই প্রতিনিধি গাজীপুর, হোতাপাড়া, বিশিয়া কুড়িবাড়ী বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে যান। সেখানে ৮০ জন পুরুষ ও ৭৫ জন নারী বৃদ্ধা রয়েছেন।

তাদের অধিকাংশের সঙ্গে ঈদের দিনের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে এই প্রতিনিধি খোলামেলা আলোচনা করেন। কিন্তু তারা কিছুক্ষণ কোনো কথা না বলে অঝোরে কান্না করতে থাকেন।

পুরো কেন্দ্রে শোকের ছায়া নেমে আসে। তাদের অনেকে সংসার চালাতে গিয়ে এবং সন্তানকে মানুষ করতে গিয়ে জীবনে যে সংগ্রাম করেছেন, তা তুলে ধরেছেন। অথচ সেই সন্তানেরা তাদের কাউকে কাউকে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। অনেকে খোঁজ-খবরও নেন না। অনেকের সন্তান দেশে-বিদেশে বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন। এই বৃদ্ধাদের কপালে সন্তানদের সঙ্গে থেকে যে সুখ, তা সয়নি। তারা এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। এই বৃদ্ধাশ্রমে অবস্থান করা ১৫৫ জনের জীবনের কাহিনি একই রকম।

বিশিষ্ট ব্যবসায়ী খতিব আব্দুল জাহিদ মকুলের প্রতিষ্ঠিত বিশাল এলাকা জুড়ে সবুজ ছায়াবেষ্টিত এই বৃদ্ধাশ্রম। সেখানে সব ধর্মের বৃদ্ধ নারী-পুরুষেরা থাকছেন। ২৪ ঘণ্টা চিকিত্সাসেবার ব্যবস্থা রয়েছে। থাকা-খাওয়া সব ফ্রি। মারা যাওয়ার পর যার যার ধর্ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। নোবেল বিজয়ী মাদার তেরেসা এই পুনর্বাসন কেন্দ্র পরিদর্শন করে গেছেন। সেখানে তার হাতে রোপণ করা একটি গাছও রয়েছে। তিনি এই কেন্দ্র দেখে মুগ্ধও হন। হাজি রানী আহমেদ (৭৩) নামে এক বৃদ্ধার স্বামী প্রকৌশলী হেলালউদ্দিন ২৬ বছর আবুধাবিতে চাকরি করেছিলেন। স্বামীর পাঠানো টাকা দিয়ে ভাইসহ নিকটতম আত্মীয়স্বজন নিয়ে যৌথ পরিবার চালাতেন। মানুষ করেছেন অনেককে। স্বামী মারা যাওয়ার পর সবাই তার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। সেই সুখের সংসার তছনছ হয়ে যায়। এখন তিনি বৃদ্ধাশ্রমে আছেন। সুখেই আছেন। কেউ খোঁজ না নিলেও এখানে বৃদ্ধারা তার আপনজন। এ সময় তার চোখের পানি পড়ছিল।

আনোয়ারা বেগম (৬৫) নামে এক বৃদ্ধা ঐ সময় বুক চাপড়ে কান্না করছিলেন। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে। স্বামী আব্দুল মান্নান তাকে ফেলে দ্বিতীয় বিয়ে করে সিলেটে চলে যান। দুই সন্তানকে আদর-যতেœ বড় করেছেন, মানুষ করেছেন। কিন্তু এই বৃদ্ধ বয়সে তাকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে।

ডা. রফিকুল ইসলাম (৮০) থাকতেন আজিমপুরে। তার চার ছেলের মধ্যে দুই জন ডাক্তার, দুই জন ইঞ্জিনিয়ার। তারা বহুদিন ধরে পরিবার নিয়ে আমেরিকায় থাকেন। সন্তানেরা এক দিনের জন্যও বাবার খোঁজ নেন না। স্ত্রী সেলিনা মারা যাওয়ার পর তিনি আরো অসহায় হয়ে পড়েন। নিকটতম আত্মীয়স্বজন তাকে দেখতে আসেন না। এখন এই বৃদ্ধাশ্রমে ভালো আছেন, সুখে আছেন বলেই কাঁদতে থাকেন।

এহসানুর রহমান (৮৬) ১৯৮৩ সালে উপসচিব হিসেবে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর স্ট্রোক করেন। হয়ে পড়েন প্যারালাইজড। দুই ছেলে আমেরিকায় থাকেন। তার খবর নেন না। আপনজনেরাও কাছে আসে না। খবরও নেয় না। এই অসহায় বৃদ্ধা পরে বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই নেন। এখন তিনি ভালো আছেন, সুস্থ আছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *