‘এপ্রিল ফুল’ থেকে ‘এপ্রিলের মিসাইল’

আন্তর্জাতিক

নাদিরা মজুমদার

আকাশ প্রতিরক্ষা বা এয়ার ডিফেন্সের (এডি) সাফল্য নিয়ে ইসরাইলিরা ও তাদের ‘৯৯ শতাংশ ভূপাতিত করনেওয়ালা’ বন্ধুরা মহা বিজয়োল্লাসে মুখর হয়েছিল। অবশ্য অতিসত্বর তারা হূদয়ঙ্গম করে যে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র আসল সত্য জানে। ১৪ এপ্রিল ইরানি মিসাইলগুলো পৃথিবীর দুর্ভেদ্যতম এয়ার ডিফেন্স ফালি ফালি করে রুটি বা মাছ স্লাইস করার কায়দায় অতিক্রম করে এবং তালিকা অনুযায়ী ‘রামোন’ ও ‘নেভাতিম’ বিমান ঘাঁটি দুটো ঘায়েল করে। এই ঘাঁটি দুটো থেকে ইসরাইলের অদৃশ্য ‘এফ-৩৫’ ফাইটার প্লেন দামেস্কে অবস্থিত ইরানি দূতাবাসসংলগ্ন কনস্যুলেট ভবনে বোমাবাজি করে ধ্বংস করে। এতে ইরানি বিপ্লবী বাহিনীর দুই জেনারেলসহ মোট সাত জন উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসারসহ সাকল্যে ১৫ জন নিহত হন। তেল আবিবে অবস্থিত ইসরাইলি বিমান বাহিনীর ইনটেলিজেন্স ভবন, দখলকৃত গোলান হাইটে (মাউন্ট হেরমন) অবস্থিত টপ-সিক্রেট ইনটেলিজেন্স-স্পাই ঘাঁটিতেও ইরানি মিসাইল আঘাত হানে। খোদ ইসরাইলের আকাশসীমা অতিক্রম করে ইরানের মিসাইল ‘হামলা’ কোনো বিনা মেঘে বজ্রপাত ছিল না, আসলে ‘হামলা’ তো নয়, ছিল ইসরাইলি দুরাচরণের উত্তর, হামলার বদলা হামলা। ১ এপ্রিল চুপিসারে ইরানি কনস্যুলেট ভবনের সঙ্গে লাগোয়া ভবনে বোমা হামলায় ইরানিদের হত্যা করা ও ভবন ধ্বংস করে ইসরাইল ‘এপ্রিল ফুল’জাতীয় কিছু করতে চেয়েছিল কি না, জানা নেই। তবে আন্তর্জাতিক আইন মতে, তথা জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী ইরানের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ওপরে আঘাত হানা হয়। কার্যত ভরা যুদ্ধের সময়ও শত্রুপক্ষের কূটনৈতিক মিশনে হামলা চালানোর নজির প্রায় নেই বলা যায়। এমনকি হিটলার কোনো কূটনৈতিক মিশনে হামলা চালাননি। তবে ১৯৯৯ সালে বেলগ্রেডে (আধুনিক সার্বিয়া) ননস্টপ বোমাবৃষ্টির সময় যুক্তরাষ্ট্র চীনা দূতাবাসে বোমা ফেলেছিল। সে সময় প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের প্রশাসন কালবিলম্ব না করে দুর্ঘটনাক্রমে বোমা পড়ার অজুহাত দেখিয়ে (চীন অবশ্য বিশ্বাস করেনি) দুঃখ প্রকাশ করেছিল। যাহোক, ইরানের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইসরাইলকে নিন্দা করে প্রস্তাব পাশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ভেটো দেয়। ফলে ইরানের দুটো অপশন থাকে :হয় চুপচাপ হজম করো, নয়তো ‘দুরাচারের বদলা দুরাচার’ নাও। প্রথম অপশনের বড় ঝুঁকি হলো, আরো আস্কারা পেয়ে উদ্ধত বেপরোয়া ইসরাইল ইরানবিরোধী সামরিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখবে।

ইরান তাই জাতিসংঘ সনদের ৫১ ধারার আওতায় মধ্যরাতের পরপরই ১৪ তারিখে বদলা হামলায় নামে। নামার আগে ইরান দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে :বাহাত্তর (৭২) ঘণ্টা আগে ‘ব্যাক চ্যানেল’-এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে বদলা হামলার দিনক্ষণ ও রূপরেখা জানিয়ে দেয়। রাশিয়া এবং চীনকেও অবগত করে। আগের দিন ইরান হরমুজ প্রণালির কাছে ইসরাইলি মালিকানাধীন একটি মালবাহী জাহাজ আটক করে; অর্থাত্ পশ্চিমের উদ্দেশে সংকেত পাঠানো যে প্রয়োজন বোধ করলে হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিতে পারে; হরমুজের মধ্য দিয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ জ্বালানি তেল রপ্তানি হয়।

৬১৪ (ছয় শ চৌদ্দ) বছর পরে ইরান (পারস্য) নিজের ভূখণ্ড থেকে আরেক ভূখণ্ডে—দীর্ঘতর পাল্লার ‘হামলার বদলা হামলা’য় বেরোয়; একাধিক দেশ ও একাধিক টাইমজোন পেরিয়ে ইসরাইলে যেতে ১ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার কিলোমিটার আকাশপথ অতিক্রম করতে হয়েছে। অর্থাত্, ইরান নজিরবিহীন একটি হামলা চালিয়েছে।

ইউক্রেনে রাশিয়া যে মিসাইল প্রযুক্তি ও আধুনিক যুদ্ধরীতির প্যারাডাইম প্রবর্তন করে, ইরান তা অনুসরণ করে :শুরু করে ‘শাহেদ১৩৬’সহ বিভিন্ন টাইপের ড্রোন দিয়ে, অতঃপর আসে অন্য সব ‘খেলনা’ এবং মধ্যরাতের পরে, ১৪ এপ্রিল একঝাঁক ড্রোন ছাড়া হয়। ড্রোনের স্পিড কম হয়ে থাকে। এরপর পূর্বনির্ধারিত বিরতির পর রিলিজ করা হয় ড্রোনের চেয়ে দ্রুততর ক্রুজ মিসাইল; অতঃপর, পূর্বনির্ধারিত বিরতির পরে রিলিজ করা হয় ‘ক্যু দ্য গ্রেস’ ব্যালিস্টিক মিসাইল।

তিন মুভমেন্টের সিম্ফনির কায়দায়—তিন স্তরের হামলা ব্যবস্থায় প্রতিটি স্তরের সঙ্গে চমত্কার সময়-সামঞ্জস্য করা হয়েছে এমনভাবে যে প্রথমে যাচ্ছে ধীরতম শাহেদ (ড্রোন), তারপর পরবর্তী দ্রুততম পাভেহ (ক্রুজ মিসাইল, উড্ডয়ন রেঞ্জ ১৬৫০ কিলোমিটার), সবশেষে দ্রুততম টাইম-টু-টার্গেট ব্যালিস্টিক মিসাইল (এমাদ, উড্ডয়ন রেঞ্জ ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার)। ছিমছাম চমত্কার ব্যবস্থা।

এদিকে দীর্ঘ ৭২ ঘণ্টার পরিসরে মার্কিন ইনটেলিজেন্সের সুবাদে বহুধা ‘আর্লি ওয়ার্নিং’ নির্দেশে বলীয়ান ইসরাইল তার ফাইটার জেটগুলো এবং সংশ্লিষ্ট লোকবল সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়। মার্কিন সামরিক রাডারগুলো প্রয়োজনাধিকভাবে প্রতিরক্ষা স্ট্র্যাটেজির সমন্বয়করণের কাজ করে।

আক্ষরিক অর্থেই ড্রোন-ব্যালিস্টিক মিসাইলের মিশ্রণ ইসরাইলের প্রতিরক্ষাকে সম্পৃক্ত করে দেয়। পঙ্গপালের মতো আগত (আসলে দাবার বড়ে) প্রায় ১৮৫টি শাহেদ-১৩৬-এর বিপুল সংখ্যাকে ধ্বংস করতে জাহাজে সংস্থাপিত আকাশ প্রতিরক্ষা থেকে শুরু করে ফাইটার জেটের দ্বারা যা কিছু সম্ভব সব ব্যবহার করা হয়। বাকিগুলোর কিছু ভূপাতিত হয় ছোট্ট কিংডম জর্ডানে, অবশিষ্টদের নামিয়ে আনে ইসরাইলি ফাইটারগুলো।

কিন্তু ইরানি মিসাইলগুলো, স্তরে স্তরে ‘ডেভিড স্লিং’স’, ‘অ্যারো-৩’, এসএম-৩, প্যাট্রিয়ট, ‘আয়রন ডোম’ ইত্যাদি দিয়ে তৈরিকৃত বিশ্বের দুর্ভেদ্যতম প্রতিরক্ষা সিস্টেমের প্রতিটি মিসাইল-শিল্ড অতিক্রম করে ইসরাইলের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। ব্যালিস্টিক মিসাইল হলো সব সমরাস্ত্রের সমরাস্ত্র তথা অ্যাপেক্স প্রিডেটর।

এবার সমান্তরালে এক পক্ষের নারী, শিশু, ইনকিউবেটরে রাখা শিশু, বৃদ্ধদের হত্যা করা, বোমাবাজি করে হাসপাতাল, মসজিদ, গির্জা, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, মানুষের ক্লেশ লাঘবকারী কনভয় উড়িয়ে দেওয়া, অন্যপক্ষ তথা ইরানি বদলা হামলা ইসরাইলের সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও সর্বোচ্চ প্রহরায় রাখা নেগেভ মরুভূমির দুটি আকাশঘাঁটি, দখলকৃত গোলান হাইটের ইনটেল সেন্টার, তেল আবিব এবং সম্ভবত পশ্চিম জেরুজালেমে অসামরিক রক্তপাতহীন মিসাইলের আঘাত হানে। ইরানের এই মার্জিত দক্ষতা, এলিগেন্স প্রশংসনীয়।

ইসরাইলের জন্য ছিল প্রচণ্ড ধাক্কা, সম্মিলিত পশ্চিমের জন্যও। ইউক্রেনে পশ্চিমের আকাশ প্রতিরক্ষা সিস্টেমের আথালিপাথালি অবস্থার কথা সবাই জানে; এখন গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো এই ইরানি ধাক্কার কথা বিশ্ববাসীর কাছে স্বীকার করা যায় কি? অসম্ভব…। ‘৯৯% ভূপাতিত’কারীদের অতিরঞ্জিত রেটোরিকে মূলধারার মিডিয়া মুখরিত হয়ে ওঠে।

আরো কারণ হলো: ‘বদলা হামলা’র মাধ্যমে ইরান ইসরাইলকে পরিষ্কার বলে দেয় যে, এর পরে যদি ইরান অথবা ইরানিদের ওপরে হামলা চালনো হয়, তবে ইরান সরাসরি ‘ইসরাইলে’ গিয়ে ইসরাইলকে উচিত শাস্তি দিয়ে আসবে। অর্থাৎ, দণ্ডমুক্ত ইসরাইলের পাইকারিভাবে ভীতি প্রদর্শনের সমাপ্তি হলো (তবে নেতানিয়াহু যে ইরানের বিরুদ্ধে আঘাত হানার চেষ্টা করবে না, কোনো গ্যারান্টি নেই; মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রেকে জড়িয়ে ফেলার প্রচেষ্টাও নিশ্চয় অব্যাহত থাকবে)।

এভাবে ইরান ‘কৌশলগত ধৈর্য’ থেকে নিজেকে ‘কৌশলগত সমীকরণে’ নিয়ে আসে। বর্তমানে যেসব ননস্টেট অ্যাক্টর সক্রিয় রয়েছে (হামাস, হিজবুল্লাহ্, হুতি), এই নতুন সমীকরণের আওতায় তারা ইরানের সম্পূরক অংশে পরিণত হলো এবং ‘ইসরাইল’কে একে অপরকে সরাসরি মোকাবিলা করতে হবে। শাহের আমলে প্রভাব ও ক্ষমতার বিবেচনায় ইরান ছিল একমোদ্বিতীয়ম আঞ্চলিক শক্তি; ইরান নিঃশব্দে সেই হারানো আসনে প্রত্যাবর্তন করল।

লেখক: চেক প্রজাতন্ত্র প্রবাসী লেখক ও বিশ্লেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *