অনলাইন ডেস্ক
ভ্যানের ওপর তোলা হচ্ছে একের পর এক মরদেহ, একটির ওপর আরেকটি রক্তাক্ত লাশ। মাথায় হেলমেট বুকে ভেস্ট পরিহিত কয়েকজন পুলিশ সদস্য ব্যস্ত এই কাজে। মরদেহগুলো ঢেকে দেওয়া হলো ময়লা চাদর আর রাস্তার পাশের ব্যানারে। চাদর আর ব্যানারের আড়াল থেকে দেখা যাচ্ছে হাত-পা-মাথা।
গত শুক্রবার রাতে এমন বীভৎস ও লোমহর্ষক ঘটনার একটি ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ১ মিনিট ১৪ সেকেন্ডের ভিডিওটি সাভারের আশুলিয়া থানা-সংলগ্ন এলাকার বলে দাবি করেছেন অনেকে। এএফপির ফ্যাক্ট-চেকিং এডিটর কদর উদ্দিন শিশির তার ফেইসবুক টাইমলাইনে ঘটনাটি ৫ আগস্ট আশুলিয়া থানার নিকটবর্তী এলাকায় বলে উল্লেখ করেছেন।
জানা গেছে, নির্মম এই ঘটনাটি ঘটেছে সাভারের আশুলিয়ায়। ভিডিওতে দেখা যাওয়া হেলমেট পরিহিত পুলিশ সদস্যদের একজন ঢাকা উত্তরের গোয়েন্দা পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা আরাফাত হোসেন। স্থানীয়রা বলছেন, ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ছাত্র-জনতা আশুলিয়া থানার সামনে জড়ো হয়। পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। ফলে আন্দোলনে অংশ নেওয়া অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। পুলিশ নিহতদের একটি ভ্যানে করে অন্য স্থানে নিয়ে যায়। এমনকি পুলিশের একটি গাড়িতে কয়েকজনকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষার্থী বলেন, ৫ আগস্ট পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়েছে। থানার আশপাশে অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে ছিল। একটি পুলিশের গাড়িতে কয়েকজন গুলিবিদ্ধকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। এখান থেকেই ভ্যানে তোলা হয়েছিল লাশের স্তূপ (আশুলিয়া থানার সামনে)। আশুলিয়া থানার সামনের দোকানি ফাহিমা বলেন, আমরা ভিডিওটি দেখেছি। ভিডিওটি আমাদের আশুলিয়া থানার সামনে থেকেই করা। আমরা সেদিন ভয়ে দোকান বন্ধ রেখেছিলাম। আশুলিয়া থানার পাশেই কিছু বালু ভর্তি ব্যাগ ছিল, যা ভিডিওতে দেখা গেছে।
আরেক দোকানদার মনোয়ার বলেন, ৫ তারিখে আমার দোকান বন্ধ ছিল। পরদিন ৬ তারিখ সকালে আশুলিয়া থানার সামনে এসে দেখি পুলিশ ভ্যানে কয়েকটা পোড়া লাশ। তবে লাশের সংখ্যা নির্দিষ্ট করতে পারিনি। ভ্যানে লাশের স্তূপের ভিডিওটা আশুলিয়া থানার সামনের।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্ট আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নির্বিচার গুলি চালালে বেশ কয়েকজন নিহত হন। পরদিন পুলিশ লেখা পিকআপে আগুনে পুড়ে যাওয়া একজনকে শনাক্ত করেছিলেন বলে স্বজনেরা জানান। আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া শিক্ষার্থী সাজ্জাদ হোসেনের মা শাহিনা বেগম বলেন, ‘৫ আগস্ট থেকে ছেলে নিখোঁজ ছিল। পরদিন পুলিশের পিকআপ থেকে আগুনে পোড়া লাশ পাই। লাশের পকেটে আইডি কার্ড দেখে ছেলের লাশ চিনতে পারি। ৭ তারিখে গাইবান্ধার শ্যামপুর গ্রামে লাশ দাফন করেছি।’ আশুলিয়া এলাকার বিভিন্ন হাসপাতালের তথ্যমতে, আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় হামলার ঘটনায় ১৪ জন নিহত হন। এ ছাড়া আশুলিয়া থানা এলাকায় তিনজন পুলিশ সদস্যসহ অন্তত পাঁচজন নিহত হন।
ভিডিওতে মাথায় হেলমেট পরিহিত পুলিশ সদস্য ঢাকা উত্তরের গোয়েন্দা পুলিশের আরাফাত হোসেন বলে শনাক্ত করেছেন স্থানীয়রা। এ বিষয়ে আরাফাত হোসেনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
ঢাকা জেলা উত্তরের গোয়েন্দা পুলিশের ইনচার্জ রিয়াজ উদ্দিন বিপ্লব বলেন, ভিডিওটি অস্পষ্ট। তবে আরাফাত হোসেন আমাদের ঢাকা উত্তরের গোয়েন্দা পুলিশের তদন্ত হিসেবে কর্মরত রয়েছে। ভিডিওর ওই পুলিশ সদস্য আরাফাত কিনা আমি নিশ্চিত নই। তবে সকাল থেকে অনেকই আমাকে ফোন দিয়ে আরাফাতের বিষয়ে জানাতে চাচ্ছে। আরাফাত ৫ আগস্ট কোথায় ডিউটি করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা গোয়ন্দা পুলিশরা সাভার থানায় ডিউটি করেছি। কিন্তু আরাফাত সেদিন কোথায় ডিউটি করেছে, তা আমি নিশ্চিত নই।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) আহম্মদ মুঈদ বলেন, ‘ভিডিওটি আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি। আমাদের বিশেষজ্ঞ টিম সেটি নিয়ে কাজ করছে। এ ছাড়া ভিডিওতে দেখতে পাওয়া ঘটনাস্থলে উপস্থিত ব্যক্তিদের অনেকে চিনেছেন বলে আমাদের তথ্য দিচ্ছেন। আমরাও বিষয়টি নিশ্চিত হতে কাজ করছি।’