আলুর দরে ঊর্ধ্বগতি, নেপথ্যে সিন্ডিকেট নাকি উৎপাদন ঘাটতি?

খোলা কলাম জাতীয়

সুবর্ণবাঙলা অনলাইন ডেস্ক

আলু উৎপাদন। ফাইল ছবি।

দেশে আলু চাষে জমির আয়তন, আলু উৎপাদন এবং ভোক্তা চাহিদা নিয়ে বড় ধরনের তথ্য বিভ্রাট দেখা দিয়েছে। সরকারি তথ্যর সাথে বেসরকারি তথ্যের বড় ধরনের গরমিল স্পষ্ট প্রতিক্ষেত্রে। পণ্যটি নিয়ে মন্ত্রণালয়ভেদে বিপরীতমুখী নীতিও। সব মিলিয়ে আলু নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে আলু নিয়ে ‘সিন্ডিকেট বাণিজ্যের’ অভিযোগ তোলা হলেও তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন আলু চাষি, কোল্ড স্টোরেজ মালিক, ব্যবসায়ী, গবেষকসহ কৃষি অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, কৃষি সংশ্লিষ্ট কিছু সংস্থা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।

তাদের মতে, কম জমিতে আবাদ, মৌসুমজুড়ে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত উৎপাদন খরচ এবং তুলনামূলক কম উৎপাদন হওয়ায় কৃষক পর্যায়েই এবার আলুর দাম বেড়েছে। কৃষি গবেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, “উৎপাদন ঘাটতি, বাড়তি চাহিদা ও সরবরাহ সংকটে বাড়ছে আলুর দাম।”

বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে দেশে এ বছর ১ কোটি ১৬ লাখ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আলু উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ৯ লাখ টনের বেশি। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে মাত্র ৭ লাখ টন কম উৎপাদন হয়েছে। একই মন্ত্রণালয়ের অপর সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে এ বছর আলুর চাহিদা ৯৫ লাখ টন। সরকারের এই দুই সংস্থার হিসাবে চাহিদার তুলনায় ১৪ লাখ টন আলু উদ্বৃত্ত থাকার কথা। তবে কৃষক ও ব্যবসায়ীদের হিসাবে দেশে
ভোক্তা পর্যায়ে আলুর মোট চাহিদা ৯০ লাখ টন। আর উৎপাদন হয়েছে ৭০ লাখ টন। হরেক কারণে নষ্ট হয়েছে ১০ শতাংশ আলু। ফলে উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৭ লাখ টন আলু। আর বর্তমানে কোল্ড স্টোরেজগুলোতে সংরক্ষিত আলুর পরিমাণ ৩০ লাখ টন। গত ৫ মাসে আলু বাজারজাত করা হয়েছে ৩০ লাখ টনের বেশি।

অবশ্য, এ হিসাব মানতে রাজি নন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস। তার মতে, “উৎপাদনের তথ্যের ক্ষেত্রে খুব বেশি পার্থক্য হয় না, হয়তো একটু কম-বেশি হতে পারে। তবে চাহিদার চেয়ে উৎপাদন অনেক বেশি। বাজারে আলুর ঘাটতি আছে বা সরবরাহ কম বিষয়টি এমনও নয়। ব্যবসায়ীদের নৈতিক স্খলনের কারণে বাজারে অস্থিরতা দেখা যায়।”

এই প্রেক্ষাপটে আলু উৎপাদনের অন্যতম প্রধান জেলা মুন্সীগঞ্জের আলু চাষি, ব্যাপারী ও কোল্ড স্টোরেজ কর্মকর্তাদের সাথে সরেজমিনে ঘুরে কথা হয়েছে গত ৩১ মে। এর মধ্যে মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার রমজান বেগ এলাকার পঞ্চাশোর্ধ্ব কৃষক রবু ব্যাপারী সাড়ে ৬ একর জমিতে আলু চাষ করে পেয়েছেন ১২শ’ বস্তা। যা আগের বছরের তুলনায় ৪শ’ বস্তা কম। তার প্রতি কেজি আলুর উৎপাদনে ব্যয় হয়েছে ২৭ থেকে ২৮ টাকা। যা আগের বছর ছিল ১৮ টাকা।

গত বছরের তুলনায় কেজি প্রতি ন্যূনতম ১০ টাকা বাড়তি উৎপাদন খরচের হিসাব দিয়ে এই কৃষক জানান, বৈরী আবহাওয়া ও বীজ সংকটের কারণে খরচ অপ্রত্যাশিত বেড়েছে। এছাড়া বছরের শুরুতেই কোল্ড স্টোরেজগুলোর আলু শেষ হয়ে যাওয়ায় বাজারে নতুন আলুর অগ্রিম চাহিদা তৈরি হয়েছিল, ওই সময় ব্যবসায়ীরা খেত থেকে ৩০ টাকা দরে আলু সংগ্রহ করায় আমাদের অনেক চাষি অপরিপক্ব আলু তুলে ফেলেছেন, এটাও উৎপাদন ঘাটতির অন্যতম কারণ। “খরচ বেশি, উৎপাদন কম সেজন্য আমার সব আলু কোল্ড স্টোরেজে রাখছি, যখন ভালো দাম পাবো তখন ছাড়বো” জানান আলু চাষি রবু ব্যাপারী।

মুন্সীগঞ্জ জেলা আলু চাষি ও ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোঃ দেলোয়ার হোসেন জানান, চলতি বছরে প্রায় ৪ লাখ ১০ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৪৮ হাজার হেক্টর কম। হেক্টর প্রতি এবার আলুর উৎপাদন হয়েছে গড়ে ২৮ টনের মত। আগের বছর ছিল প্রতি হেক্টরে ৩০ টনের বেশি। সে হিসাবে হেক্টরে আলুর উৎপাদন কমেছে ২ টন।

বগুড়া, রংপুর, নওগাঁ, জয়পুরহাট ও মুন্সীগঞ্জসহ প্রতিটি জেলায় এবার কম আলু উৎপাদনের তথ্য দিয়ে আলু চাষিদের এই নেতা জানান, আলু চাষের ভরা মৌসুমে একাধিকবার নিম্নচাপ ও বৃষ্টির কারণে বিঘা প্রতি চাষিরা ৩০ হাজার টাকা বেশি খরচ করেও শেষ পর্যন্ত ভালো ফলন পাননি, যাও পেয়েছেন তার ২০ শতাংশ আলু মাঠেই নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩০ শতাংশ আলু কম হয়েছে। এতে বার্ষিক উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে একটি বড় ব্যবধান তৈরি হয়েছে।

“সিন্ডিকেট” করে দাম বাড়ানোর অভিযোগ ভিত্তিহীন ও বাস্তবতাবিবর্জিত উল্লেখ করে আলু চাষি ও ব্যবসায়ী সমিতির এই নেতা বলেন, আলু উৎপাদন ও ব্যবসার সাথে কমপক্ষে দুই লাখ লোক সম্পৃক্ত। এর মধ্যে ৫০ শতাংশই আলু চাষি। আলু চাষের পাশাপাশি কোল্ড স্টোরেজে সংরক্ষণকারী রয়েছেন ৩০ শতাংশ। আর বাকি ২০ শতাংশ অর্থাৎ ৪০ হাজার রয়েছেন যারা কৃষকের কাছ থেকে আলু কিনে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হিমাগারে রেখে বিক্রি করেন। সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বিপুল সংখ্যক ব্যবসায়ীর পক্ষে সিন্ডিকেট করা আদৌ সম্ভব নয়। একটি বিশেষ মহল নিজেদের দায় এড়ানোর জন্যই সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ উত্থাপন করে থাকেন।

জেলা সদরের পঞ্চসার এলাকার নিপ্পন কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক মনোরঞ্জন সাহা জানান, “আমাদের স্টোরেজে আলুর সংরক্ষণ ক্ষমতা প্রায় সোয়া দুই লাখ বস্তা। এবার প্রায় ২০ হাজার বস্তা আলু রাখার জায়গা ফাঁকা রয়েছে। আলুর উৎপাদন কম হওয়ায় ব্যাপারীরা মাঠ থেকে চড়া দামে আলু সংগ্রহ করে সরাসরি বাজারে পাঠিয়েছেন। ভালো দাম পাওয়ায় অধিকাংশ কৃষকের বাড়িতে এবার আলুর কোনো মজুদ নেই। যারা বেশি দামে আলু সংগ্রহ করে কোল্ড স্টোরেজে রেখেছেন তারা কিছু মুনাফার আশায় আলু ছাড়ছেন না। এটাও দৈনন্দিন বাজারে আলুর দাম বাড়ার অন্যতম কারণ।”

দেশের অন্যতম বৃহৎ কৃষিপণ্য সংরক্ষণাগার মুন্সীগঞ্জের দেওয়ান আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক মো. ইব্রাহীম জানান, “সাড়ে ৬ লাখ বস্তা ধারণক্ষমতার মধ্যে প্রায় ৪০ হাজার পূরণ হয়নি। তার উপর নির্ধারিত জুলাই মাসের পরিবর্তে দুই মাস আগে মে মাস থেকেই এবার কোল্ড স্টোরেজের আলু বিক্রি শুরু হয়েছে। অতীতে কখনো এ ধরনের পরিস্থিতি হয়নি। যেসব এলাকার আলু নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি ছিলো তারা আগেই বিক্রি করে দিচ্ছেন। তাও কোল্ড স্টোরেজের শেডেই বিক্রি হচ্ছে এখন ২২শ’ টাকা বস্তা বা ৪৪ টাকা কেজি দরে। আর যেসব ব্যাপারীর সংগ্রহ খরচ বেশি, তারা ভালো দাম পাওয়ার অপেক্ষা করছেন। আর কৃষকের রাখা আলু তারা ধাপে ধাপে বিক্রি করছেন। যেহেতু তারা কোল্ড স্টোরেজে নভেম্বর পর্যন্ত সময় পাবেন।’

বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ এসোসিয়েশনের হিসাব অনুযায়ী এ বছর সচল ৩৬০টি কোল্ড স্টোরেজের ধারণক্ষমতা ৪০ লাখ টন। আলু সংরক্ষণ করা হয়েছে ৩০ লাখ টন। আলুর অপর্যাপ্ততার কারণে এক চতুর্থাংশ জায়গা খালি রয়েছে। এ প্রসঙ্গে এসোসিয়েশনটির সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, কৃষি সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর কর্মকর্তারা আলুর উৎপাদন নিয়ে যেসব তথ্য দিচ্ছেন বাস্তবতার সাথে তার কোনো মিল নেই। আলু চাষের জমি, উৎপাদন খরচ ও মজুদ নিয়ে বাড়িয়ে তথ্য প্রকাশের কারণে সরকারের উচ্চ মহলে ভুল তথ্য যাচ্ছে। মূলতঃ বেশি খরচ করে কম উৎপাদন হওয়ায় মাঠ পর্যায়েই পঞ্চাশ কেজির প্রতি বস্তা আলু ১২শ’ টাকা থেকে শুরু করে ১৮শ’ টাকা পর্যন্ত বিকিয়েছে। খেত থেকে কোল্ড স্টোরেজে আনা এবং রাখা পর্যন্ত কেজি প্রতি খরচ যোগ হয়েছে প্রায় ১০ টাকা। ফলে খুচরা পর্যায়ে ৫০ টাকার নিচে আলু সরবরাহ কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয় বলেও উল্লেখ করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।”

খরচ বেশি, ফলন কম। চাহিদা বেশি, দামও বেশি” -উল্লেখ করে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক এই সহসভাপতি জানান, দেশে উৎপাদিত আলু দিয়ে ভোক্তা চাহিদা পূরণ হয় না বলেই গত বছর সরকার আলু আমদানি উন্মুক্ত করে দেয়। কিছু আলু আমদানি করা হলেও নানা কারণে মুনাফা না হওয়ায় তাতে গতি মেলেনি। এরই মাঝে সরকার আলু রপ্তানিরও অনুমতি দিয়ে রেখেছে। সেই সাথে আলু রপ্তানিতে ২০ শতাংশ প্রণোদনাও রাখা হয়েছে। সব মিলে আলু নিয়ে খোদ সরকারের ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যেই রয়েছে পরস্পরবিরোধী অবস্থান।

গ্লোবাল ভিলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কৃষি অর্থনীতিবিদ ডক্টর জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, দেশে সরকারিভাবে দেওয়া আলুর ব্যাপক উৎপাদনের তথ্য সঠিক নয়। মূলতঃ উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে বড় ব্যবধান রয়েছে। উৎপাদন ও সরবরাহ স্বাভাবিক হলে সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোর কোনো সুযোগ থাকে না। আলুর বাজারের অস্থিরতা দূর করতে হলে বছরে অন্ততঃ দুই লাখ টন উৎপাদন বাড়াতে হবে। সেই সাথে কৃষক পর্যায়ে আলুর সঠিক মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সরকারি ব্যবস্থাপনায়ও প্রচুর আলুর মজুদ গড়ে তুলতে হবে অর্থনৈতিক তত্ত্ব অনুযায়ী বিপুল সংখ্যক বিক্রেতা যে বাজারে থাকে সেটি হচ্ছে প্রতিযোগিতামূলক বাজার, যেখানে কারো পক্ষে দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হলে দাম বেশি হয় এবং চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি হলে দাম কম হয়। যেহেতু আলুর বাজার প্রতিযোগিতামূলক, তাই এখানে উচ্চমূল্য সরবরাহ ঘাটতির বিষয়টিকেই স্পষ্ট করে।

লেখক: মাঈন আল সুলতান, ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *