প্রতি প্রাণে বেজে উঠল জাতীয় সংগীত
সুবর্ণবাঙলা অনলাইন ডেস্ক
দেশ-বিদেশের বাঙালি এক কণ্ঠ হয়ে পরিবেশন করে জাতীয় সংগীত। শুক্রবার ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি…। আহা! কী মধুর সংগীত। এত মধু, এত মায়া আর কোনো বাংলা গানে আছে? বাঙালি তাই যুগ যুগ ধরে প্রেম নিয়ে, বিশুদ্ধ হৃদয়াবেগ নিয়ে গানটি গেয়ে আসছে। এই গান, না, শুধু গান নয়। সংগীত নয় শুধু। দেশপ্রেমের প্রথম পাঠ। জেগে ওঠার প্রাণশক্তি। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাওয়া স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি…।’
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে বারবার গাওয়া হয়েছে এই গান। দাবি আদায়ের মঞ্চ থেকে, গণসমাবেশ থেকে গাওয়া হয়েছে। এমনকি ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে জহির রায়হান যখন নির্মাণ করলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’, সেখানেও গানটি অনিবার্যভাবে স্থান করে নিল। একাত্তরে রণাঙ্গনে বীর মুক্তিযোদ্ধারা গেয়েছেন।
প্রশিক্ষণের সময় গেয়েছেন। একাত্তরে মুক্ত অঞ্চল ঘুরে শিল্পীসমাজ কীভাবে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইতেন তার প্রমাণ তারেক মাসুদের অমর সৃষ্টি ‘মুক্তির গান’ চলচ্চিত্র। বাঙালির সংগ্রাম এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের পরতে পরতে মিশে থাকায় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত কী হবে তা নিয়ে আলাদা করে ভাবতে হয়নি। গণমানুষের রায় তো ছিলই, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের মহানায়ক জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান নিজেও এ গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে ঠিক করে রেখেছিলেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গান তখন থেকে আমাদের জাতীয় সংগীত। লক্ষ কোটিবার গাওয়া হয়েছে। গাওয়া হচ্ছে এখনো।
জাতীয় সংগীত যেমন দেশমাতার প্রতি অনুরাগের বহির্প্রকাশ, তেমনি প্রতিবাদের জোরালো ভাষা। যে কোনো সংকটের দিনে জাতীয় সংগীত গেয়ে আত্মাকে জাগিয়ে তুলে বাঙালি। অভিন্ন চেতনার জায়গা থেকে শুক্রবার দেশের নানা প্রান্তে সব বয়সী মানুষ গানটি গেয়েছেন। বিদেশে বসবাসরত বাঙালিরাও বাদ যাননি। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে প্রাণ খুলে গেয়েছেন তারা। গাইতে গাইতে কারও চোখের পাতা ভিজে গেছে। কারওবা চোখে ছিল আগুন!
এর আগে ফেসবুকে সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে জাতীয় সংগীত গাওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ব্যক্তিপর্যায়েও অনেকে আহ্বানটি জানিয়ে আসছিলেন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করে প্রথম দৃষ্টি কাঁড়ে মৌলভীবাজারের মানুষ। বৃহস্পতিবার বিপুলসংখ্যক মানুষ সমবেত হয়ে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করলে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয় সেখানে। ক্রমে এই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। অনেকে ভিডিওচিত্র সামনে রেখে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন। জনসমুদ্রের সঙ্গে ঠোঁট মেলান। রাতে একই আয়োজন ছিল জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। কয়েকশ’ শিক্ষার্থী রাতে ক্যাম্পাসে সমবেত হয়ে গিটার ইত্যাদি বাজিয়ে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেন।
রাজধানীর প্রধান আয়োজনটি ছিল ছায়ানটে। বাঙালির গর্বের প্রতিষ্ঠানে শুক্রবার সকালে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সম্মেলক কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন। খ্যাতিমান শিল্পী এবং প্রতিশ্রুতিশীল গায়ক-গায়িকারা তবলা- হারমোনিয়াম বাজিয়ে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইলে প্রাণ সত্যি জুড়িয়ে যায়। প্রতিষ্ঠানের সহসভাপতি বিশিষ্ট নজরুল সংগীত শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল বলছিলেন, তারা জাতীয় সংগীত গেয়েই পাঠদান শুরু করেন। তবে সম্প্রতি জাতীয় সংগীত নিয়ে এক ধরনের ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তাই প্রতিবাদ হিসেবে বিশেষ আয়োজনে তারা গানটি করেছেন।
বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে ‘কথা ক, আওয়াজ উডা’ ব্যানারে কর্মসূচি পালন করেন আরেক দল সংস্কৃতিকর্মী। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন তারা। এ সময় শিল্পীদের হাতে ছিল জাতীয় পতাকা। লাল সবুজের পতাকা জাতীয় সংগীতের সুরে আশ্চর্য সুন্দর উড়ছিল।
ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তায় ছিল উদীচী। বাম রাজনৈতিক দলের সাংস্কৃতিক অঙ্গ সংগঠন এখানে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় গাওয়া স্বাধীন বাংলা বেতারের গানও ছিল তাদের কণ্ঠে। একই সময় অঙ্গ সংগঠনের আহ্বানে দেশের বিভিন্ন জেলায় কর্মসূচি পালন করা হয়। জনকণ্ঠের চট্টগ্রাম অফিস জানায়, চেরাগী পাহাড় মোড়ে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ সম্মিলিত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন। এ সময় পথচারীরাও যোগ দেন আয়োজনে। জাতীয় সংগীত নিয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য দানকারী ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদোহী মন্তব্য করে উপস্থিত জনতা তাকে চট্টগ্রামে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। বিক্ষুব্ধ জনতার পক্ষ থেকে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাওয়া স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আমরা ভূলুণ্ঠিত হতে দেব না। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাওয়া জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীতের ওপর কোনো আঘাত আসতে দেব না। দেশের জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার ওপর আঘাত মুক্তিযুদ্ধের ওপর আঘাতের শামিল। জীবন দিয়ে হলেও এই ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়াব।
তারা আরও বলেন, যে বা যারা জাতীয় সংগীতের অবমাননা করে ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন তিনি বা তারা রাষ্ট্রদোহী। সাধারণ জনতা তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। এর পরও জাতীয় সংগীতের ওপর কোনো আঘাত এলে চট্টগ্রামের মানুষ প্রতিবাদে রাজপথে নেমে আসবে বলেও ঘোষণা দেওয়া হয় সমাবেশ থেকে।
রাজশাহী থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, সাহেববাজার জিরোপয়েন্টে বেলা ১১টায় প্রতিবাদী জাতীয় সংগীত ও দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করা হয়। সমাবেশে বক্তারা জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের যে পাঁয়তারা চলছে তার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। তারা বলেন, বাংলাদেশে যে জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত বলবৎ আছে এটা কোনোক্রমে পরিবর্তন হতে দেওয়া যাবে না। এই জাতীয় পতাকা পরিবর্তনের জন্য একাত্তরের পরাজিত শক্তিরা আবারও উদ্ধত আস্ফালনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে এবং তাদের প্রতিহত করার জন্য একসঙ্গে আওয়াজ তুলতে হবে। ময়মনসিংহ, বগুড়া, গাইবান্ধা, ফরিদপুর, ঝিনাইদহ, ঠাকুরগাঁও, পটুয়াখালীসহ অন্যান্য জেলাতেও জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় এদিন।
প্রতিবাদী জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হয় বিদেশের মাটিতেও। শুক্রবার কানাডার টরন্টোর ডেন্টোনিয়ায় অবস্থিত শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে ছিল জাতীয় সংগীতের পরিবেশনা। স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টায় সেখানে শতকণ্ঠে জাতীয় সংগীত শীর্ষক কর্মসূচির সূচনা করা হয়। ফোনে যোগাযোগ করা হলে অন্যতম এক আয়োজক জানান, ‘হোক সংগীত হোক প্রতিবাদ’ স্লোগানে শতাধিক প্রবাসী বাঙালি সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। গায়ে ছিল লাল সুবজ পোশাক। সবাই মিলে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করার পর নিজেদের কিছুটা ভার মুক্ত মনে হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কেও অনুরূপ প্রতিবাদী জাতীয় সংগীত পরিবেশন করবেন বাঙালিরা। প্রবাসী সংগঠকদের পক্ষে ডা. নুরুন নবী জানান, ৮ সেপ্টেম্বর বিকেল ৫টায় জ্যাকসন হাইটসের ডাইভার্সিটি প্লাজায় সমবেত হয়ে জাতীয় সংগীত গাইবেন তারা। এখানে স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়ও গান করবেন বলে জানা গেছে।
সব মিলিয়ে দারুণ এক জাগরণ। জাতীয় সংগীত ঘিরে এমন জাগরণ, এমন জেগে ওঠা সত্যি বড় আশাবাদী করছে বলে মনে করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম।