আত্মনির্ভরশীলতা নারীর ক্ষমতায়নের মূলমন্ত্র

Uncategorized

শাহনাজ পারভীন এলিস

বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করাসহ দেশের প্রবৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গ্রামা লে বসবাসকারী তৃণমূল নারীদের ভ‚মিকা অনস্বীকার্য। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিকে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরেও কাজ করছেন আমাদের গ্রামীণ নারীরা। পোশাকশিল্প বর্তমানে যে পর্যায়ে এসেছে, এর পেছনে মুখ্য ভ‚মিকা রেখেছেন গ্রামের প্রান্তিক নারীরা। বর্তমানে তারাই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি। পোশাকশিল্পকে কেন্দ্র করে ব্যাংক, বিমা, বন্দর, পরিবহণ, পর্যটন, হোটেল প্রভৃতি শিল্পই বিকাশ লাভ করেছে।

নারী পরিবারের অন্যতম আর্থিক জোগানদাতা হওয়া সত্তে¡ও ক্ষমতায়নে একেবারেই পিছিয়ে। পারিবারিক উপার্জনে নারীর অংশগ্রহণ থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতায়নের অভাবে গ্রামের অনেক নারী তাদের আর্থিক অধিকার ভোগ করতে পারছেন না। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর মতামতকে কখনো মূল্যায়ন করা হয় না। অথচ আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষমতা অর্জন নারীর ক্ষমতায়নের প্রধান শর্ত। নারীর কাজের অধিকার এবং নিজের আয়ের ওপর সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা তাঁর ক্ষমতায়নকে সুসংহত করে।

প্রকৃতপক্ষে প্রান্তিক নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমেই গ্রামীণ অর্থনীতির ক্রমোন্নতি সাধন করা সম্ভব। পরিবার ও সমাজের নানা প্রতিক‚লতা সত্তে¡ও তৃণমূলের নারীরা ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত হচ্ছে, নেতৃত্বও দিচ্ছে। তবে রাজনীতিতে আসা সেসব সংগ্রামী নারীর মধ্যে কয়েকজনের গল্প পাঠককে জানাচ্ছি।

বাল্য বধূ থেকে জনপ্রতিনিধি
দশম শ্রেণিতে পড়াবস্খায় বাল্যবিবাহের শিকার হন মোছাম্মৎ রুমানা বেগম। স্বামী শাহিনুর ইসলাম পেশায় একজন ব্যবসায়ী। কিš‘ বিয়ের পরও নিজের প্রবল ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে স্বামীকে রাজি করিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যান। পরে স্বামীর সহযোগিতায় রুমানা ২০০৭ সালে পোড়াহাট সিদ্দিকীয়া আলিম মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাশ করেন। এরপর সংসারের পাশাপাশি ২০১৬ সালে রুমানা বেগম সৈয়দপুর সদরের বোতলাগাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের ৯নং ওয়ার্ডে সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পদে প্রার্থী হন। কিন্তু অল্প ভোটের ব্যবধানে তিনি পরাজিত হন। তবে আত্মবিশ্বাস না হারিয়ে রুমানা সমাজ উন্নয়নে কাজের ধারা অব্যাহত রাখেন।

২০১৮ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর রুমানা তাঁর দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছিলেন। সেসময় ডেমোক্রেসিওয়াচ-এর অপরাজিতা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ইউনিয়ন অপরাজিতা নেটওয়ার্ক কমিটির সদস্য হিসাবে কাজ শুরু করেন। এরপর প্রকল্পের বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশ নেন। প্রশিক্ষণ থেকে তিনি একজন নাগরিকের দায়িত্ব, কর্তব্য, সামাজিক দায়বদ্ধতার গুরুত্ব, আত্মশক্তির বৃদ্ধি ও উপায় সম্পর্কে জানতে পারেন। তিনি নবশক্তিতে উদ্দীপিত হয়ে উঠেন। প্রশিক্ষণের পর রুমানা নিজেকে স্বাবলম্বী করতে নিজ বাড়িতে শুরু করেন গরু ও হাঁস-মুরগি পালন। পাশাপাশি জনপ্রতিনিধি হওয়ার আকাক্সক্ষায় বিভিন্ন সামাজিক কাজও অব্যাহত রাখেন। পরবর্তী সময়ে সেই ই”ছাশক্তিকে কাজে লাগাতে ২০২১ সালে রুমানা বেগম বোতলাগাড়ি ইউপি নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী সদস্যপদে প্রার্থী হন। পরে সবার সহযোগিতার তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার পর রুমানা বেগমের কাজের পরিধি আরও বাড়তে থাকে। তিনি সমাজের উন্নয়নমূলক বিভিন্ন র্কমকাণ্ডে জড়িত।

সংগ্রাম করে জনমানুষের
পরিবার-পরিজনের সঙ্গে সংগ্রাম করে জনপ্রতিধি হওয়া আরেক নারী সুলতানা আখতার। তিনি রংপুর সদর উপজেলার ১নং মোমিনপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়েই তিনি এ পর্যায়ে এসেছেন। ২০১৬ সালে দেবরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সুলতানা বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তিনি সাধারণ মানুষের বিপদে-আপদে, সুখ-দুঃখে সর্বদা মিশে আছেন, যা খুবই কম দেখা যায়। উন্নয়নের কাজ করতে গিয়ে কোনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। নারী হিসাবে নিজেকে কখনো দুর্বল মনে করেননি। আর সেই মনোবলই ছিল তাঁর এগিয়ে যাওয়ার মূল অনুপ্রেরণা।

পরে স্বামীসহ পরিবারের সদস্যরাই তাঁর এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ২০২১ সালে সুলতানার স্বামী মো. বজলার রহমানও চেয়ারম্যানপ্রার্থী হিসাবে একই পদে ইউপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। স্বামীসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সুলতানার বাগ্্বিতÐা ও মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়। মনোনয়নপত্র দাখিলও করেন। কিš‘ পুরুষশাসিত পারিবারিক বাধায় অবশেষে তিনি মনোনয়ন তুলে নিতে বাধ্য হন। নির্বাচনে সুলতানার স্বামী পরাজিত হন।

জনপ্রতিনিধিত্বের এ লড়াইয়ে বজলার রহমান শুধু নির্বাচনে নয়, হেরে যান নারী নেতৃত্বের কাছেও। আসলে পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজে পুরুষরা সহজে ক্ষমতা ছাড়তে চান না। মুখে যত কথাই বলুক, নারী এগিয়ে গেছে, নারীকে এগিয়ে দিচ্ছি। বাস্তব চিত্র অন্যরকম। জনপ্রতিনিধি হতে না পারলেও সুলতানা তাঁর আগের নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছেন। কারণ তিনি মনে করেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণের এ বাধা নেতৃত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে তাঁকে আরও একধাপ এগিয়ে দিয়েছে। এভাবেই মনোবলে বলীয়ান নারীরা তৃণমূল পর্যায়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

চলতি বছর ১০ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষ্যে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের উদ্যোগে এক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেই সম্মেলনে প্রধান তিন রাজনৈতিক দলআওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির শতাধিক নারী নেত্রী অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অগ্রযাত্রায় নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ওপর গুরুত্বারোপ করেন আলোচকরা। তারা বলেন, নারীর রাজনৈতিক নেতৃত্বের অগ্রগতির জন্য অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের কোনো বিকল্প নেই। নারী নেতৃত্বে পুরুষের বাধা মোকাবিলায় সবচেয়ে জরুরি নারীর আত্মনির্ভরতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন। পুরুষের উপার্জনের ওপর নারীর নির্ভরতা কমাতে না পারলে তৃণমূলের নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়।

দেশের প্রত্যন্ত অ লে বসবাসকারী নারীদের উন্নয়নে এখনো সবচেয়ে বড়ো বাধা আর্থিক পরনির্ভরতা। দিবারাত্র শ্রম দেওয়ার পরও অনেক পরিবারেই অর্থসম্পদে মালিকানা বা অংশীদারত্ব পান না নারী। গ্রামীণ নারীর অগ্রগতিতে আর্থিক ক্ষমতায়ন শুধু রাজনীতিতে নয়, সমাজে নারীকে মর্যাদার সঙ্গে এগিয়ে নিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এ কারণে গ্রামীণ নারীদের আর্থিকভাবে ক্ষমতায়িত করার লক্ষ্যে তাঁদের উদ্যোক্তা হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে গত বছরের জুলাইয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার।

‘গ্রামীণ নারীর ক্ষমতায়নে টেকসই শিক্ষা ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন’ বিষয়ক প্রায়োগিক ওই গবেষণা প্রকল্পের যৌথ উদ্যোক্তা পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। ২০২৩ সালের জুলাই থেকে কুমিল্লা কোটবাড়ী এলাকায় তিন বছর মেয়াদি চলমান ৪৭ লাখ টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি।

নারীর ক্ষমতায়নে কীভাবে কার্যক্রম চলছে জানতে চাইলে প্রকল্পটির পরিচালক সাইফুন নাহার জানান, সমাজের সুবিধাবি ত নারীদের অধিকার রক্ষা এবং সব ধরনের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ততা বাড়ানোই তাঁদের লক্ষ্য। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীদের ক্ষমতায়িত করতে সরকারের ১০টি উদ্যোগের মধ্যে এটি অন্যতম একটি উদ্যোগ। উন্নয়নের মূলস্রোতে সর্বস্তরের নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে এ প্রকল্পে সুবিধাবি ত গ্রামীণ নারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বাড়িয়ে কৃষিকাজ ছাড়াও অন্যান্য খাতে তাঁদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রচেষ্টা চলছে। বিগত এক বছরে কুমিল্লা জেলার চার উপজেলায় ২৪টি গ্রাম সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে। এসব সংগঠনে এ পর্যন্ত ১১শর মতো নারীকে প্রশিক্ষিত করে উন্নয়নমূলক নানা কাজে সম্পৃক্ত হয়েছেন। প্রশিক্ষিত নারীদের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হতে ওই সংগঠন থেকে ঋণ দেওয়া হয়।

সমাজের দুস্থ ও সুবিধাবঞ্চিত নারীদের অজ্ঞতা মোচনে মৌলিক অধিকারগুলো সম্পর্কেও সচেতন করা হচ্ছে। তাদের জীবনমুখী ও টেকসই শিক্ষা, নেতৃত্ব বিকাশ, সংগঠন ব্যবস্থাপনা ও ক্ষমতায়ন, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি ও উৎপাদন দক্ষতা উন্নয়নমূলক জোরালো প্রশিক্ষণ প্রদান এবং সামাজিক ও জেন্ডার উন্নয়ন সংক্রান্ত বিষয়ে সচেতন করা হচ্ছে। দারিদ্র্য দূরীকরণের পাশাপাশি তাঁদের জীবনমান উন্নয়নে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সাংগঠনিক দক্ষতা ও উদ্যোক্তা হিসাবে সফলতার জন্য এরই মধ্যে ৩০ জন্য নারীকে স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কারও দেওয়া হয়েছে।’ সাইফুন নাহার আরও জানান, দেশে দারিদ্র্য বিমোচন ও গ্রাম-শহরের ব্যবধান হ্রাসের লক্ষ্যে গ্রামকে সব উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে গড়ে তুলতে গ্রামে আধুনিক নাগরিক সুবিধা স¤প্রসারণের লক্ষ্যেও তাঁরা কাজ করছেন।

প্রান্তিক তথা গ্রামীণ নারীদের সক্ষমতা অর্জনে সরকার সব ধরনের সুবিধার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। শিক্ষায় নারীর শতভাগ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করা, আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নারীর সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগ অভাবনীয়। সরকার এসএমই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা এবং তাদের কাজের প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়নের সুযোগ করে দিয়েছে। ব্যবসায়ে সমান সুযোগ তৈরি করার উদ্দেশ্যে ২০১১ সালে জাতীয় নারী নীতি গ্রহণ করা হয়। নারীর প্রতি সব ধরনের সহিসংতা রোধে ২০১২ সালে প্রণয়ন করা হয় পারিবারিক সহিংসতা দমন ও নিরাপত্তা আইন ২০১২। বাল্যবিবাহ নিরোধ করে মেয়েশিশুদের সমাজে অগ্রগামী করার জন্য বাল্যবিবাহে নিরোধ আইন ২০১৭ প্রণয়ন করা হয়েছে। এসব কিছুর মূল লক্ষ্যই হলো নারীর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা অর্জনে সহায়তা করা।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, দৈনিক খবরের কাগজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *