শামীমা চৌধুরী
‘কী করবো কন? নিজেগের বসতবাড়ি আর পাঁচ বিগে জমি নিয়ে সংসার ভালোই চলছিলো। একই জমিতে বছর বছর চাষ, সেই সাথে চিংড়ি ঘেরের নুনা পানির কারণে জমির স্বাস্থ্য এক্কেবারে কাহিল। খেতে ধান হয় না, সবজি হয় না। হাস-মুরগিগুলাও বাঁচে না। খাবার পানিও নুনা। বছরজুইড়ে পেটের অসুখ। পেটের ধান্দায় শেষমেশ সাতক্ষীরা থেইকে খুলনা আলাম।’
কথাগুলো বলছিলেন জরিনা খাতুন। কালাম মিয়া আর জরিনা খাতুন দম্পতির এখন নতুন পরিচয় কারখানার শ্রমিক। দুই ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে খুলনা শহরের এক কক্ষের একটি বাসায় বসবাস করেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই একটি ময়দা কলে চাকরি করেন। কৃষক পরিবারের নাম মুছে এখন কারখানার শ্রমিক হিসাবে পরিচিত এই পরিবার। তাদের মতো অনেক পরিবারই এখন ভ‚মি অবক্ষয়ের শিকার। দেশের শ্রমিক শ্রেণির, ভাসমান জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের আদি পরিচয় কৃষক বা কৃষিশ্রমিক হলেও কৃষিজমির অবক্ষয়ের কারণে তারা শহরের ভাসমান জনগোষ্ঠী।
দেশের ক্রমবর্ধমান অপরিকল্পিত নগরায়রণ ও চিংড়ি চাষ এবং একই জমিতে বারবার চাষ করার কারণে কৃষিজমির ওপর চাপ বাড়ছে। নিরুপায় মানুষ খুঁজছে বিকল্প পেশা। ভ‚মির ওপর চাপ বেড়ে যাওয়ায় একদিকে মাটির স্বাস্থ্য খারাপ হচ্ছে, অন্যদিকে কমে আসছে কৃষিজমির পরিমাণ। সরকারি হিসাব বলছে, প্রতিবছর গড়ে ২৭ হাজার হেক্টর ভূমির অবক্ষয় হচ্ছে।
ব্রাউনফিল্ড জমিকে দ্রুত চাষের অনুপযোগী করে ফেলছে। এই ব্রাউনফিল্ড হচেছ কারখানার বর্জ্য। নাইট্রোজেন, ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম, বাইকা কার্বন, সিসা ইত্যাদি পানিতে দ্রবণীয় হয়ে ভ‚গর্ভে চলে যায়। শুধু খেতের ফসল নয়, এতে এই দূষিত মাটিতে বেড়ে ওঠা গাছপালার ফলও বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। মানবদেহে ক্যানসার, স্নায়ুতন্ত্রের রোগ, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
গবেষকরা মনে করেন, ভ‚মি অবক্ষয়ের (ল্যান্ড ডিগ্রেডেশন) কারণ মূলত পাঁচটি। মাটির রাসায়নিক গুণের অবনতি, ভ‚মিক্ষয়, পানির স্তর নেমে যাওয়া ও খরা, জলাবদ্ধতা ও মাটি জমাট বাঁধা এবং প্রাণবৈচিত্র্য হ্রাস। সরকারের মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের গবেষণা বলছে, দেশের ১ কোটি ১২ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর ভ‚মি অবক্ষয়ের শিকার। এটি দেশের মোট ভ‚মির ৭৬ দশমিক ১ শতাংশ।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট ভ‚মির পরিমাণ ১ কোটি ৪৭ লাখ ৫৭ হাজার হেক্টর। জনসংখ্যা ১৭ কোটি। ভ‚মির ওপর এ দেশের মানুষের নির্ভরতা অনেক। কিš‘ মাথাপিছু ভ‚মির পরিমাণ ০.০৯ হেক্টর। সিঙ্গাপুরের মতো নগররাষ্ট্র ছাড়া মাথাপিছু এত কম জমি আর কোনো দেশে নেই। এ সামান্য পরিমাণ জমিতেই বসবাস, এর উৎপাদিত ফসলেই জীবনধারণ। চাপ এ কারণেই।
সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে আয়োজিত বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের অনুষ্ঠানের মূল উপস্থাপনায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান এসএম বখতিয়ার বলেছিলেন, বাংলাদেশে কৃষি ফসল উৎপাদন বেড়েছে অসাধারণভাবে। সত্তরের দশকে দেশে ধানের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ২০ লাখ মেট্রিক টন। বর্তমানে তা ৩ কোটি ৮০ মিলিয়ন মেট্রিক টন। এটা সম্ভব হয়েছে আধুনিক প্রজাতি (উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড), সেচ এবং সার-কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে। পাশাপাশি বৃদ্ধি পাচ্ছে ভূমির অবক্ষয়। বর্তমানে দেশের অনেক অ লে ফসলের মাঠ খালি পড়ে থাকে না। মাটির বিশ্রাম নেই। একটি ফসল উঠলেই অন্য ফসলের চাষ করা হচ্ছে। অবশ্য মৃত্তিকা বিজ্ঞানীরা বলছেন, অতি ব্যবহারে মাটি নিঃস্ব, দুর্বল, রোগগ্রস্ত। মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারের কারণে মাটি বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগে বড়ো ধরনের উদ্যোগ জরুরি। ‘দেশের ৭৬ শতাংশ এলাকার মাটির স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে। কৃষিকাজের কারণে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহার করায় মাটির ক্ষয় বেশি হচ্ছে। এর বাইরে শিল্পকারখানার দূষণও বড়ো কারণ হয়ে উঠেছে। আর মাটি হচ্ছে এমন এক সম্পদ, যা আমরা চাইলেও সৃষ্টি করতে পারব না। ফলে ওই মাটির ক্ষয় রক্ষা করতে হলে সচেতনতার মধ্য দিয়ে রাসায়নিক ও বালাইনাশকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে পারে। শিল্পদূষণ কমাতে হবে। নয়তো দীর্ঘ মেয়াদে ফসলের উৎপাদন কমে যাওয়া এবং তা বিষাক্ত হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে জনস্বাস্থ্য বিপন্ন হবে।’
মাটির গুণাগুণ অনেকটা নির্ধারণ করে মাটিতে থাকা বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ। মাটিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়ামের পাশাপাশি ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, সালফার, জিংক, বোরন, আয়রন ও ম্যাংগানিজ থাকে। সব জায়গার সব জমিতে এসব রাসায়নিক সমানভাবে বা সমান অনুপাতে থাকে না। মাটিতে জৈব পদার্থ কী পরিমাণে আছে, তার ওপরও মাটির উৎপাদনক্ষমতা নির্ভর করে। ২০২০ সালে দেখা গেছে, ১ কোটি ১৬ লাখ ২০ হাজার হেক্টর বা দেশের প্রায় ৭৯ শতাংশ জমিতে প্রয়োজনীয় জৈব পদার্থের ঘাটতি আছে। এর মধ্যে দেশের প্রায় ৩০ শতাংশ জমিতে জৈব পদার্থের কমতি মাঝারি থেকে তীব্র মাত্রায়।
গবেষণা বলছে, দেশের প্রায় ৩৩ শতাংশ জমিতে অ¤øতা বেশি। অন্যদিকে দেশের উপক‚লের জেলাগুলোয় লবণাক্ততা বাড়ছে। দেশের ৭ শতাংশ জমিতে লবণাক্ততা বেশি। এছাড়া দেশের প্রায় ৫ শতাংশ এলাকার মাটিতে সহনীয় মাত্রার চেয়ে আর্সেনিকের পরিমাণ বেশি। আর্সেনিক বহু বছর ধরে বাংলাদেশে বড়ো ধরনের জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে আছে। এছাড়াও পাহাড়ি এলাকায় ভূমিক্ষয়, নদীভাঙন এবং বালুর ঢল ভ‚মিকে নষ্ট করছে। প্রাকৃতিক কারণে পাহাড়ি এলাকায় ভূমি ক্ষয় হয়। কিন্তু পাহাড়ি এলাকার বন ধ্বংস, আদা ও আনারসের চাষ অতিমাত্রায় ভূমিক্ষয়ের কারণ বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন। প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণে পাহাড়ি এলাকায় ভ‚মিধস হতে দেখা যাচ্ছে। ২০২০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের পাহাড়ি এলাকায় ভ‚মিক্ষয়ের পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ হেক্টর।
নদীভাঙন দেশের ভ‚মিক্ষয়ের অন্যতম কারণ। সারা দেশের ছোটো-বড়ো অনেক নদীতে ভাঙন লেগেই আছে। বসতবাড়ি ও ফসলি জমি প্রতিবছর নদীতে বিলীন হয়। বেশি ভূমিক্ষয় হয় পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, দুধকুমার ও তিস্তা নদীতে। পাহাড়ি এলাকায় হঠাৎ বৃষ্টিতে ঢল নামে। এ ঢলে মাটি, বিশেষ করে বেলে মাটি পাহাড়ের আশপাশ এলাকায় এসে পড়ে। এই ঢলও মাটির মান কমিয়ে দিচ্ছে।
দেশের কিছু এলাকায় নিয়মিতভাবে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। আবার কোনো কোনো এলাকায় পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাচ্ছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া এলাকা সহজে খরার কবলে পড়ে। কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে খরাকে বলা হয় নীরব ঘাতক। খরাপ্রবণ এলাকায় গ্রীষ্মকালে পানীয় জলের কমতি দেখা দেয়। এসব এলাকায় গবাদি পশু পালনও কঠিন হয়ে পড়ে। ২০২০ সালে দেশের ১০ দশমিক ৪ শতাংশ এলাকায় স্বল্প, মাঝারি, তীব্র ও অতি তীব্র খরাকবলিত ছিল। দেখা যাচ্ছে, দেশে খরাপ্রবণ এলাকা বাড়ছে। ২০০০ সালে এরকম এলাকা ছিল ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থাৎ খরাকবলিত এলাকা বাড়ছে।
অন্যদিকে দেখা যায়, দেশের কোনো কোনো এলাকায় দীর্ঘসময় পানি জমে আছে। এটা দেখা যায় দেশের শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ এলাকায়। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের গবেষণা বলছে, খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা ও নোয়াখালী জেলায় এই জলাবদ্ধতার চিত্র দেখা যায়। চার-পাঁচ মাস জমে থাকা পানির কারণে ফসল ভালো হয় না, জলাবদ্ধ এলাকার মানুষের কাজকর্ম ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মানুষের মধ্যে রোগবালাই বেশি দেখা যায়, এলাকায় বেকারত্ব বাড়ে।
মাটির আরও কিছু কারণে উর্বরতা হারায়। নির্মাণকাজের সময় মাটিতে অবশেষ বা বর্জ্য পড়ে। বড়ো বড়ো প্রকল্প বাস্তবায়ন ছাড়াও মানুষ জমিতে ব্যাবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে, বসবাসের জন্য পাকা ভবন বানা”েছ। ভবন বা বড়ো অবকাঠামো নির্মাণের সময় ইট, বালু, সুরকি, সিমেন্ট মাটিতে পড়ে। যে কারণে মাটির স্বাভাবিক গুণ নষ্ট হয়। ২০২০ সালে এ কারণে দেশের প্রায় ৪ শতাংশ জমির গুণাগুণ ঝুঁকিতে পড়েছিল।
পরিবেশগত সমস্যার কারণে জীববৈচিত্র্য ঝুঁকিতে পড়ে। এর ফলে বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি, জীবজš‘ বা গাছপালার টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। এটা হচ্ছে মূলত ভ‚মি ব্যবহারে পরিবর্তন, কোনো কোনো প্রজাতির ওপর বেশি গুরুত্বারোপ, জলবায়ুর পরিবর্তন, দূষণ এবং আগ্রাসী প্রজাতির প্রবর্তন।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা যায়, দেশের প্রায় ৪ শতাংশ এলাকায় প্রাণবৈচিত্র্যের অবক্ষয় ঘটছে। যেসব এলাকায় এই ঝুঁকি বেশি দেখা যাচ্ছে, তার মধ্যে আছে সিলেট অববাহিকা, সুরমা-কুশিয়ারা প্লাবনভ‚মি, সুন্দরবন ও সেন্টমার্টিন দ্বীপ।
মাটির কিছু পুষ্টি চলে যায় ফসলের সঙ্গে। যত ফসল ফলে, তত মাটির পুষ্টিগুণ কমে। উদ্ভিদ মাটি থেকে যে পুষ্টি নেয়, সার দিয়ে তা পূরণ বা প্রতিস্থাপন করার চেষ্টা চলে। মাটির উর্বরতা বা পুষ্টির ভারসাম্য ঠিক রাখা একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বাংলাদেশও এ সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি এ সমস্যাকে আরও গভীর করে তুলছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ২০৬১ সাল পর্যন্ত বাড়তে থাকবে। তখন বাংলাদেশের অনুমিত জনসংখ্যা হবে ২০ কোটি ৭০ লাখ। অর্থাৎ প্রতিবছর বেশ কয়েক লাখ নতুন মানুষ জনসংখ্যার সঙ্গে যুক্ত হ”চ্ছে। তাদের জন্য খাদ্যের জোগান যেমন দরকার, একইভাবে দরকার আবাসন। এ স্থায়ী টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে যেতে হবে।
এ সমস্যাগুলো বহুমাত্রিক। কিছু সমস্যা বহুল আলোচিত, সমাধানেরও কিছু চেষ্টা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, মাটির পুষ্টির ক্ষেত্রে কিছু ইতিবাচক বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে। এখন ফসলের অবশেষ (নাড়া, কুটা) মাঠে রেখে আসার প্রবণতা ও পরিমাণ বেড়েছে। এতে জমির জৈবগুণ বাড়ছে। দ্বিতীয়ত, যৌক্তিক সারের ব্যবহার আগের চেয়ে বেড়েছে।
দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে। এতে প্রতিদিনই মাটির ওপর চাপ বাড়ছে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য আমাদের দৃশ্যমান জোরালো প্রস্তুতি প্রয়োজন। আর এরই বাস্তবতায় এ সমস্যা নিরসনে বর্তমান সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ২০১৫-২০১৬ সালের ভূমি আইন সংস্কার, প্লাবন ভ‚মি ও ফসলি জমিতে পুকুর-মাছ চাষ বন্ধ, জেগে ওঠা নতুন চরের ভ‚মি বন্দোবস্ত এই কাজগুলো বাস্তবতার মুখ দেখছে। তিনি তার উন্নয়নের ১০টি বিশেষ উদ্যোগে পরিবেশকে গুরুত্ব দিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে যেসব কাজ চলছে, তারও সমন্বয় করা হচ্ছে। আর তাই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ নতুন করে স্বপ্ন দেখছে আবার তারা ফিরে পাবে সেই উর্বরা খেত-খামার। (পিআইবি ফিচার)