সুবর্ণবাঙলা ডেস্ক
.
চুয়াডাঙ্গায় যখন তীব্র দাবদাহ, সিলেটে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি। একদিকে বন্যায় ডুবছে সুনামগঞ্জ, অন্যদিকে রাজশাহীতে দারুণ খরা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এভাবেই বদলে গেছে দেশের আবহাওয়া মানচিত্র। যার প্রভাব পড়েছে সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থায়। জলবায়ুর এমন বিচিত্র আচরণের কারণে এবার শিক্ষা ক্যালেন্ডার কাটছাঁটের পরিকল্পনা করছে সরকার। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির একাধিক সূত্র জনকণ্ঠকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত এক বছরে তীব্র গরম ও শীতের কারণে দুই মৌসুমে বিদ্যালয় বন্ধ করতে হয়েছে। এর ফলে শিখন ঘাটতিও বেড়েছে শিক্ষার্থীদের। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নও চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। শিক্ষা ক্যালেন্ডারে যখন গরমের ছুটি দেওয়া রয়েছে। সে সময় গরম কম পড়ছে। আবার ছুটি শেষ হওয়ার পর যখন স্কুল খোলার সময় তখন তাপমাত্রা এতই বেড়েছে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়েছে। শীতকালীন ছুটির বেলাও একই দশা।
এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (বিদ্যালয়) প্রফেসর সৈয়দ জাফর আলী জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের দেশে শীতকালীন ছুটির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আমরা ভাবছি এই ছুটিকে গ্রীষ্মের ছুটির সঙ্গে সমন্বয় করা যায় কী না! শিক্ষা ক্যালেন্ডারের পরিবর্তনের বিষয়ে তিনি বলেন, সম্প্রতি শিশুদের নিয়ে কাজ করা সংস্থা ইউনিসেফের সঙ্গে একটি কর্মশালা হয়েছে। কর্মশালায় এ বিষয়গুলো উঠে এসেছে। তাদের পক্ষ থেকে শিক্ষা ক্যালেন্ডার পরিবর্তনের জন্যও এক ধরনের বার্তা দেওয়া হয়েছে। এটি নিয়ে একটি ফ্রেম ওয়ার্ক করা হচ্ছে। তবে এর বাস্তবায়ন কবে থেকে সে বিষয়ে তিনি কিছু জানাননি।
তবে চলতি বছরেই তীব্র শীতের কারণে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছিল। জানুয়ারিতে কোনো জেলায় তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলেই সেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ রাখে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) থেকে শৈত্যপ্রবাহে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা নিয়ে নির্দেশনা জারি করা হয়। তাতে বলা হয়, সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১৭ ডিগ্রির নিচে নামলেই স্কুল বন্ধ রাখা যাবে। তবে এর দুই ঘণ্টার পরই সেই সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আনা হয়।
এ বিষয়ে মাউশির পরিকল্পনা শাখার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মাউশি শিক্ষা ক্যালেন্ডার পরিবর্তন নিয়ে কাজ করছে। নতুন সূচি অনুযায়ী পিটি প্যারেড, স্কুলের সময়েও পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বিশেষ করে দাবদাহের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কর্তৃপক্ষের মধ্যে এ বিষয়ে নতুন করে বোধোদয় হয়েছে। এবার শিক্ষা বর্ষে ছুটির তালিকা ঢালাওভাবে হবে না। জেলার ভূপ্রকৃতিগত অবস্থান, সামাজিক অবস্থা, জলবায়ু ঝুঁকি ও রাজনৈতিক বিষয়ও বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে।
জানা যায়, ২০২৩ সাল থেকে চালু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মদিবস ১৮৫ দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। এক বছরে ছুটি ৭৬ দিন। শুক্র ও শনিবার মিলিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে আরও ১০৪ দিন। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, জাতির পিতার জন্ম দিবস, স্বাধীনতা দিবস, শোক দিবস এবং বিজয় দিবস রয়েছে। সরকারি ছুটির ৫ দিন কর্মদিবসে অন্তর্ভুক্ত করায় প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা বছর শেষ হবে ১৮০ দিনে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউরোপের দেশগুলোতে ১৮১ দিনে শিক্ষা বর্ষ শেষ হয়। প্রতিবেশী দেশ ভারতে রাজ্যভেদে ১৮০-২০০ দিনে শিক্ষা বছর শেষ করা হয়। প্রশিক্ষিত শিক্ষক তৈরি করা গেলেই শিক্ষা ব্যবস্থায় যেমন গতি আসবে পড়াশোনার মানেরও বড় পরিবর্তন হবে।
এ বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বিদায়ী সদস্য অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বইগুলো এমনভাবে লেখা হয়, যেন শিক্ষার্থীরা এটি ১৪০ কর্মদিবসে শেষ করতে পারে। লেখকদেরও এভাবেই নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ ছাড়াও দুর্যোগপ্রবণ দেশ হওয়ায় আমরা বাৎসরিক শিক্ষাবর্ষে ২০ দিন সময় হাতে রেখেছি। এ বছর গরম শীতের কারণে মোট ১৩ দিন নষ্ট হয়েছে। এরপরও সাতদিন হাতে সময় আছে। কিন্তু আমাদের ক্লাসগুলো বেশি নষ্ট হয় বছরের শুরুতে। ওই সময় স্কুলগুলো দুই ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীদের ছুটি দিয়ে দেয়। ভর্তি নিয়ে স্কুলগুলো ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক আয়োজন ক্লাসের দিনে করে। অথচ জাতীয় দিবসগুলোতে এগুলো করা হলে সময় বাঁচানো যেত। শিক্ষার্থীরাও লাভবান হতো।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইউনেস্কো অন্তর্ভুক্ত অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) দেশগুলোর ১ম-৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের গড় শিখন ঘণ্টা ৭৯৯। এসব দেশের ষষ্ঠ-৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শিখন ঘণ্টা ৯১৯। ইউরোপের ২৩ দেশে গড় স্কুল দিবস ১৮১ দিন। প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের স্কুলের কর্মদিবসও ভিন্ন। যেমন মেঘালয়ে ১৯২ দিন। মহারাষ্ট্রে ২০০ দিন। এক্ষেত্রে এনসিটিবির দাবি, দেশের নতুন যে শিক্ষাক্রম সে অনুযায়ী ১৮৫ দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলবে। এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক মানের বলে দাবি করেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।
মাউশির পরিচালক (প্রশাসন) শাহেদুল খবীর চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের শিক্ষাবর্ষেও দুর্যোগকে মাথায় রেখে রিজার্ভ ডে রাখা হয়েছে। কিন্তু এখন যদি এলাকাভিত্তিক শিক্ষা ক্যালেন্ডার করা হয় সেটি ভিন্ন কথা। তবে এক্ষেত্রে উপকূলীয় এলাকা, পাহাড়ি এলাকা, নদী ভাঙন ও উষ্ণতম অঞ্চল অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে শুধু এক বছরে বিভিন্ন মেয়াদে দেশের ১০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। ২০২১ সালে বন্যা, পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, খরা, জলাবদ্ধতা, নদীভাঙনসহ অন্তত ১০ কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাঠদান, যা চরম প্রভাব পড়েছে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের করা এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের কারণে অনেক এলাকায় স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং স্কুলকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার একটি নিয়মিত ঘটনা। একইসঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও পানির স্তর এবং পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধিতে কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে সাধারণ মানুষের জীবনের আয় ও জীবিকাতে। এর থেকে বাঁচতে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে পৃথক শিক্ষা ক্যালেন্ডার করার তাগিদ দিয়েছেন শিক্ষাবিদরা।
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় দুই মন্ত্রণালয় থাকায় বিষয়গুলো কম গুরুত্ব পচ্ছে বলে মনে করেন ব্র্যাক বিশ^বিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ। তার মতে, শিক্ষার সব মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর ঢাকায় হওয়ায় এই ধরনের পরিস্থিতি কম অনুধাবন করা হয়। জনকণ্ঠকে এই শিক্ষাবিদ বলেন, দিনে দিনে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনা আরও বাড়ছে। এ বিষয়ে এখন থেকেই সঠিক পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। এর সঙ্গে সরকারকে অর্থায়নও করতে হবে। না হলে ২০৪১ সালের যে উন্নত বাংলাদেশের লক্ষ্যে আমরা এগিয়ে চলছি তা হোঁচট খাবে। শিক্ষা খাতও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
রবিবার একটি অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ছুটি ঠিক রাখাটা চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে আমাদের বর্তমান শিক্ষা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটি-ভিত্তিক। এ কারিকুলাম বাস্তবায়নে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেশি সময় খোলা রাখতে হচ্ছে। ফলে ছুটি ঠিক রাখা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠছে। এটা এক ধরনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে।